ইউসুফ কামাল : অভি পরদিন বিকেলের পর একটু দেরী করেই বাড়ি থেকে বের হলো। রিয়া’র সাথে দেখা করতে হবে, গতকালই তো চিঠি দিয়ে দেখা করতে বলেছে। একবার ভেবেছিলো দুএক দিন পরে যাবো কিন্তু সামনের সপ্তাহেই তো আবার ঢাকা যেতে হবে, ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে। বাড়িতে আসবার সময় যদিও হলে সিট এর ব্যাবস্থা করে এসেছে এখন যেয়ে শুধু নীলক্ষেত থেকে বিছানা বালিশ কিনে নিতে হবে। তাই দু’দিন আগেই যাওয়া দরকার। অভি ইচ্ছে করেই রিয়ার বাড়ির গেট থেকে একটু আগে রিক্সা ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির গেটের দিকে রওনা হলো। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। গেটের পাশে ছোট ছোট কয়েকটা কাঁঠাল গাছ আর কোনার দিকে বড় একটা লিচু গাছ। লিচু গাছটার নীচে অন্ধকারটা একটু বেশি, অভি ও দিকে এগোতেই একটা মানুষের মতো কাউকে যেন নড়াচড়া করতে দেখলো। অভির যা বোঝার বুঝে ফেল্লো, জায়গাটা বেশ নিরিবিল। একটু দূরের রাস্তা দিয়ে টুং টাং শব্দ করে দু’ একটা রিক্সা চলাচল করছে। ধীর পায়ে অভি গাছের কাছে যেতেই অন্ধকার থেকে রিয়া বেরিয়ে এলো। অভির হাত ধরে নিজের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে টেনে নিলো। বল্লো, ভয় পাওনি তো? অনেকক্ষন তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। সত্যি বলতে কি অভি’র মধ্যে ভয় করছিলো না, তবে রিয়ার ঐ ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময় থেকেই এক ধরনের অস্বস্তি বোধ ওর মধ্যে কাজ করছিলো।
রিয়ার এই আচরণে অভি একটু বিস্মিতই হয়েছিলো। রিয়ার সাথে তো এই ধরনের কোন সম্পর্ক হয়নি অভির তাহলে আজ শান্ত শিষ্ট এই মেয়েটার এত খানি অগ্রসর হওয়ার কারণ কি? ভাবলো নিশ্চয়ইও আজ বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে পরেছে। প্রায় আট মাস পর দেখা তাই হয়তো স্বাভাবিক কারণেই এমনটা হয়েছে। অভি বল্লো, না ভয় পাইনি তবে এভাবে কোন দিন কারো সাথে দেখা করিনি তো তাই একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করছে। তবে কথা দিচ্ছি আগামীতে আর ভয় করবে না, বলেই হেসে উঠলো। তবে ভয় লাগছে, তোমার আম্মা যদি দেখে ফেলেন তা হলে তো সর্বনাশ। অভির কথায় রিয়া হেসে বল্লো, তোমার ভয় নেই আম্মা নানীর বাড়িতে গেছেন আজ সকালে, কাল আসবেন। সত্যিই অভির একটু ভয় ভয় করছিলো, কেউ যদি দেখে ফেলে তবে ওর মা বাড়িতে না থাকার কথায় দু:শ্চিন্তা মুক্ত হলো।
রিয়ার কন্ঠে অভিযোগের সুর কত দিন হয়ে গেলো তোমার কোন খোঁজ খবর নাই, আমার কথা কি একবারও তোমার মনে পড়েনি? কখন ঢাকা যাও কখন আসো কিছুই তো জানতে পারি না, আমার কেমন লাগে সেটা তুমি বোঝো না।
বুঝলে অন্তত মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেতে, যোগাযোগটা রাখলে তবু তো বুঝতাম। আমারও ভালো লাগতো। অভির ভিতরে শুরু থেকেই একটু আড়ষ্টতা কাজ করছিলো, রিয়া সম্ভবত সেটা বুঝতে পেরেছে। বল্লো, চলো এখান থেকে বেরোই। সামনের দিকে একটা পায়ে চলা রাস্তা আছে নিরিবিলি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে, ওদিকে গেলে তোমারও ভালো লাগবে। রিয়া তখনও অভির হাতটা ধর রেখেছে, ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অভি একটু সহজ হয়ে এলো। খোলা পরিবেশে ওর অস্বস্তি বোধটা যেন কিছুটা কেটে গেলো। মাথা ধরা ভাবটাও আস্তে আস্তে ছেড়ে যেতে শুরু করলো। রিয়া বল্লো, এখন থেকে ঢাকা থেকে এলেই কিন্তু যোগোযোগ করবে, না করলে আমি কিন্তু কিছু একটা ঘটিয়ে বসবো। তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না, আগেই বলে রাখলাম। রিয়ার কথায় অভি’র মনে হলো ওর মধ্যে কিছুটা অধিকার বোধ চলে এসেছে। হেসে অভি বল্লো, ঠিক আছে এতো দু:শ্চিন্তা করার দরকার নেই। আমি তো আর হারিয়ে যাচ্ছি না। রিয়া অভির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করলো, হয়তো অভির কথার মধ্যে কিছু একটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করলো। অভি আলোচনার প্রসংগ পরিবর্তন করে বল্লো, রিয়া তোমার পরীক্ষা যেন কবে শুরু হবে? রিয়া বল্লো, মার্চ মাসের চার তারিখ থেকে পরীক্ষা শুরু তার মানে মধ্যে আছে আর মাত্র দুই মাস, পড়াশোনা ঠিক মতো করছো তো! অভির কথায় রিয়া ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
একটা লম্বা সময় পর রিয়ার সাথে দেখা হওয়ার পর ওর কথা বার্তা কিছুটা অন্য রকম লাগলো অভির কাছে, মনে হলো ইতিমধ্যে ওর বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেক খানি। এখন অনেক কিছু বোঝে, নিজের ভালো মন্দের হিসেবটাও মনে হলো ভালোই শিখে গেছে। কিছু যেন বলতে চায়, যুদ্ধের সময়ে দেখা হওয়া সেই রিয়ার সাথে এই রিয়ার যেন অনেক খানি পার্থক্য। রিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অভি রিক্সা নিলো। ভাবলো বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষন গল্প করলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। আর এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি যেয়েই বা কি করবে। অনেক দিন পর রিয়ার সাথে দেখা হবে অভি’র মনের ভিতর একটা চঞ্চলতা কাজ করছিলো। হাত ধরে রিয়া নিজের কাছে টেনে নেওয়ায় অভি প্রথমে বেশ আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিলো। পরে বুঝলো রিয়া আবেগের বশেই এটা করে ফেলেছে। থতমত হয়ে রিয়া তাড়াতাড়ি অভি’র হাতটা ছেড়ে দিলো। আর অভির সংযত হয়ে যাওয়াটা রিয়া বুঝে ফেলে নিজেও যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে অভির বেশ ভালোই লাগলো। বন্ধুদের ভিতরেও দু’এক জন এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, কথা বলে ঠিক হলো দুই দিন পরে সবাই এক সাথে ঢাকা যাবে।
ঢাকা যেয়ে নতুন পরিবেশে ক্লাসের নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়ে সবার সাথে মানিয়ে নিতে অভির বেশ ভালোই লাগছিলো। নতুন পরিবেশ আর নতুন বন্ধুদের সাহচর্যে রিয়ার কথা সারাদিন মনে না পড়লেও রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসার আগে মানুষটার কথা ঠিকই মনে পড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন অঞ্চলের বন্ধু পাওয়া যায়। ভিন্ন ভিন্ন মন মানসিকতার বন্ধুদের মধ্যে থেকে মুষ্টিমেয় কয়েক জনই মনের কাছাকাছি উঠে আসে, তাছাড়া চারিত্রিক কিছু মিল না থাকলে আবার সহজে বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে না। অভি নতুন শহরের নতুন অতিথি, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আগে কখনোই একা থাকেনি তাই সেই দিকটাও মেনে তাকে অভ্যস্ত হতে একটু সময় লাগছে। ক্লাস, টিএসসি, বিকেলে নিউমার্কেটে আড্ডা দেওয়াসহ নতুন বন্ধুদের নিয়ে অভির সময়টা ভালোই কেটে যাচ্ছে।
পরিবারের অনুশাসনের বাইরে নতুন স্বাধীনতার স্বাদই ভিন্নতর, মুক্ত পাখীর মতো সারাক্ষনই উড়ে বেড়ানো কার না ভালো লাগে? (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ