স্বপন কুমার সিকদার : পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে কিম্বা আরও বৃহত্তর পরিসরে নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক নেতৃত্বের ফলে একটি পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, দেশ- এমনকি বিশ্বও বদলে যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাস মূলতঃ নেতৃত্বের ইতিহাস। যোগ্য নেতা ও নেতৃত্বের ফলে নতুন সভ্যতার জন্ম হয়, শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের। নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতিবিদ ও মনীষীগনের অভিমত-
“নেতা মানে যে অন্যদের মনে আশা জাগিয়ে রাখতে পারে”- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (বিশ্বখ্যাত ফ্রেঞ্চ সেনাপতি)
“পাহাড় চূড়া নেতাদের অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু সমতলেই তারা নেতায় পরিনত হয়” – উইনস্টন চার্চিল
“একজন নেতা যদি সৎ হয়, তবে তার অনুসারীরা অসৎ হওয়ার সাহস পায় না” – কনফুশিয়াস (প্রাচীন চীনা দার্শনিক)
“আমার কাছে নেতার সংজ্ঞা হল, তার অবশ্যই একটি দর্শন থাকতে হবে, এবং কোনও সমস্যাতেই সে ভয় পাবে না। তার বদলে সে তা সমাধানের জন্য কাজ করবে। আর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল, তাকে সৎ হতে হবে”
– ড. এপিজে আব্দুল কালাম

“জাহাজ বানাতে চাইলে তোমার লোকদের কাজ ভাগ করে দিয়ে নির্দেশ দিতে থাকার বদলে, তাদের সমুদ্রের অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাও” – এন্টনি ডি সেইন্ট (বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ লেখক)
“নেতারা জন্মায় না; কঠোর চেষ্টা ও ত্যাগের মাধ্যমে একজন মানুষ নেতায় পরিণত হয়। জীবনে যে কোনও বড় অর্জনের জন্যই এগুলো প্রয়োজন” – ভিন্স লম্বারডি
মাননিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায় টিকে থাকা বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন। নেতৃত্ব হলো গুরুত্বপূর্ণ ফল লাভের জন্য মানুষ বা কর্মচারী এবং সিষ্টেম বা পদ্ধতিকে অর্থপূর্ণ বা ইতিবাচকভাবে প্রভাবান্বিত বা পরিচালিত করার ক্ষমতা। নেতৃত্ব হল এমন এক “সামাজিক প্রভাবের প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মানুষ কোনও একটি সর্বজনীন কাজ সম্পন্ন করার জন্য অন্যান্য মানুষের সহায়তা ও সমর্থন লাভ করতে পারে”। এলান কিথ আরও সর্বব্যাপী একটি সংজ্ঞা দেন। তিনি বলেন, “নেতৃত্ব হল মানুষের জন্য একটি পথ খুলে দেয়া যাতে তারা কোন অসাধারণ ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রাখতে পারে”। মানুষ সাহসীদের নেতা বানায়। যারা সাহস করে মানুষের অধিকারের কথা বলে ও তাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, তারাই নেতায় পরিণত হয়।

নেতৃত্ব হলো গুরুত্বপূর্ণ ফল লাভের জন্য মানুষ বা সিস্টেমকে অর্থপূর্ণভাবে পরিচালিত করার ক্ষমতা

নেতৃত্বকে নির্দেশ দেয়া ও নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা থেকে সরে এসে প্রশিক্ষণ বা সহায়তা প্রশিক্ষণ এবং সহজতর করা বা সুবিধা প্রদানের ভূমিকায় অবতীর্ন হতে হবে। নেতৃত্ব পরিষ্কার ও দৃশ্যমান গুনগত মান সৃষ্টি করবে এবং ইহাকে প্রতিষ্ঠানের কর্মকৌশলের মধ্যে সমন্বিত বা অংশভুক্ত করতে হবে। জ্যেষ্ট ব্যবস্থাপকের নির্বাহী নেতৃত্ব একটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে তথা প্রতিষ্ঠানকে পরিচালিত করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জ্যেষ্ট ব্যবস্থাপকের বিবিধ কার্যাবলীর মধ্যে নিন্মবর্নিত গুলি অন্যতম –
১। কাজ বা ব্যবসাকে সজ্ঞায়িত করা এবং কাজ বা ব্যবসার দিকনির্দেশনা প্রদান
২। লক্ষ্য ও আশাপূরণ হওয়া নিশ্চিতকরণ
৩। কাজ বা ব্যবসার অবদান বা কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা এবং যথাবিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ
৪। উপভোগ্য কর্ম-পরিবেশ সৃষ্টি করে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন বৃদ্ধি এবং ক্রমাগত উন্নয়ন
৫। ভোক্তাকে জোগান ও প্রতিক্রিয়ার জন্য অনুরোধকরণ
৬। কর্মচারীরা কাজ বা ব্যবসার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও কাজ বা ব্যবসার প্রাণ তাহা নিশ্চিত করা
৭। কর্মচারীগণকে প্ররোচিত করা, উৎসাহ প্রদান এবং তেজোদীপ্ত বা কর্মশক্তি প্রদান করা
৮। কর্মচারীগণের অবদানকে স্বীকার করা
৯। সৎ প্রতিক্রিয়া প্রদান
কার্যকর নেতৃত্ব : ইহার জন্য পাঁচটি প্রধান দক্ষতার প্রয়োজন। যেমন- দূরদর্শিতা বা কল্পনাশক্তি, ক্ষমতায়ন, অন্তর্দৃষ্টি, স্ব-বোজা এবং মানসংগতি বা সামঞ্জস্যপূর্ণ বা উপযোগী জ্ঞান।

১। নেতা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বা স্বপ্নদর্শী হন। উনারা অতীত নয়, ভবিষ্যৎকে নিয়ে ভাবেন ও ব্যবস্থা নেন। স্বপ্নদর্শী নেতাগণ আকাংখিত অবস্থার মানসিক ও মৌখিক ছবি বা অবয়ব সৃষ্টি করেন এবং তাহা ভোক্তা, সরবরাহকারী, কর্মচারীসহ প্রতিষ্ঠানের অংশীদারগণের সাথে মত বিনিময় করেন
২। নেতা কর্মচারীকে ক্ষমতায়ন করেন যেন উনারা সমস্যা ও সুযোগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, উন্নয়ন পলিসি বাস্তবায়নে সক্রিয় হন এবং প্রতিষ্ঠানের সর্বোত্তম স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন
৩। নেতা অন্তর্দৃষ্টি বা স্বত: লব্ধ জ্ঞান অনুসরণে ভীত নন। এমনকি পরিবর্তিত বা অনিশ্চিত অবস্থায় উনারা ভবিষ্যৎ পূর্বানুমান করেন এবং সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রস্তুত থাকেন যাহা প্রতিষ্ঠানকে কৃতকার্য হতে সহায়তা করে
৪। নিজেকে জানা বা বোঝার জন্য নেতার নিজকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার যোগ্যতা প্রয়োজন এবং পরবর্তীতে নেতা কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ করেন
৫। মান সামঞ্জস্যতা বা উপযোগীতা ঘটে যখন নেতা তাদের যোগ্যতা বা মানকে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে সমন্বিত বা অংশভুক্ত করেন।
নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন:

নেতৃত্ব হলো গুরুত্বপূর্ণ ফল লাভের জন্য মানুষ বা সিস্টেমকে অর্থপূর্ণভাবে পরিচালিত করার ক্ষমতা

১। নেতা ভোক্তার প্রতি কৌশলগত দৃষ্টি দেন এবং সুস্পষ্ট মান বা মূল্যবোধক সিদ্ধান্ত নেন যাহা সক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভিত্তি হিসাবে কাজ করে
২। নেতা ক্ষমতায়ন, উদ্ভাবন, সাংগঠনিক শিক্ষার জন্য নেতৃত্ব ব্যবস্থা এবং পরিবেশ সৃষ্টি করেন ও তাহা বজায় রাখেন
৩। নেতা উচ্চ-প্রত্যাশা স্থাপন বা ধার্য করেন এবং গুনগত মানে প্রায়ই মিশনারীর মত উদ্দীপনাসহ যথেষ্ট ব্যক্তিগত অঙ্গীকার ও সম্পৃক্ততা প্রদর্শন করেন
৪। নেতা দৈনন্দিন নেতৃত্বে এবং ব্যবস্থাপনায় গুনমান সংহত করেন এবং সকল কর্মচারীর সাথে নেতৃত্ব-কাঠামোর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে যোগাযোগ সৃষ্টি করেন
৫। নেতা জনগণের দায়িত্ব ও কমিউনিটি সাপোর্ট ব্যবসায়িক অনুশীলনে সংহত বা একীভূত করেন
সর্বোপরি, নেতৃত্ব সমগ্র গুনগতমান উন্নত করন পদ্ধতিতে ‘চালক’ হিসাবে কাজ করে এবং এক বা ততোধিক বৎসরে যেখানে পৌঁছা উচিত বা পারবেন তাহা নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও তদারক করেন

কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য বিশিষ্ট অনুশীলন:
১। শীর্ষ ব্যবস্থাপনা, কর্মচারী, এমনকি ভোক্তা বা সরবরাহকারী পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন
২। কৌশল উন্নয়ন ও বিস্তারে প্রতিক্রিয়া পরিমাপ ও পর্যালোচনাসহ নেতৃত্বের নিয়মতান্ত্রিক পরিকল্পনা পদ্ধতি থাকে
৩। তাহারা কৌশলগত পরিকল্পনা পদ্ধতির অংশ হিসাবে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন বিভিন্ন ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন
৪। তাহারা উন্নয়নের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলগত লক্ষ্যের সাথে স্বল্প মেয়াদী কর্ম-পরিকল্পনা একই সারিতে সাজান এবং তাহা পরিমাপ ও ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবাইকে জানান। প্রতিষ্ঠানের নেতাগণ প্রথমে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য, দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দেশক নীতি অন্বেষন বা অনুসন্ধান করেন যাহা প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত পরিকল্পনার ভিত্তি গঠন করে বা ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।

অতএব, একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র দক্ষ ও দুরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনাই পারে একটি প্রতিষ্ঠানকে সফলতা তথা উন্নতির স্বর্নশিখরে পৌঁছে দিতে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, দক্ষ ও দুরদৃষ্টি সম্পন্ন সফল নেতৃত্বের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিলেন অতুলনীয়। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর মুক্ত হয়ে জেল গেইটেই বাংলার একমুটো ধূলি হাতে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এই বাংলার মাটিতেই যেন আমার কবর হয়”। উনি তখন জানতেন না অন্য কোন মামলা দেখিয়ে আবার গ্রেফতার করা হবে কিনা, কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে বা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার কি করে। বঙ্গবন্ধু এত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু যদি উপস্থিত জনতাকে বলতেন আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চন্দ্র চাই, তখন উপস্থিত জনতা হয়তো বলতো, “প্রিয় বঙ্গবন্ধু, আপনি আর কি চান?” আশ্চর্য হই এই ভেবে যে. কতটুকু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতা হলে যেখানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ই মার্চ লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে অনেকেই বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের মধ্যে অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা শুনার জন্য বা মনে করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ঐ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন অথচ উনি অতটুকু গেলেন না। আবার ২৫ শে মার্চের কালরাত্রিতে অন্যান্য নেতা সবাইকে চলে যেতে বলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নং-এ উনার নিজ বাড়ীতে অবস্থান করলেন। বঙ্গবন্ধুর দেশকে তথা দেশের মানুষকে ভালবাসার গভীরতা ছিল সীমাহীন। এখানে একটি স্মৃতিচারন না করলেই নয়। ১৯৭৭ সনে প্রকৌশলী হিসাবে ঢাকায় একটি প্রতিষ্টানে কাজে যোগ দিই। কয়েকজন মিলে ঢাকায় একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম। বাসার মেম্বারদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিজ্ঞ সিনিয়র এক কর্মকর্তা। একদিন সন্ধ্যায় আলাপ হচ্ছিল বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। উনি মন্তব্য করলেন, “বঙ্গবন্ধুর মাজার টুঙ্গীপাড়া থেকে একদিন ঢাকায় নিয়ে আসা হতে পারে”। আসলে আক্ষরিক অর্থে উনার কথার যে অর্থ দাড়ায়, উনি তা বুঝান নাই। বিশ্লেষনে উনি বললেন, “রাজনীতি ঘুরে দাড়াতে পারে”। অনেকদিন পর রাজনীতি ঘুরে দাড়ায়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সমৃদ্ধ নেতৃত্ব তথা মানুষ বা জাতি সৃষ্ঠি বা তা ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন মনে করি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লিখিত একটি কবিতা (কবিতাটি বিশিষ্ট বাংলা পত্রিকা ‘আমাদেরসময়.কম’, ঢাকা ও ‘বাংলা কাগজ’, টরন্টোতে প্রকাশিত) থেকে দুটি লাইন এখানে তুলে ধরলাম –“নিজ রক্ত দিয়ে লিখলে তুমি ভালবাসার গান
তোমার স্মৃতি চিরকাল রবে অক্ষয় ও অম্লান”।

আজ ১০-ই জানুয়ারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এই স্মরনীয় দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথা মহান নেতার প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। ছবি সমূহ সংগৃহীত। সবাই ভাল থাকুন। ধন্যবাদ।

* প্রকৌশলী, ইনস্টিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, ঢাকা, বাংলাদেশের সদস্য, কোয়ালিটি এসুরেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্টে অনার্স সহ স্নাতক (অন্টারিও) এবং একজন সমাজ হৈতষী কর্মী।