রীনা গুলশান
: তাহলে তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারছো না কেনো?
: কারণ আমি আমার বাপের হোটেলে থাকি। তারাই আমার অভিভাবক।
: তুমি দেখবা সব ঠিক ঠাক হবে। এরপর শীহাব মাঝিকে বললো-
: এবার নৌকাটা কোথাও ভিড়ান, আমরা লাঞ্চটা করে নেই।
: আইচ্ছা, আমি সামনের ওই যে গেরাম ডা দেখা যায়, অই হানেই ঠ্যাকান দিমুনে।
: আচ্ছা চাচামিয়া আপনার যা মন চায়।
খুব সুন্দর একটা জায়গাতে মাঝি নৌকা থামালো। বেশ গাছ গাছালি ভরা। ওরা দুজন নামলো। বিরানি, কাবাব দুই রকমের আর কোল্ড ড্রিংক্স, মুসলিমের ভাপা সন্দেশও এনেছে। এটা দিয়ার খুবই প্রিয়। কিছুই ভোলে না। চাচামিয়াকে সব খাবার দিয়ে ওরা কলাগাছে ঘেরা জায়গাটাতে বসলো । এরপর দিয়া হাত ধুয়ে শীহাবকে সমস্ত খাবার খাইয়ে দিলো। শীহাবের চোখে ছিলো একই সাথে রৌদ্রছায়ার খেলা । অসম্ভব ভালোলাগায় শীহাব ভাষা হারিয়ে ফেলছিল। শীহাবের তাড়াতে ফাঁকে ফাঁকে দিয়াও কিছু খেলো। ওর খাওয়ার থেকে খাওয়াতে ভালো লাগছিলো। খাবার পরও অনেকক্ষণ ওরা বসে রইলো ভালোলাগার আবেশে। তারপর আবার নৌকাতে উঠলো। এবার শীহাব আবার ফিরে যেতে বললো। ওদের মোটেও ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। যদিও ফিরে যাবার তাড়া ছিলো। নৌকায় উঠে দিয়া আবারো মন মরা হয়ে রইলো। শীহাব তাকে বার বার জিজ্ঞাসা করলো-

: এই দিয়ালী, সোনা আমার কি হয়েছে? প্লিজ বলো, এই নৈঃশব্দ তোমাকে মানায় না। দিয়া কোন কথা না বলে হঠাৎ শীহাবের গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। শীহাব অনেকবার বললো-
: কি হয়েছে, আমি কি কোন অন্যায় করেছি?
: না, শিহাব আমার খুবই ভয় করছে!
: কিসের ভয় দিয়ালী?
: আমার কিছু ভালো লাগছে না, মনের ভেতরে ক্যাবোলই ক‚ গাইছে।
: আরে ধূর! কি যে বলো না! কিসের ভয়? এই দেখো গভীর বয়ে যাওয়া নদী, যেন সুদূরের হাতছানি, অই দেখো আকাশটা গাঁ এর সাথে কেমন মিশে গেছে! দেখ দেখ বলাকারা কেমন অজানার পথে পাড়ি দিয়েছে। ওখানে কোথায় ভয় বলতো?
: শিহাব আমি বলাকা নই … আমি দিয়া, আমার তেল ফুরিয়ে গেলে আমি নিভে যাই।
: কিন্তু আমিতো তোমার তেল কখোনো ফুরাতে দেবো না। তুমি কেনো এরকম ব্যাকুল হলে বলতো?

: কেনো হবো না? তুমি ইউ কে যাবার আনন্দে কিছু বুঝতে চাইছো না, আমার বাসার বর্তমান পরিস্থিতি তুমি বুঝতে পারছো না। অনিকের কথা আগেই তোমাকে বলেছি। সে আমাদের বাড়ীর সবাইকে রীতিমত গ্র্সা করে রেখেছ।
: দিয়া, আমি তো মাত্র চার বছরের জন্য যাচ্ছি।
: ওটা তোমার জন্য মাত্র হতে পারে, আমার জন্য নয়! আমার বাবার অবসরের সময় ও এসে গেছে। আমি পার হলে তারপর থাকবে পিয়া। আমার বাবা ছা পোষা মানুষ। শেষ জীবনটা তাকে গ্রামে কাটাতে হবে।
: তুমি দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। চারটে বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। এক নিমিষেই যেনো একটি কালরাত্রী।
: হ্যাঁ! জীবনটা একদম কবিতা নয়, সেটা এই বয়সেই একদম বুঝে গেছি। আমার শুধু একটিই চিন্তা, কি ভাবে যে আমি আমাদের প্রতিজ্ঞা রাখবো? যদি না রাখতে পারি তো তুমি ভাববে, দিয়া তোমার সাথে বিট্রে করেছে।
: না দিয়ালী, আমি মোটেই তা ভাববো না। সেই ছোট বেলা থেকেই তোমাকে জানি তোমার পরিবারকে জানি তুমি কখনো মিথ্যা কথা বলো না।

সন্ধ্যা হতে আর দেরী নাই। ওদের নৌকা ঘাটে এসে ভীড়লো। ফেরার পথে দিয়া শাহীনকে নিয়ে বাড়ী ফিরল। একদিন যাবার সময় ঘনিয়ে এলো। আগামী পরশু শীহাব চলে যাবে। দিয়া সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। ভেতরে এক অজানিতো ছটফটানি কাজ করছে। না ঘুমাতে পারছে, না খেতে পারছে। মাঝখানে আর একটা দিন। মারাত্মক এক ভয়ের ছায়া ওকে ঘিরে রেখেছে। বারবার ওর মনে হচ্ছে, এই ওর শেষ দেখা। পরদিন বিকালের দিকে দেখলো হঠাৎ, শীহাব ওর মাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। অনেকক্ষন সবাই মিলে গল্প করলো। শীহাব ফরমালি সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছে। ওর মা, শীহাবদের জোর করে ডিনার করিয়ে দিলো। যাবার আগে সবার অগোচরে শীহাব দিয়ার হাতে একটা চিঠি গুজে দিলো। অনেকরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনকি ওর পাশে ছোট বোন পিয়াও অকাতরে ঘুমুচ্ছে ……, তখন দিয়া কি এক অদম্য স্পৃহায় উঠে পড়লো, ঐ চিঠিটি তাকে টানছে –চিঠি বলা ভুল হবে। একটি কবিতা, কবি মহাদেব সাহার …

দিয়ালী,
“করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবী চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করেও হলে বলো, ভালোবাসি।”

চলে যাচ্ছি, পড়তে যাচ্ছি, দেশ ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছিনা। শরীরে যাচ্ছি, মননে নয়। মনের সবটুকু আমার দিয়ালীর কাছে রেখে যাচ্ছি ।
তোমার শীহাব।

এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে দিয়া। তখনই চলে গেলো শীহাব। ওকে নিঃস্ব করে চলে গেলো। তারপরও পড়াশুনা জোরেসোরে শুরু করলো, যাতে বাবা মা বোঝে সে পড়াশুনায় খুবই মনোযোগি। একবার টিয়াও বললো যে,
: আব্বু, দিয়াকে এত জলদি বিয়ে দেবার কোন দরকার নাই।
: কেনো?
: দেখছো না, বড়আপু এত্ত মেধাবী ছিল, তাকে ওর শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা আর পড়ালোনা। দুলাভাইও তো বললো, মেয়েমানুষের এত্ত পড়ে কি হবে? কেনো মেয়েরাকি গরু ছাগল?
: হ্যাঁ মা তুই ঠিক বলেছিস। কিন্তু কি করবো বল? ওরা কোনো যৌতুক নিলো না। একদম নিখরচায় কি মেয়ে পার করা যায়? এতো আল্লাহর অনেক করুণা আমার উপর যে, তোরা চারটা বোনই তোদের মায়ের উপর গেছিস। আমার রংটা কেও পাসনি।
: কিন্তু আব্বু, এ যুগে মেয়েদের পড়ালেখারও খুবই দরকার।
: হ্যাঁ, আমি এবার সেই জন্য অনিকদের পরিবারের সাথে কথা বলেছি, ওরা আমাকে কথা দিয়েছে, দিয়া যতদূর পড়তে চায়, ওরা পড়াবে। অনিক নিজে আমাকে প্রমিস করেছে।
: বিয়ের পর কি আর সেই প্রমিস রক্ষা করবে?

: হ্যাঁ করবে মা। আমি মানুষকে চিনি। ও নিজে একজন সফট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। কানাডা থেকে এম এস করে এসেছে। কানাডিয়ান কোম্পানিতে এত বড় পোষ্টে চাকরী করে। ওর নিজেরোতো একটা স্ট্যাটাস আছে তাই না?
: সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছো।
: আমার আর ৩/৪ বছর আছে অবসরের। তখন গ্রামে চলে যেতে হবে। পিয়া কে নিয়েই চলে যেতে হবে।
: না আব্বু, পিয়া আমার কাছে থাকবে। তোমার জামাই নিজেই বলেছে।
: তাই? জামিলকে আমি নিজে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো!
: কেনো এ ভাবে বলছ কেনো? শুধু ছেলেদেরই দায়িত্ব আছে, মেয়েদের নাই? পাশের ঘর থেকে ওদের ক্কথোপকথন শুনছিলো দিয়া। বুঝলো সবই। তারপরও অনেক পড়াশুনার ঝামেলা দেখিয়েও, খুব বেশীদূর এগুনো গেলো না। এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই ধুমধাম করে দিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো। যদিও দিয়া , শীহাব কে ৩/৪ টা চিঠি ইংল্যান্ডে পোষ্ট করলো। একটি চিঠিরও জবাব এলো না। শাহীন অনেক কষ্টে ওর একটা ফোন নাম্বার যোগাড় করলো। ওরা দুজন চুরি করে পোষ্ট অফিসে গিয়ে সেই নাম্বারে বহুবার ট্রাই করলো, কেউ ধরলো না। শীহাবের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু জীহানকে বললো সব। সেও অনেক ট্রাই করলো। ফলাফল শূন্য।

অতএব, এক বর্ণিল সন্ধ্যায় দিয়ার খুবই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের সব খরচাও অনিক করলো। বিয়ের পুরো সময়টা দিয়া শাহীনের গলা জড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদলো। তবু বিয়ের করুন সানাইয়ের মধ্যে দিয়ে দিয়ার বিদায় হলো। বিয়ের পরদিনই ওকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় গেলো অনিক, ভারতের কন্যাকুমারী’তে। এটা একদিন কথায় কথায় বলেছিলো যে, এই জায়গাটা তার দেখার খুবই ইচ্ছা। তিন সাগরের সঙ্গম স্থলে, স্বামী বিবেকানন্দ মঠে দাঁড়িয়ে, তিন সাগরের পানির ঢেঊ দেখতে দেখতে -দিয়া গভীর আবেগে হৃদয় মথিতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অনিকের বুকে।

দিয়ার বুকের মধ্যে বেদনার তোলপাড়। সেই বেদনায় তাড়িতো হয়ে অনিককে ওর ফেলে আসা জীবনের অসমাপ্ত এলবাম একে একে খুলে দিলো। কোন কিছুই গোপন করলো না। সব শুনে অনিক গভীর আবেগে দিয়াকে বুকে টেনে নিলো। তারপর খুব ধীর স্বরে বললোÑ
: দিয়া, দেখো মানুষের জীবনও এই সাগরের মতন, মাঝে মধ্যেই এইরকম বিপুল ঢেউ এসে আমাদের জীবনের তটিনকে মুহুর্তে ভিজিয়ে দেয়। লন্ড ভন্ড করে দেয় কত স্বপ্নের আল্পনা। আবার দেখো নতুন করে বাঁচার আশ্বাস রেখে যায়। তবু দেখো জীবন কিন্তু কোনো ভাবেই থেমে থাকে না। জীবন জীবনের মত চলতেই থাকবে। তবে তার মধ্যে এইরকম গর্জন আসবে, পরিবর্তনের ঢেউ আসবে, আবার এইরকম স্থিরতাও আসবে। দেখো আমি খুবই বাস্তববাদী মানুষ, বাস্তবতাকেই আমি শ্রদ্ধা করি। তার মানে এই নয়, আমি তোমার অতীত কে অশ্রদ্ধা করি। বরং তাকে শ্রদ্ধা করেই বলছি; অতীত কে কখনো ভুলবার চেষ্টা করবে না। যদি ভুলে যাবার মতো হয়, তবে সেটা তোমার নিজের অজান্তেই বিস্মৃতির অতলে চলে যাবে। তবে একটা অনুরোধ করছি, তুমি শিহাবকে অনেক ভালবেসেছো, অবশিষ্ট ভালবাসা থেকে আমাকে একটু খানি ভালবাসা দিলেই চলবে। তোমার জন্য আমার অফুরান প্রেম, আর আমার প্রতি তোমার অই একটু খানি প্রেম মিলেই দেখবে আমাদের সংসারে সোনার ফসল ফলছে। দিয়ার বিস্মিত চোখে গভীর শ্রদ্ধা নেমে এলো।

তারপর একটু একটু করে অনিকের অফুরান ভালোবাসার কাছে সে নিজেকে বিলীন করে দিলো। অনিক তার কথাও রেখেছে। দিয়াকে ঢাবী’তে ভর্তী করে দিয়েছে। দিয়া ভর্তী পরীক্ষায় খুবই ভালো করেছিলো। ওর প্রথম চয়েস ছিলো, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসিপ। অনিক বরং খুশীই হলো। চতুর্থ সেমিষ্টারের সময় তার প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। অনিক বাচ্চা হবার আগেই গ্রাম থেকে তার এক বিধবা চাচিকে নিয়ে এলো। তারপর এক সোনালী সকালে দিয়ার কোল আলো করে বাবুনের আগমন হলো। সবাই খুব খুশী। অনিক অনেক বড় করে পার্টি দিলো। বাবুনের জন্মের মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আবার ভার্সিটি তে যাওয়া লাগলো । কারন সেমিষ্টার ফাইনাল কয়েকদিন পরই। আরো এক বছর পর অনার্স ফাইনাল হয়ে গেল। এর মধ্যেই অনিকের কোম্পানি থেকেই কানাডা যাবার একটা সুযোগ এলো। অনিক রাজি হয়ে গেলো। শুধু এক বছর টাইম চেয়ে নিলো। দিয়ার এম এ পরীক্ষার জন্য।
তবে দিয়ার মনের মধ্যে অনিককে নিয়ে একটা কাঁটার মতো বিঁধে আছে বেশ কিছুদিন ধরে। বাবুন পেটে এলো আর অনিকের কেমন যেনো দূরত্ব বেড়ে গেলো। দিয়া ভাবলো, তার প্রেগন্যান্সির জন্য তাকে রিলিফ দিচ্ছে। এরপর বাবুন হয়ে গেলো। তখনও সে দুরে দুরে রইলো। বাচ্চার বয়স প্রায় ৬ মাস হয়ে গেলো, অনিক ভালবাসায় জড়িয়ে রাখে তাদের, শুধু রাত হলেই তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। দিয়ার খুবই আশ্চর্য এক অনুভূতি হয়, সে কাউকে কিছু বলতেও পারে না। একরাতে দিয়া নিজেই কি এক তাড়নায়, অনিক কে গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো। তারপর অনিক কাছে এলো, তাকে আদর করলো। কিন্তু অনিকের মধ্যে ঘাটতি ছিল। বিয়ের পরের অনিককে খুঁজে পেলো না। ব্যাপারটা সে আগেও যে খেয়াল করেনি তা নয়। বিয়ের পরে বছর খানেক সে সুখের পায়রা হয়ে ঘুরেছে। তার পরেই অনিকের মধ্যে যেন কিসের ঘাটতি, ও বুঝতে পারে না। আর সেই সময়ে ওর বোঝার কথাও নয়। একদিকে বয়সও কম ছিলো। অন্যদিকে শীহাবের বিচ্ছেদের বেদনায় অনেকাংশেই সে মুহ্যমান ছিলো।

ইতিমধ্যে দিয়ার এম এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর অনিক কানাডা যাবার প্রসেসিংও শেষ করে ফেলেছে। তারপর, তার এতদিনের চির চেনা শহর তার প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে এক অজানা গন্তব্যে চলে এলো। কানাডা। অনিকের গ্রামের এবং তার ছোট্ট বেলার এক বন্ধু ছিলো টরেন্টোতে। অনিমেষ সাহা। সেই ঘর ঠিক করে রেখেছিলো। দু কামরার এপার্টমেন্ট। সুন্দর। ১৯ তলা। প্রথম প্রথম দিয়ার খুব ভয় করতো। অচেনা শহর, অন্য জগত। বাংলাদেশে তার দুইটা কাজের লোক ছিলো। বাবুনের দেখাশোনা করার জন্য অনিকের চাচি ছিল। এখানে কেউ নাই। অনিকেরও নতুন অফিস। সব কিছু বুঝে নিতে হচ্ছে, সেও ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওকে তেমন সময় দিতে পারছে না। সে জন্য অবশ্য ওর কোন অভিযোগও নাই। বরং ও খুব দ্রæত নিজেকে মানিয়ে নিল। একা হাতে রান্না, ঘর পরিস্কার, আর বাবুনের অষ্টপ্রহর দেখাশোনা। শুধু ছুটির দিনে তিনজন একসাথে গিয়ে সপ্তাহের বাজারটা করে আসতো।

একদিন শুধু অনিককে ছুটি নিতে হলো, ফ্যামিলি ডাক্তারের জন্য। এত ব্যস্ততার মধ্যেও দিয়া দেখলো ,অনিক নিত্য কোন হার্বাল ডাক্তার দেখায়। নিয়ম করে ওষুধ খায়। এভাবে চলছিলো জীবন। এর মধ্যেই ও টের পেলো তার শরীরের মধ্যে অন্য কারো অস্তিত্ব। ডাক্তার ও নিশ্চিত করলো। দিয়া আবারো মা হলো। এবার তার কাংখিতো কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। দুজন মিলে নাম ঠিক করলো লাবনী। খুব মিষ্টি। তবে এবারে সিজার করে হলো। অনিক একমাস ছুটি নিলো। একা হাতেই সব করলো। কারন দিয়া খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তবে অনিমেষ আর ওর বৌ নীতাও অনেক করলো। বৌদিতো ৪/৫ দিন ওদের বাসায় থেকে গেলো। দিয়ার নিজেকে পুরোপুরি ফিরে পেতে প্রায় তিন মাসের মতো লাগলো।
বাবুনের স্কুলে যাবার ও সময় হয়ে গেলো। এখন দিয়া আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এর মধ্যে অনিক আর ও ড্রাইভিং লাইসেন্সও নিয়ে নিলো। সারাক্ষন কারো মুখোপেক্ষি হতে ওর ভাল লাগে না। সব কিছু ঠিক ঠাক চলছিল। শুধু অনিকই দিন দিন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিলো। দিনের অনিকের সাথে, রাতের অনিককে কিছুতেই মেলানো যেতো না। দিনের বেলায় সদা হাস্যময়, সক্রিয়। আর রাত হলেই সে বিষন্ন। এমনকি রীতিমত বিপন্ন। প্রায় প্রতি রাতেই তার নিত্যকার বাক্যে পরিনত হলো — গায়ে ব্যথা, খুব ঘুম পাচ্ছে, ওহ আজ মারাত্মক ক্লান্ত , এইসব। দিয়ার এখন মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স। তার শারীরিক অনুভূতি এখন তীব্র। সে নিজেই, এখন অনিককে আঁকড়ে ধরে সজোরে। খামচে ধরে বাহুমুলে। অনিক তখন দিয়াকে আদরে আদরে ভরে দেয়। তারপর দিয়াকে সম্পূর্ণ উদ্ভুদ্ধ করে, অগত্যা অনিক অকৃতকার্যতার ভারে ওর বুকের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে। আর দিয়া তখন সারারাত জেগে থাকে শারীরিক বিবমিষায়। এই অসহ্য কষ্ট সে কারো কাছে শেয়ারও করতে পারে না। শুধু দিনে দিনে তার বুকের ভেতরে অনিকের প্রতি একধরনের বিদ্বেষ কাজ করে। শারীরিক এই বিপন্নতায় দিয়া সারারাত ঘুমাতে পারে না। মানুষ কত সুন্দর করে ঘুমায়। মাঝরাতে দিয়া ডাইনিং স্পেসে পায়চারী করে। ঘুম জাগানীয়া মাথায় আল মাহমুদের কবিতা কথা বলে-
“আমি তাই খুঁজি শুধু কোথা আছে ঘুমের আফিম
আদিম ক্লান্তিতে যেটা আমার শরীর বেয়ে নামে
অথবা এলিয়ে দেয় বিছানায় নিবিড় আরামে
শিথিল দেহের তাপে ভরে ওঠে ঘুমের জাজিম!!”

বাইরের মানুষেরা অনিকের বাইরের রূপ দেখে। চকিতো হয় তারা। তারা অবিরত মুগ্ধ হয়। আর দিয়ার ভেতরে ক্যাবোলি তিক্ততা জমে। মাঝেমধ্যে কড়া ধরনের কোন ওষুধ খায়। তখন সে নিজেই খুব মাতামাতি করে দিয়াকে নিয়ে। কিন্তু দিয়া জানে ওটা সাময়িক। তাছাড়া মাঝে মাঝে ওষুধেও কাজ করে না। দিন এভাবেই ভালোবাসা এবং তীক্ততায় চলে যাচ্ছিলো। বাবুন আর লাবনীকে নিয়েই তার দিনের ভুভাগ কাটছিলো। বাচ্চারা ছোটো তাই চাকরীর চেষ্টা ও করছিলো না। এই সব দিন রাত্রের মধ্যেই একদিন হঠাৎ শাহিনের ফোন এলো। ও এখন নিউইয়র্কে থাকে। ওখানেই নাকি শীহাবের সাথে দেখা হয়েছে। সে আজো বিয়ে করেনি। দিয়ার বিয়ের আগে যেসব চিঠি দিয়েছিলো, সে নাকি ওগুলো কিছুই পায়নি। এমনিতে দিয়ার সব খবরই সে রাখে। শাহীনকে একটা চিঠি দিয়েছে, দিয়াকে দেবার জন্য। দিয়া বললো, ঠিক আছে, পাঠিয়ে দে। সে মেইলিং এড্রেস বলে দিলো। দু দিনের মধ্যেই চিঠিটা চলে এলো। শীহাব যেমন চিঠি লেখে, এটাও সেইরকমই। তরুন চট্টোপাধ্যায় এর একটি কবিতার কিছু চরণ-

দিয়ালী,

“ভালোবাসা মানে এই নয় শুধু জ্যোৎস্নায় গান গাওয়া।
ভালোবাসা মানে ফুলের মতন নিঃশেষে ঝরে যাওয়া।
ভালোবাসা মানে এই নয় শুধু হাতে হাত খানি রাখা।
ভালোবাসা মানে হৃদয় বেদনা মনের গভীরে ঢাকা।
ভালবাসা মানে শুধুই দুজন? বাকি আর সব পর?
ভালোবাসা মানে সবাই আপন তুমি আমি যাযাবর।“
জানি তোমাকে শেষ পর্যন্ত পাইনি। তবু তুমি আছো আমার সবখানে। আজীবন থাকবে। তুমি তোমার সংসারের আঙ্গিনা নিয়ে ভালো থেক প্রতিরাত সারাবেলা —–
শীহাব । শেষ