Home কলাম নেক্সট : মৌলিক থ্রিলার এবং একজন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

নেক্সট : মৌলিক থ্রিলার এবং একজন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

ফরিদ আহমেদ : বাংলাদেশে থ্রিলার সাহিত্য একটা অবহেলিত অধ্যায়। ভালো মানের মৌলিক বলতে এখানে তেমন কিছু নেই। যা আছে তা মূলত অনুবাদ কিংবা বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে লেখা। মৌলিক থ্রিলার লেখার চর্চাটা নেই বললেই চলে। এর মানে অবশ্য এই না যে থ্রিলারের জনপ্রিয়তা কম, সে কারণে সাহিত্যিকরা থ্রিলার লিখতে চান না। বরং বিষয়টা উল্টো। এই ঘরানার পাঠক চাহিদা বিপুল। পাঠক চাহিদা বিপুল হবার পরেও বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা এই লোভনীয় রাস্তাতে হাঁটেননি, থ্রিলার লেখার চর্চাটা এখানে সেভাবে হয়নি।

চর্চাটা না থাকার পিছনে মূলত দু’টো কারণ রয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়।
প্রথমত: থ্রিলারকে আমাদের সাহিত্যে নিচু চোখে দেখা হয়। কেউ থ্রিলার লেখে কিংবা থ্রিলার পড়ে, এটা শুনলে তাঁর রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটা অভ্যাস আমাদের মধ্যে আছে। ফলে, একটা পর্যায়ে গিয়ে বয়স্ক লোকেরা স্বীকার করতে চায় না যে তাঁরা থ্রিলার পড়ে আনন্দ পান। প্রিয় বইয়ের কথা বলতে গেলে বানিয়ে বানিয়ে চিরায়ত কোনো বইয়ের নাম বলতে হয়, যেটা হয়তো আদৌ পড়াই হয়নি। লেখকদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান। থ্রিলার লেখককে অন্য বুদ্ধিজীবী লেখকরা নিম্ন চোখে দেখে থাকেন। তাঁকে তাঁরা জাতে স্থান দিতে চান না। এই সমস্যাটা আমাদের দেশের প্রথম থ্রিলার লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিদারুণভাবে মোকাবেলা করতে হয়েছে। সাহিত্যিক সমাজে তিনি ব্রাত্য হয়ে থেকেছেন থ্রিলার লেখার অভিযোগে।

দ্বিতীয়ত: থ্রিলার লেখার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা লাগে, সেটা আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে নেই। এটাকে নিম্ন মানের সাহিত্য মনে করা হলেও, লিখতে গেলে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম থ্রিলারের ক্ষেত্রেই করা লাগে। শুধু প্লট নির্বাচন বা লেখার কষ্টই না, একই সঙ্গে লেখককে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, সা¤প্রতিক জ্ঞানের অনেক জায়গাতে পাঠকের চেয়ে অনেকখানি অগ্রগামী থাকতে থাকতে। আমাদের দেশে মৌলিক থ্রিলার লেখাটা শুরু হয়েছিলো কাজী আনোয়ার হোসেনকে দিয়ে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ‘ধ্বংস পাহাড়’ এবং ‘ভারত নাট্যম’ নামের দু’টো স্পাই থ্রিলার লেখেন। ওই দুটো দিয়েই জেমস বন্ডের বাংলাদেশি ভার্সন ‘মাসুদ রানা’-র জন্ম হয়। দু’টো মৌলিক উপন্যাস লেখার পরেই তিনি ক্ষান্ত দেন মৌলিকে। এর পর থেকে বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে মাসুদ রানা-র বই লিখতে থাকেন তিনি। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন, স্পাই থ্রিলার লেখার জন্য ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাগে, দেশে বিদেশে ঘোরা লাগে। এটা বাংলাদেশি লেখকদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের থ্রিলার লিখতে গেলে এর পিছনে প্রচুর সময় দিতে হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একজন লেখকের পক্ষে একটা বইয়ের পিছনে এতোখানি সময় দেওয়া সম্ভব নয়। কাজী আনোয়ার হোসেনের বক্তব্যে সত্যতা রয়েছে। বিদেশে একজন লেখক এক বা দুই বছর সময় নিয়ে একটা থ্রিলার লেখেন। সেটা লিখেই তাঁরা টিকে থাকতে পারেন। বাংলাদেশে এক বা দুই বছরে একটা বই লিখে কোনো পেশাদার লেখকের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

এই কারণেই হয়তো বাংলাদেশে থ্রিলার লেখার জন্য তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বন্ধ্যা থেকে গিয়েছে সাহিত্যের এই জনপ্রিয় অংশটি। অনেক বছর পরে এসে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন সেই জায়গাটাতে আলোড়ন তুলেছেন। একটা কিংবা দু’টো নয়, এর মধ্যেই দশ-বারোটা থ্রিলার উপন্যাস লিখে ফেলেছেন তিনি। শুধু লিখেছেন বললে ভুল হবে, দুই বাংলার বাংলা ভাষী মানুষদের মধ্যে সেগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। দুই বাংলা মিলিয়ে তিনিই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক।

তাঁর বইগুলো পড়লে পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায় লেখকের পড়াশোনার পরিধি ব্যাপক। সেই সাথে সমাজকে দেখার, সমাজের মানুষদের পর্যবেক্ষণ করার সক্ষমতাও প্রচুর। একই সাথে থ্রিলারের পাঠক কী চায়, সেই সম্পর্কেও সম্যক ধারণা তাঁর রয়েছে। তাঁর বইয়ের চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতি পরিচিত চরিত্র। তিনি যে জায়গাগুলোতে ঘটনার সমাবেশ ঘটান সেগুলোও আমাদের খুব চেনাজানার। ফলে, পাঠক যখন বইটা হাতে নেয়, তাঁর কাছে মনে হয় পরিচিত রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সে। সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে পাঠক। বিদেশি থ্রিলার পড়ার ক্ষেত্রে যে রকম অচিন দেশের ঘটনা মনে হয়, এখানে সে রকম লাগে না। এই জায়গাতে কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে বিপুল পার্থক্য তাঁর। কাজী আনোয়ার যেখানে মনে করতেন থ্রিলার লেখার জন্য যে দেশ-বিদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা লাগে, সেখানে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন থ্রিলার লিখতে গিয়ে কাজে লাগিয়েছেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে। নিজের সমাজকে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালো করে চিনি। কাজেই, সেখান থেকে উপাদান নিতে জানলে, অফুরন্ত এক অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পাওয়া যায়। তিনি তাঁর এক সাক্ষাৎকারে এই ধরনের একটা কথাও বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় থ্রিলার লেখা বরং বেশি সহজ। কারণ, আমাদের সমাজে আইন-শৃঙ্খলার শিথিলতার কারণে নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়, যেটা পাশ্চাত্যে বিরল। ফলে, একজন থ্রিলার লেখকের জন্য বইয়ের প্লট চারপাশেই ছড়ানো ছিটানো থাকে। শুধুমাত্র দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়লেই একজন লেখক থ্রিলারের জন্য অসংখ্য প্লট খুঁজে পাবেন বলে তিনি মনে করেন। তাঁর বইগুলো পড়ার পরে আমি আসলে লেখকের সাথে একমত হতে বাধ্য হয়েছি। তিনি আমাদের অনেক পরিচিত ঘটনাকেই তাঁর বইতে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন।

গতকাল পড়ে শেষ করলাম তাঁর লেখা সর্বশেষ উপন্যাস নেক্সট। এটা গত বই মেলাতে প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে থাকি বলে হাতে বই পেতে সময় লাগে। তাঁর বইয়ের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটেছে। পেতে দেরি হয়েছে। তবে, পাওয়ার পরে সামান্যতম কালক্ষেপণ না করে একটানে পড়ে শেষ করে ফেলেছি ওটা।

বইটা সুখপাঠ্য। আর প্রতি পাতায় পাতায় রয়েছে রহস্য আর রোমাঞ্চের হাতছানি। ফলে, প্রথম পাতা পড়েই বড়শিতে আটকে গিয়েছিলাম। এরপর তরতর করে পাতা উল্টে পড়ে গিয়েছি বড়শির টানে। এই বড়শির টানে অবশ্য বেদনা নেই, আছে অপার আনন্দ।
যাঁরা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের বই নিয়মিত পড়েন, তাঁরা জানেন, তাঁর বেগ-বাস্টার্ড নামের একটা সিরিজ আছে। এই সিরিজ ঘোষণা দিয়ে তৈরি হয়নি। এই সিরিজের প্রথম বই ‘নেমেসিস’ বের হবার পরে সেটা এতো জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলো যে লেখক নিজেও আমার মতোই বড়শিতে আটকা পড়ে গিয়েছেন। একের পর এক ওই বইয়ের প্রধান দুই চরিত্র জেফরি বেগ আর বাস্টার্ড বাবলুকে নিয়ে বই লিখে গিয়েছেন। সেগুলোই পাঠকের কাছে বেগ-বাস্টার্ড সিরিজ নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। বেগ বাস্টার্ড সিরিজের ষষ্ঠ এবং সর্বশেষ বই হচ্ছে নেক্সট। আমি নিশ্চিত এই সিরিজে আরও বই লিখতে বাধ্য হবেন লেখক।
জেফরি বেগ এবং বাস্টার্ড বাবলু, দুই বিপরীত ধরনের চরিত্র। একজন আইনের পক্ষের লোক, আরেকজন আইনের বিপক্ষে। একজন ঠাণ্ডা মাথায় খুনি ধরার চেষ্টা করে, আরেকজন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে। একজন হিরো, তো আরেকজন এন্টি হিরো। এর পরেও এই দুজনের মাঝে অদ্ভুত কিছু সাদৃশ্য আছে। দু’জনেই দেবদূতের মতো দেখতে। চেহারায় মিল আছে দু’জনের। দু’জনেরই জন্ম পরিচয় রহস্যে ঢাকা। একজনকে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে মানুষ করেছেন সেইন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফাদার হোবার্ট, আরেকজনকে পথ থেকে তুলে নিয়ে মানুষ কিংবা অমানুষ করেছে খুইন্যা বাবুল, একজন ভয়ংকর পেশাদার খুনি। তবে, খুইন্যা বাবুল যে বাস্টার্ড বাবুলকে খুন করা শিখিয়েছে তা কিন্তু নয়। বরং তাঁকে শিক্ষিত হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলো সে। ইংরেজি মাধ্যমে ভালো স্কুল, কলেজে পড়িয়েছে সে তার পালক ছেলেকে। বাস্টার্ড বাবুলের খুনি হয়ে ওঠাটা হয়েছে নিয়তির কারণে। রূপবান হবার কারণে কিশোর বয়সে এক লোকের লালসার শিকার হতে হয়েছিলো তাকে। সেই লোককে খুন করার মধ্য দিয়ে খুনে হাতেখড়ি হয় তার। তারপর থেকে পরিস্থিতির কারণে একের পর এক খুন করতে হয়েছে। সেগুলো করতে করতেই একদিন আবেগ অনুভূতিহীন এক খুনিতে পরিণত হয়েছে সে। ভয়ংকর খুনি হবার পরেও পাঠকের সহানুভূতি কিন্তু বাস্টার্ড বাবুলই বেশি পায়। এই চরিত্রটাকে অদ্ভুত এক মমতা দিয়ে এঁকেছেন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। এন্টি হিরো হবার পরেও যে কারণে বাস্টার্ড বাবুলের প্রতি ভালবাসায় বেশি সিক্ত হয় পাঠক।

‘নেক্সট’ বইতেও এই দুই চরিত্রের সমাহার ঘটেছে। যদিও বাস্টার্ডের আগমন ঘটেছে বইয়ের এক তৃতীয়াংশ যাবার পরে। কিন্তু, প্লটে আসার পরে সমস্ত মনোযোগ সেই কেড়ে নিয়েছে। এই বইতে জেফরি বেগ এবং বাস্টার্ডের কমন শত্রু ব্লাক রঞ্জুও এসেছে দুর্দান্ত প্রতাপে। এসেছেন অমূল্যবাবুও। ইনি বাস্টার্ডের মেন্টর। আলোর জগত এবং অন্ধকার জগত, দুই জায়গাতেই বিচরণ করেন রহস্যঘেরা আবরণ পরে। অন্য বইতে অমূল্যবাবুকে পাঠক সেভাবে জানতে না পারলেও, এখানে তাঁর চরিত্র বিকশিত হয়েছে বেশ অনেকখানি। আর, পটভূমি হিসাবে এসেছে চিরচেনা সেই ঢাকা শহর।

বইটাতে কিছু টাইপো আছে। যেমন ‘শারীরিক’ শব্দটা একাধিকবার ‘কারীরিক’ হয়ে গিয়েছে। ছোট্ট দু’টো তথ্যগত ভুলও চোখে পড়েছে আমার। দু’টোই ক্যানাডা কেন্দ্রিক। বেগমপাড়া মন্ট্রিয়লে নয়, টরন্টোতে অবস্থিত। এখানেও আসলে নির্দিষ্ট কোনো এলাকা বেগমপাড়া হিসাবে নেই। বাংলাদেশের অবৈধ টাকা পয়সাওয়ালা মানুষদের অনেকেরই স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যরা টরন্টো এবং এর আশেপাশে এলাকাতে বাড়ি কিনে বসবাস করেন। এদেরকে বোঝাতেই আমরা বেগমপাড়া শব্দটা ব্যবহার করি এখানে। দ্বিতীয় যে ভুল, সেটা হচ্ছে এখানকার ইমার্জেন্সি নাম্বার। ওটা ট্রিপল নাইন নয়, নাইন ওয়ান ওয়ান। ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন হলে এই নাম্বারে কল করি আমরা সাহায্যের জন্য।

একই চরিত্র নিয়ে থ্রিলার লেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার আশংকা। এতে করে পাঠক এক সময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন দুর্দান্ত প্লট দিয়ে সেই আশংকাকে একেবারেই উড়িয়ে দেন। আগ্রহ হারানোর বদলে পাঠক বরং দিন দিন এই চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে উঠছে। মাসুদ রানা যেমন কাল্পনিক হয়েও মিশে গিয়েছে আমাদের স্বপ্নের সাথে আমাদের একজন হয়ে, বেগ এবং বাস্টার্ড চরিত্রও সেই রকম দিকেও যাচ্ছেই।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন আমার জন্য মুগ্ধতা জাগানিয়া এক লেখক। থ্রিলারের প্রতি কৈশোর থেকেই আগ্রহ আমার। কিন্তু, বাংলায় যে সমস্ত মৌলিক থ্রিলার লেখা হতো সেগুলো আসলে খুব একটা টানতো না আমাকে। বড্ড বেশি পানসে লাগতো। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এসে সেই পানসে জায়গাটাতে সমস্ত মশল্লা ঢেলে দিয়েছেন পরিমিতভাবে। ফলে, থ্রিলার পাঠ হয়ে উঠেছে দারুণ সুস্বাদু। কাজী আনোয়ার হোসেন যেমন মাসুদ রানার মাধ্যমে আমাদের একটানে নিয়ে যেতেন রহস্য আর রোমাঞ্চের জগতে, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনও তাই করছেন। তাঁর বইয়ে নাক ডোবানো মানেই রহস্য আর রোমাঞ্চের জগতে পা ফেলা। আর একবার পা ফেললে সেখান থেকে সহজে মুক্তি পাবেন না আপনি। প্রবল নেশাময় এক জগত সেটা।

অবশ্য সেই মুক্তির প্রয়োজনও নেই পাঠকের। সব নেশাই খারাপ নেশা না।

Exit mobile version