ইউসুফ কামাল : চলতে চলতে কখন যে জীবনটা ক্লান্ত হয়ে গেছে এত দিন পর রিয়া’কে সামনে পেয়ে অভি বুঝলো, যতটা আনন্দিত হওয়ার কথা ছিলো ততটা হয়তো হলো না তবে ভালো লাগলো। জীবন যে এত ভারী হবে অভি সেটা কখনো কল্পনাও করেনি।
দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদে সব ভালোবাসা যে মন থেকে হারিয়ে যায় না সেটা নতুন করেই আজ বুঝলো। তবে বাস্তবতা হলো, অভিমানের বরফ মনের মধ্যে যতই জমে থাকুক, কাংখিত পরিবেশে সেটা এক সময় যে গলে যাবে সেটা অভি ভালো করেই জানে।
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে রিয়া’কে বিকেলে অভি ওর সরকারি বাংলোয় চা’য়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে এসেছিলো। দীর্ঘদিন পর রিয়া’কে দেখে অভি নিজে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ায় বেশি কথাও তখন বলতে পারছিলো না পারিপার্শ্বিকতার কারণে।
প্রতুত্তরে রিয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র সম্মতি জানিয়ে অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলো।
অভি’র আমন্ত্রণ গ্রহণ করে রিয়া সারাক্ষণ শুধুই ভেবেছে, না জানি অভি’র ওখানে যেয়ে কোন রকম অস্বস্থিকর পরিস্থিতির মধ্যে পরতে হয় কি না? কে যে কি ভাবে ওকে নেবে সেটাও একটা বিষয়।
বিশেষ করে পরিবারের নতুন সদস্যদের মধ্যে আবার কোন রকম বিব্রতকর অবস্থায় পরতে হয় কি না?
অনুষ্ঠান থেকে জেলা পরিষদের বাংলোয় ফেরার পথে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের কাছ অভি’র কথা শুনে রিয়া বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
অভি’কে ঘিরে হাজারো প্রশ্ন রিয়ার মনের মধ্যে এসে ভীড় করলো।
রিয়া ভাবলো সে নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, কিন্তু অভির জীবনটা এমন হলো কেন? অভি তো নিজে কোন অন্যায় করেনি, তা হলে ওর জীবনটা কেন এমন হলো?
হাতে ধরে কেউ কি নিজের জীবনকে এমনি গন্তব্যহীন করে তোলে? রিয়া’র মনের মধ্যে নতুন প্রশ্ন এসে যোগ হলো, তবে কি ওর জন্যেই অভি তার নিজের জীবনটা এই ভাবে অসম্পূর্ণ করে দিলো?
ঠিক তারই মতো একা হয়ে গেল পৃথিবীতে।
চিন্তা করে রিয়া ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠলো, নিজের পরিবারের সাথে জেদ করে আর সবার মতো অভি’র সাথেও দূরত্ব বজায় রেখে সে এটা কি করে ফেলেছে? এখন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো রিয়া’র।
এ ভাবে সে কতগুলো মানুষকে একদম নি:শেষ করে ফেলেছে, এর থেকে তো তার নিস্কৃতির পাওয়ার কোন উপায় নেই ।
সবাইকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলে রিয়া ওর রুমে যেয়ে শুয়ে পরলো। মাথার উপর চলন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিময় দিনগুলোতে ডুবে গেলো।
কত আগের কথা তবু মনে হলো এ তো সেই অভি। যার সাথে রোজ দুপুরে একবার করে দেখা হতো। কত মধুর ছিলো সেই স্মৃতিগুলো।
দীর্ঘ দুই যুগ পর আজ অভি’কে দেখে রিয়া’র মনে হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় করেছিলো, অভিকে এমন দেখাচ্ছে কেন। ঝক ঝকে একটা তরুণ যে এখনো ওর মানসপটে স্থায়ী আসন দখল করে আছে, তাকে এখন এমন দেখাচ্ছে কেন? তার এই বর্তমান চেহারা তো সে ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করে নাই।
অভিকে দেখে রিয়ার মনে হলো অগোছালোভাবে চলাফেরা করা একটা মানুষ যার আশেপাশে কেউ নেই। শুধুমাত্র কিছু রুটিন মাফিক কাজ করে যাওয়া দম দেওয়া একটা পুতুল।
রিয়া মনে মনে নতুন করে হিসেব করতে বসলো, এর মধ্যে এতগুলো বছর কেমন করে চলে গেলো?
আজ অভি’কে দেখার পর রিয়া’র মধ্যে নতুন একটা চিন্তা ভর করলো, যাদের উপর অভিমান করে সে ঘর ছেড়েছিলো তারা তো অনেক আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু এখনো তো কেউ না কেউ ধুকে ধুকে জীবন পার করছে।
গভীর অনুশোচনায় রিয়া’র দুই চোখ ভরে গেলো নোনা জ্বলে।
নিজেকে একজন চরম স্বার্থবাদী মানুষ মনে হলো ওর। কেন সে এমন একটা কাজ করতে গেলো? আজ নিজের উপর ধিক্কার জানালো, কেন এমন একটা কাজ সে করেছিলো? কেন কারো সাথেই সে যোগাযোগ করেনি?
চোখ বন্ধ করে ভাবতে যেয়ে রিয়া’র চোখ দুইটা একটু লেগে এসেছিলো, সারাদিনের পরিশ্রমে বলতে গেলে ঘুমিয়েই পরেছিলো। দরোজায় নক করার শব্দে উঠে বসলো।
ঘড়ি দেখলো বিকেল পাঁচটা।
আস্তে উঠে দরোজা খুলে দিলো।
ডাক বাংলোর দারোয়ান। বল্লো, বড় সাহেব গাড়ী পাঠিয়েছেন আপনার জন্যে, নীচে আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে।
রিয়া ধীর পায়ে গাড়ীর কাছে আসতেই ড্রাইভার দরোজা খুলে দিলো। রিয়া এখানে আসার আগে কল্পনাও করেনি এমন একটা পরিস্তিতির মুখোমুখি তাকে হতে হবে।
গাড়ী বাসার গেটে যেতেই ভিতর থেকে গেট খুলে গেলো, গাড়ী বারান্দায় গাড়ী থামতেই ড্রাইভার নেমে এসে গাড়ীর দরোজা খুলে দিলো।
রিয়া নামতেই দেখলো সামনে অভি, মৃদু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। অভি’কে এখন সকালের থেকে অনেক খানি ফ্রেশ মনে হলো রিয়া’র কাছে।
সেই সাথে প্রাণবন্ত একটা হাসি রিয়া’র মনকে তৃপ্তিতে ভরিয়ে দিলো।
অভি হেসে হাত ইশারা করে রিয়া’কে বল্লো, ভিতরে আসো। (চলবে)
ডেল সিটি ভার্জিনিয়া, ইউএসএ