সেরীন ফেরদৌস : মেয়েটি গেছে তার বান্ধবীর বাড়িতে- এক পার্টিতে। পছন্দের বন্ধুটির (প্রেমিক নয়) সাথে গল্প করতে করতে নিরিবিলি একটি জায়গায় পৌঁছে যায়। তারপর ছেলেটি সুযোগ বুঝে মেয়েটির সাথে যে আচরণ করতে শুরু করলো, তাতে মেয়েটি বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পরে। মেয়েটির কোনো সায় বা সম্মতির তোয়াক্কা না করে ছেলেটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়তে উদ্যত হয়। ১৫ বছর বয়সী মেয়েটি এ ঘটনায় যারপর নাই বিরক্ত হয়। এবং পরবরতী কালে ব্যাপারটি তাকে ভুগিয়েছেও বেশ! এর পরের ঘটনা ঘটে মেয়েটির ১৬ বছর বয়সে আরেক বান্ধবীর বাড়িতে রাতে থাকতে গিয়ে। রাতের বেলায় সে যখন ঘুমিয়ে আছে, আরেকজন ছেলে তার খাটে উঠে আসে। বলাবাহুল্য সে ছেলেটিও মেয়েটিরই সমবয়সী।
এই দুটি ঘটনাই মেয়েটির ভাবনার জগতে তীব্র ধাক্কা মারে! দুজনেরই সেক্স এবং মেয়ে বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা কিভাবে কাজ করছে তা নিয়ে মেয়েটি ভাবতে শুরু করে। কারণ, ওই দুজনের একজনও মেয়েটি কি ভাবছে ওই নির্দিষ্ট আচরণের ব্যাপারে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি! অথবা মেয়েটিরও যে সম্মতি দেবার দরকার ছিলো বা আছে কি না তা নিয়ে ভাবেনি! বিষয়টিকে খুবই অস্বাভাবিক বলেই মনে হতে থাকে তার। প্রশ্ন জাগে তার মনে, ছেলেরা বয়ো:সন্ধির বেলায় মেয়েদের ব্যাপারে ঠিক কি চিন্তা করে! তারা ঠিক কী চিন্তা করে স্থির নিশ্চিত হয় যে, সে যে যৌন আচরণটি মেয়েটির সাথে করতে যাচ্ছে তাতে মেয়েটিরও সম্মতি আছে! কেনো এবং কি করে এই উদ্ভট চিন্তা ছেলেটির মাথায় এলো! বাইরে, আর দশটা জায়গায় যে-ছেলে স্মার্ট, সে কিভাবে যৌন আচরণের জায়গায় এত আহাম্মকির পরিচয় দিতে পারে! তাহলে কি ছেলেদের যৌনবিষয়ে জ্ঞান ও শেখার জায়গাটায় কোনো গ্যাপ আছে! যদি থাকে, তাহলে সেটা শোধরানোর উপায় কি? কিভাবে এই বিষয়ে জ্ঞানটা ছেলেদের চিন্তায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়! মেয়েটি কিছুতেই ভেবে পায় না, তরুণ ছেলেরা যৌন চিন্তার বিষয়টি সুস্থ ও সুন্দরভাবে চর্চা করতে পারে না কেনো! কোথায় সমস্যা!
তরুণী ওয়েব (মেয়েটির নাম) এ নিয়ে গভীর চিন্তা করলেও লম্বা সময় ধরে উপেক্ষা করে গেছে পুরো ঘটনা। কাউকে জানায়ওনি যে, সে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলো! কিন্তু পরবর্তীতে সে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সে সাথে সে ঘটনা জানায়। তাদের সবার অভিজ্ঞতা, উত্সাহ ও সমর্থনে মুখ খুলবার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তাই নয়, বন্ধুবান্ধবের সাথে আলোচনা করে এ সময়ের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘টিকটক’ এবং ‘ইন্সট্রাগ্রামে’ নতুন করে যৌন আচরণের শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে প্রচারণারও সিদ্ধান্ত নেয় সে! শিক্ষা কারিকুলামে যৌন শিক্ষার আরো সংস্কার প্রস্তাব করে ওয়েব একটি পিটিশন দাখিল করেছে যেখানে প্রায় ২০ হাজারের মতো সাক্ষরও যোগাড় হয়েছে ইতিমধ্যে। ওয়েবের পরিকল্পনা হলো নাগরিকদের সাক্ষরসহ তার পিটিশনটি সরকারের কাছে তুলে দেয়া যাতে শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে চলতি সময়ে যে সেক্স এডুকেশন কারিকুলাম আছে, ততে ‘সম্মতি’ এবং ‘যৌন হয়রানি’র বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়! টিকটকে মেয়েটির ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে এবং শত শত তরুণ-তরুণী তাঁদের মতামত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।
বলাবাহুল্য, ওয়েব নামের মেয়েটির এই প্রচারণা এবং পিটিশন সাইনের ব্যাপারটি এমন একটি সময়ে তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় হলো যখন অন্টারিও প্রদেশজুড়ে যৌনশিক্ষার ব্যাপারটি নিয়ে নানারকম টালবাহানা হচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক অতীতে কোনো সম্প্রদায়ের নেতা এবং কনজারভেটিভ সরকারের নানা আপত্তি, মামলা, পাল্টা মামলা ইত্যাদি নানা টানাপোড়েন শেষে মোটামুটি নতুন কিছু সংযোজনসহ একটি যৌনশিক্ষা কারিকুলাম বহাল আছে। এবং সেখানে যৌন আচরণ সম্মতির বিষয়টিও রয়েছে। বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে, গ্রেড-১ থেকেই যৌন আচরণে সম্মতির বিষয়টি শেখানো হয়। শিশুদেরকে শেখানো হয় যত্ন এবং ক্ষতিকর আচরণের প্রভেদ এবং কোন ক্ষেত্রে কেমন সাড়া দিতে হবে।
কিন্তু ওয়েবদের প্রজন্ম স্কুলে, খুব ছোটবেলা থেকেই এই শিক্ষা পেয়ে বড় হয়নি। তারা এটুকু জানতো যে, না মানে না। হ্যাঁ মানে হ্যাঁ। তবে, যৌন আচরণের বেলায় তার বাইরেও কথা থেকে যায়। টরন্টোর হাই স্কুল থেকে শুরু হওয়া এই প্রচারণায় সেই সুক্ষ্ম বিষয়টিও উঠে এসেছে। সেটা হলো, ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্ক, পরিবেশ, বয়স, ইচ্ছা ইত্যাদি নানা আঙ্গিক বিবেচনায় ‘না’ শব্দটির নানা অর্থ হবার ঝুঁকি রয়ে যায়! যৌন আচরণ বা হয়রানির বেলায় খুব সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে চালু ও জনপ্রিয় শ্লোগান হলো “না মানে না”। কিন্তু যৌন আচরণের মতো জটিল একটা ইমোশনাল এবং ফিজিক্যাল আচরণের বেলায় এই শ্লোগানের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যৌন আচরনে সম্মতির বিষয় শুধু হ্যাঁ বা না শব্দ দিয়ে বেঁধে ফেলার মতো সরল নয়। এর ভেতরে চতুরতার আশ্রয় নেবার নানা সুযোগ রয়ে যায়! ‘না’ অক্ষরটির অর্থ শুধু ‘বিরত থাকা’র বাইরেও নানারকম হতে পারে। আবার কোনোমতে ‘হ্যাঁ’ বলিয়ে নিয়ে হয়রানির সুযোগও নেয়া যেতে পারে। যৌন আচরণে ‘পাওয়ার ডায়নামিক্স’ কাজ করে যেখানে সম্মতি দেয়াই থাকতে পারে অথবা না বলার আরো একশো একটা ধরনও থাকতে পারে। তাই হাইস্কুলের তরুণরা মনে করছে, স্কুলের যৌন শিক্ষার কারিকুলামে যৌন সম্মতি বিষয়ে হ্যাঁ বা না বলার বাইরে আরো বিস্তৃত শেখানোর সুযোগ রয়ে গেছে! ওয়েবের মতে, “যৌন আচরণের ব্যাপারে পারষ্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গাগুলোতে আরো জ্ঞান বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে কোনো মেয়ে তার বিরুদ্ধে ঘটা যৌন নিরযাতনের ব্যাপারে মুখ খুলবে কি খুলবে না সেটা তার স্বাধীন চিন্তার অংশ হওয়া দরকার!” তবে মজার ব্যাপার হলো, ওয়েব তার যৌন হয়রানির ব্যাপারটি পুলিশকে না-জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এই ভেবে যে, পুলিশের এই ঘটনা দেখার চোখ আর ওয়েবের চোখ আলাদা। পুলিশ এতে ওয়েবকেই বিচার করবে বেশি। কারণ, ওয়েবের মতে পুলিশেরও সম্মতি বিষয়ক এইসব সু² ব্যাপারে যথেষ্ঠ জ্ঞান থাকার কথা নয়! এই তরুণদের নতুন শ্লোগান তাই- “না মানে শেখো”- ‘NO’ মানে KNOW.
বহু সংস্কৃতির হিসেবে কানাডাকে নানা এথনিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, বিশ্বাস, সংস্কার ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়েই যে কোনো নীতিমালা সাজাতে হয়। যৌন বিষয়ক শিক্ষা, বিশেষ কওে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কারিরক্যুলামে অন্তর্ঝঝ‚ক্তির প্রশ্নে নানা এথনিক ও ধর্মমীয় নেতাদেও বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হয়।ফলে সঙ্গত কারণেই ছাত্ররা অপরযাপ্ত ও ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে বড় হচ্ছে। পশ্চিমের উন্নত এবং উদার একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি এই চিত্র হয় তা হলে উন্নয়শীল কিংবা স্বল্পোন্নত দেশ- যেখানে যৌন বিষয়ক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ নাই- বা কম, সেখানে ছেলেরা কি মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে তা ভাববার বিষয়।সেই ভাবনারর জায়গা থেকেই ওয়েবের “না মানে শেখো”- ‘NO’ মানে KNOW
– নতুুন এই প্রচারণাটি তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
দেশে দেশে যৌন নির্যাতন বা যৌন হয়রানি বন্ধে পুরুষের মনোজগতে পরিবর্ততনের চেষ্টা দরকার। আর সেই পরিবর্তনের জন্য বর্তমানের ‘নো’ মানে ’না’ এর বদলে “না মানে শেখো”- ‘NO’ মানে KNOW -এই বক্তব্যটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। একজন নারীর শরীর স্পর্শ করার আগে তার সচেতন এবং পূর্ণ সম্মতির দরকার-এটি শৈশব থেকে ছেলেদের শেখানো না গেলে হঠাত করে ’নো মানে না- এমন শ্লোগান দিয়ে তাদের মনোজগত বা মানসিকতায় পরিবর্তন আনা যাবে না। কাজেই “না মানে শেখো”- ‘NO’ মানে KNOW-
শ্লোগানটিকে সামনে এনে ছেলেদের শেখানোর পদক্ষেপ নিয়েই ভাাবতে হবে।