ইউসুফ কামাল : ধীরে ধীরে অভি’র জীবনের ধারাটাই বদলে গেছে, সারা দিনের রুটিনটাও বদলে গেছে। দেখাশোনা করার কাজের মানুষ আর বাবুর্চির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পরেছে ওর দৈনন্দিন জীবন যাত্রা। নারী বিবর্জিত সংসারে কেমন যেন সর্বত্র রুক্ষতার ছাপ যা ওর নিজের চেহারার মধ্যেও ফুটে উঠেছে।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ না হলেও একাকী বাস করার কারণে, অভি পুরোপুরি একাই হয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু বেশি খারাপ লাগতো কাজে মন বসতো না, পরে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে ভুলে থাকতো সব কিছু। বলতে গেলে সব কিছু ভুলে থাকার জন্যেই ইচ্ছা করে বেশি কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো।
পরের দিকে অতীত জীবনের কথা সহজে আর মনে হতো না। ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ একাকী একটা মানুষে পরিবর্তিত হয়ে গেছে অভি। সম্পূর্ণ একা একটা মানুষ।
চাকরীর পাঁচ বছর পর অভি ওর মা’কে হারালো, আর তার পর বাড়ি যাওয়ার আগ্রহই পুরোপুরি হারিয়ে ফেল্লো। মাঝে মধ্যে ছোট বোন বাড়ি থেকে চিঠি লিখে খবর বার্তাদি নেয়, ব্যাস এই পর্যন্তই ওর বাড়ির সাথে যোগাযোগ। অভি মাঝে মাাঝে ভাবে জীবনে কোথাও যেন একটা ছন্দপতন হয়ে গেছে।
এমনি করেই আরো কয়েক বছর পার হয়ে গেছে, রিয়া’র কথা আর সহজে অভি’র মনে পড়ে না। হয়তো সেটা দু’জনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার কারণে অথবা প্রচন্ড অভিমানের কারণে। আর তার থেকে এক ধরনের অবিশ্বাস আর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে অভি’র মনের মধ্যে।
রিয়া নিজে থেকেই বিশ্বাসের বাণী শুনিয়েছিলো বলা যায় ভালোবাসা’র হাতে খড়িই হয়েছিলো অভি’র মধ্যে। “কাউকে ভালোবাসলে তার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে হয়” – রিয়া’র এ কথা অভি কখনই অস্বীকার করেনি, বরং সমস্ত ব্যাপারটা তো সে রিয়া’র কাছ থেকেই শিখেছে।
ভালোবাসার পিছনে সর্বতোভাবে যে জিনিষটা কাজ করে, সেটা হলো দুজনের পারস্পরিক আত্মবিশ্বাস। সেই রিয়া নিজেই কিনা বিশ্বাস ভংগের মতো এমন একটা কাজ করতে পারলো অভি’র সাথে! যেটা এখনও অভি’র বিশ্বাস হতে চায় না।
সময়ে আবর্তে অভি নিজে এখন পুরো দস্তুর সরকারি আমলা হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে তাকে এখন প্রধান ব্যাক্তি হিসাবে হাজির হতে হয়। সভাপতিত্বের দায়িত্ব নিয়ে সরকারি বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ প্রদান করতে হয়।
এর মধ্যেই হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে গেলো মহকুমা সদর হাসপাতালে ‘মাদার অব নার্সিং’ এর প্রধান মহিয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে। এমন একটা ঘটনা ঘটবে সেটা অভি কল্পনাও করতে পারেনি।
ঢাকা থেকে আগত কেন্দ্রীয় কমিটির অতিথির নামটা মাইকে শুনে অভি প্রথমে বুঝতে পারেনি, কারণ রিয়া’র পুরো নামটা কখনোইও জানতো না। শুধু রিয়ার ডাক নামটাই আর সবার মতো সেও জানতো।
কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ অতিথির আসনের ব্যাবস্থাটা অনুষ্ঠানের সভাপতির চেয়ারের পাশে করা হয়েছে। বিশেষ অতিথির বসার সময় অভি দেখলো রিয়া এসে তার পাশের চেয়ারে বসেছে। বয়সের কারণে স্বাস্থ্যের পরিবর্তন হয়েছে, চোখে চশমা উঠেছে। যতই চেহারার পরিবর্তন হোক, রিয়া’কে সামনা সামনি দেখে প্রথমে বিষয়টা অভি’র বিশ্বাসই হচ্ছিলো না।
রিয়া’ও নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতে যেয়ে অভি’কে দেখে হঠাৎ করেই চমকে উঠলো। খানিকটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো অভি’র দিকে।
কত দিন অভি’কে দেখেনি রিয়া, ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠলো।
চেয়ারে বসে ভালো করে লক্ষ্য করলো।
এ কি চেহারা হয়ে গেছে অভি’র। বয়সের ছাপ পরিস্কার ফুটে ওর উঠেছে চেহারার মধ্যে।
কেন যেন মনে হলো যত্নের অভাবে মানুষটা বেশি বয়স্ক হয়ে পড়েছে।
কিন্তু তাই বা হবে কেন? ওর তো পরিবার-পরিজনসহ ভালো থাকার কথা।
অভি’র মাথার বেশির ভাগ চুলে পাক ধরেছে, চোখে মোটা চশমা। একটু তাকিয়ে থেকে রিয়া চোখ নামিয়ে নিলো।
বেশিক্ষণ দেখতে পারলো না, চোখের ভিতরে কেমন যেন জ্বালা করে উঠলো রিয়া’র। অভি’র দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ শুন্যে তাকিয়ে রইলো, বুকের ভিতরে তখন বয়ে চলেছে সাহারা মরুর উদ্দাম ঝড়।
কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু মনে হচ্ছে বুকের ভিতরটা দুমরে মুছড়ে ভেংগে যাচ্ছে।
মনে হলো, এই কি সেই যুদ্ধের সময়ের অভি? যাকে একদিন না দেখলে বুকের কষ্টটা বেড়ে যেত। রোজ দুপুরে এক ঘন্টা দেখা হতেই হতো। এর কোন ব্যাতিক্রম হতো না।
রিয়া’র এই হঠাৎ উপস্থিতি অভি’কে ঝড়ে পড়া পাখীর মতো বিদ্ধস্ত করে দিয়েছে। ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা অনুভব করছে, দ্বিতীয় বার তাকাতেই দেখলো রিয়াও ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
অভি অস্ফুট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো রিয়া? কত দিন পরে বলো তো!
রিয়া সেই একই ভাবে অভি’র দিকে তাকিয়ে আছে, চোখগুলো ভারী হয়ে উঠলো ওর। রুমাল বের করে মুখের সাথে চোখগুলোও মুছে নিলো।
মৃদু কন্ঠে বল্লো, ভালো নেই। জীবনের পথ যে এত শক্ত আগে বুঝিনি।
অভি বল্লো, অনুষ্ঠান শেষে আমার সাথে দেখা না করে যেও না।
রিয়া ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বল্লো, আচ্ছা। (চলবে)
ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ