ইউসুফ কামাল : আমার সরাসরি প্রতিবেশী জ্যাকব। জন্মগতভাবে সে মেক্সিকান, পরিবারের সদস্য সংখ্যা সেসহ চারজন। স্ত্রী লিজা, এক মেয়ে ও এক ছেলে। জ্যাকবের সাথে কথা বলে বুঝেছি অনেক মেক্সিকানদের মতো সে স্বল্প শিক্ষিত, ভালো মতো ইংরেজি বলতে পারে না তবে মোটামুটি কথাবার্তা সবই বুঝতে পারে। ওর স্ত্রী লিজাকে প্রথম দিন দেখে আমার কাছে জ্যাকবের চেয়ে বেশি স্মার্ট ও শিক্ষিত বলে মনে হয়েছিলো।
আর সেই হিসেবেই জ্যাকবকে আমার কাছে কেন যেন সব সময় একটু অনুজ্জ্বল মনে হতো। এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শপিং শেষ করে দাম পরিশোধ করতে কাউন্টারে লিজাকে পেয়েছিলাম ওয়ালমার্টের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় ক্যাশ কাউন্টারে। তখন বুঝেছিলাম এটা লিজার কর্মস্থল। বিস্মিত কন্ঠে জানতে চেয়েছিলাম, এখানে কাজ করো জানতাম না তো? বল্লাম, আমি তো মাঝে মাঝেই এখানে আসি। তুমি এখানে কতদিন ধরে? লিজা বলেছিলো, তা অনেক দিনই তো হবে। এর আগে দু’মাইল দূরের ভিলিয়ার্ড রোডের ওয়ালমার্টে ছিলাম, তিন মাস হলো এখানে চলে এসেছি। আমার বাসার কাছে, সুবিধাই হয়েছে আমার। হেসে বল্লাম, ও তাই হয়তো আমি আগে তোমাকে দেখিনি। বেশি কথা না বাড়িয়ে সে দিন বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম।
ঐদিনের কথাবার্তার পর থেকেই আমাদের পারিবারিক যোগাযোগটা আগের চেয়ে একটু বৃদ্ধি পেয়ে আন্তরিকতার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। পরে একদিন কথাচ্ছলে জেনেছিলাম লিজার মেয়েটাও ওয়ালমার্টের অনলাইন মার্কেটিং এর হোম ডেলিভারির কাজ করে। জ্যাকব আর লিজার মধ্যকার সম্পর্ক আমার কাছে প্রথম দিনই কেন যেন একটু অন্য রকম মনে হয়েছিলো। সব ঠিক আছে তবু যেন কোথায় কিছু একটা নেই, উজ্বল আলোর পাশে ম্রিয়মান অল্প পাওয়ারের একটা বাতির মতোই জ্যাকবকে কেন যেন আমার কাছে মনে হয়েছিলো। সকালের দিকে লিজা তার নিশান মিনি ভ্যানটা নিয়ে কাজে বেড়িয়ে যায়। মেয়ের হোম ডেলিভারীর কাজ থাকলে সে সময় মতো নিজের গাড়ি নিয়ে মাল ডেলিভারী করতে বেরিয়ে যায়। সবাই যার যার সময় মতো কাজে যায় আবার সময় মতো ফিরে আসে যা এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক চিত্র। জ্যাকব নিজে বেশির ভাগ সময় বাসায় থেকেই বন্ধুদের গাড়ির কাজ করে। আবার কখনো টুল বক্সের বড় বক্সটা পিকআপ ভ্যানে তুলে ছেলেকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে যায় ক্লায়েন্টের বাসায় যেয়ে গাড়ির কাজ করার উদ্দেশ্যে লিজাকে প্রথম দিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওয়ালমার্টে কতদিন কাজ করো? লিজা হেসে বলেছিল, জীবনের শুরুতে আমি ডালাসের চেইন শপ ‘টার্গেটে’ কাজ করতাম। সেটা আমার মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় চলে আসার পরের কথা। শুরু তো করেছিলাম ডালাসে সেখান থেকে বাধ্য হয়ে চলে এসেছি হিউষ্টনের কেটি তে।
ডালাসের ‘টার্গেট’টা ছিলো ডাউন টাউনের দিকে, আমাদের তখনকার বাসা থেকে বেশ দূরে। হাইওয়ে ধরে ড্রাইভ করে আসা যাওয়া করতে আমাদের জন্য অনেক সমস্যা হতো, বিশেষ করে নাইট শিফ্ট শেষ করে ফিরে আসার সময়। নাইট শিফ্টের কথা উঠতেই লিজা থেমে গেল আর সাথে সাথে ওর মুখটাও ম্লান হয়ে গেল। বুঝলাম হয়তো কোন বিষাদময় ঘটনা আছে ওর এই হঠাৎ থেমে যাওয়ার পিছনে। বল্লাম, লিজা আমি দুঃখিত তোমার মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য। একটু সামলে নিয়ে লিজা বল্লো, না ঠিক আছে।
জীবনের বাকী কথা পরে বলবো, বলে অহেতুক একটা কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। কয়েকদিন পর ওদের বাসায় বিকেলে চায়ের দাওয়াতে যেয়ে ড্রইংরুমের টেবিলে পড়ে থাকা ওদের পারিবারিক এলবামে চোখ বুলালাম। আর তারপরেই সব কিছু আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেলো। লিজার মেয়ের শিশু বয়সের কিছু অন্তরংগ ছবিতে আমার চোখ আটকে গেলো।
ওর মেয়ের সাথে অপরিচিত এক ব্যাক্তির বেশ কিছু আনন্দঘন ছবি আমার প্রশ্নের কারণ। কে হতে পারে এই মানুষটা? প্রশ্ন করতে সব জানা হয়ে গিয়েছিলো, সব কিছু পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো লিজা’র হঠাৎ করে সেদিনের কথা বলতে বলতে থেমে যাওয়ার মূল কারণ। টেক্সাস থেকে মেক্সিকোতে বেড়াতে যাওয়া আইটি নিয়ে কাজ করা এক টগবগে তরুণ প্রেমে পড়ে যায় মেক্সিক্যান সুন্দরী লিজার আর সেটাই পরিশেষে রুপ নেয় পরিণয়ে। লিজার বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে ওর স্বামী অফিসের নাইট ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরে আসার সময় মদ্যপ এক ড্রাইভারের গাড়ির সাথের সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আহত হয়। পুলিশ রাতে লিজার আহত স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, দু’দিন অজ্ঞান থাকার পর ওর স্বামী মারা যায় । শিশু কন্যা নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পরে লিজা, বছর খানেক একাকী থাকার পরে বন্ধুদের কথা মতোই তখন বিয়ে করে জ্যাকবকে। কাজ পাগল মানুষ জ্যাকব, সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। কখনোই বসে থাকতে পারে না, কিছু না কিছু কাজ তার হাতে থাকতেই হবে। কমমূল্যে আশে পাশের প্রতিবেশীদের গাড়ির অয়েল চেঞ্জ, ব্রেকের কাজ করাসহ ছোট ছোট কাজ করে দেয়। তার কথায় বুঝেছিলাম প্রথমে এটা তার নেশা ছিলো পরে এটা তার পোশাতেই রুপান্তরিত হয়ে গেছে। এ দেশে গাড়ির গ্যারেজে যাওয়া মানেই তো এক কাড়ি টাকা বেরিয়ে যাওয়া, সেটা যে কোন মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য বড় একটা বিড়ম্বনা। তাই অল্প টাকায় এই সমস্ত কাজ করিয়ে নিতে পারলে সবার জন্যেই লাভের। এই যুক্তি সংগত কারণে জ্যাকবের আয়ও নেহায়েৎ মন্দ না। এদেশের কড়া নিয়ম কানুনের মধ্যে প্রত্যেক বাড়ির লনের ঘাস কেটে পরিস্কার রাখা একটা অত্যাবশ্যকীয় কাজ। সময় মতো যার যার বাসার লনের ঘাস না কাটলে কম্যুনিটি অফিস বড় অংকের ফাইন ধার্য্য করে দেয়। এটাই এখানকার নিয়ম, আর এই সমস্যার বড় ত্রাণকর্তা জ্যাকব। আশে পাশের অনেকগুলো বাড়ির মালিককে সেই ফাইন থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার মহান দায়িত্ব জ্যাকব নিজেই নিয়ে নিয়েছে। প্রতিবেশীরা না ডাকলেও সময়মতো সে নিজেই এসে ঘাস কেটে দিয়ে যায়। এটা যেন একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে জ্যাকবের সাথে সবার। ফলে কোন রকম উটকো ঝামেলাতেও বাড়ির মালিকদের পরতে হয় না, আর সেই কারনেও প্রতিবেশীরাও কখনই তার ন্যায্য মজুরী দিতে কার্পণ্য করে না। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, হিউষ্টন, ইউএসএ