ইউসুফ কামাল : সেদিনের পরে বারবারা’র সাথে মুখামুখি দেখা হয়নি কয়েকদিন। আমি মেরিল্যান্ড আলেকজেন্দ্রিয়া উডব্রীজ ঘুরলাম দুই সপ্তাহের মতো, আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাত হলো। অনেকের সাথে দীর্ঘ দিন আগে দেশ ছাড়ার পর দেখা হওয়াতে সবাই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লো।

অনেকের চোখে আনন্দাশ্রুও দেখলাম, মমত্ববোধ মনে হয় এমনিই হয়। এর মধ্যে একদিন রাতে আলেকজেন্দ্রিয়ার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে বের হতেই দেখি বাইরে তুষার পাত শুরু হয়ে গেছে। জীবনে প্রথম তুষার পাতের দৃশ্য আমার জন্য এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। চারিদিক সাদা আর সাদা, আমি যেন এক শ্বেত শুভ্র রাজ্যে চলে এসেছি। বরফের নীচে সারা শহরের রাস্তা ঘাট তলিয়ে গেছে, সমস্ত বাড়ীর ছাদ ঢালু বলে রক্ষা, সমান হলে বরফের ভারে আমেরিকার সব বাড়ীঘর নির্ঘাত ভেংগে পড়তো। বরফের উপর দিয়ে মৃদু শব্দ করে আস্তে আস্তে আমাদের এসইউভি গাড়ীটা এগিয়ে চলছে। ছোট রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠতেই দেখলাম বরফ সরানোর ট্রাক, রাস্তা থেকে বরফ সরিয়ে যানবাহন চলাচলের ব্যাবস্থা করছে। আবার ঐ ট্রাকের পিছনে অন্য ট্রাক দিয়ে রাস্তায় লবন ছিটিয়ে যাচ্ছে যাতে রাস্তায় বরফ না জমাতে পারে, সব বরফ যেন পানি হয়ে যায়। এ যেন এক মহাযজ্ঞ ব্যাপার, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে মানুষের বেঁচে থাকার চেষ্টা। আবহাওয়া বিভাগ আগাম বার্তা দিয়ে মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছিলো, রাত দশ’টায় তুষার পাত হবে, ঠিক সময় মতোই তুষারপাত শুরু হয়েছে। সব যেন ঘড়ির কাটা মেপে চলে এদেশে। বুঝলাম এরা মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে না, যার কারণে জনসাধারণ সঠিক সময়েই নিজেকে সুরক্ষিত করে ফেলতে পারে যাতে অহেতুক সমস্যায় না পরতে হয়। দশ বারো দিন পর সকালের দিকে হাঁটতে বেরিয়েই বারবারা’র সাথে দেখা, বাসার সামনে দিয়ে বেশ ধীর গতিতে হেঁটে আসছেন। গায়ে লম্বা ভারী একটা কোট, গলায় লাল রংয়ের উলের স্কার্ফ মাথার উপর দিয়ে শক্ত করে পেচিয়ে নিয়েছেন শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। স্কার্ফটা ফর্সা মানুষটাকে বেশ মানিয়েছে। মনে হলো হাঁটা শেষ করে ফিরছেন, হাতে ধরা চেনের শেষ মাথার কুকুরটাও একই গতিতে হেঁটে আসছে।

দেখে বুঝতে বাকী থাকলো না কুকুরটা যেন ওর মনিবকে ছেড়ে আগে যেতে চাইছে না। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ডান হাতের ইশারায় ডাকলেন। এ কয় দিনের পর আজ দেখে বেশ দুর্বল মনে হলো কাছে যেতেই বল্লেন, কয়েকদিন বেড়ালেন মনে হয়? দেখলাম না আপনাদেরকে? বল্লাম, এই কয়েকদিন কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের সাথে একটু দেখা সাক্ষাত করলাম। ওদের সাথে দেখা করাটা জরুরী ছিলো, দেশে ফিরলে সবাই জিজ্ঞাস করবে কে কেমন আছে? বল্লেন, শীত কেমন লাগছে? বল্লাম, মন্দ না! বলতে পারেন বরং উপভোগই করছি। বারবারা হেসে বল্লেন, সাবধান আবার ঠান্ডা লগিয়ে বসবেন না যেন! জামার নীচে একটা থারমাল পড়ে নিবেন তাহলে দেখবেন বেশ আরাম লাগবে। থারমাল না থাকলে একটা কিনে নেবেন, আপনার মেয়েকে বল্লে ও বুঝবে। এ দেশে বয়স্ক মানুষের জন্য এটা খুবই প্রয়োজনীয় মনে রাখবেন। বল্লেন, কোথাও যাওয়ার প্রোগ্রাম না থাকলে চলুন আমার বাসার বারান্দার একটু বসে কফি খাই। ঠান্ডার মধ্যে কফি খেলে ভালো লাগবে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে মনে হয় বারবারা খুশিই হলেন, মৃদু হেসে আমন্ত্রণ জানালেন। বারান্দার চেয়ারে বসতে দিয়ে বারবারা বল্লেন, কফির পানি কেটলিতে দিয়েই আমি রোজ সকালে হাঁটতে বেরোই যাতে কফি বানাতে অহেতুক দেরী না হয়। বেশী গরম হলে কেটলি আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে।

আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি কফি নিয়ে আসছি, দেরী হবে না। বলে কুকুরটাকে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।

মিনিট তিনেকের মধ্যে হাতে কফির মগ আর কয়েকটা কুকি প্লেটে নিয়ে এসে পাশের চেয়ারে বসলেন। দেখলাম ভারী কোটটা খুলে ঘরে গায়ে দেবার উপযোগী একটা সোয়েটার পরে নিয়েছেন। গরম কফি মুখে দিতেই শরীরটা বেশ চাংগা হয়ে উঠলো। বল্লাম, বাহ্ আপনি তো ভালো কফি তৈরী করতে পারেন। বারবারা হেসে একটা ধন্যবাদ জানালো।

বল্লেন, এই জিনিষটা আপনি বরাবরই খুব ভালোভাবে করতে পারেন। হেসে বল্লাম, কোন জিনিষটা? বারবারা মৃদু হেসে বল্লেন, এই যে কাউকে খুশী করার বিদ্যাটা বেশ ভালো মতোই রপ্ত করেছেন। এখন দেখছি আপনি তো ডেল কার্নেগীর যোগ্যতম শিষ্য। হেসে বল্লাম, ভালো কে ভালো না বলা কি অন্যায় নয়? বারবারা জোরে হেসে বল্লেন, আপনার সাথে কথায় আমি পারবো না। আপনার মেয়ের মতো আপনিও ভালো মানুষ, এমন মানুষ আমি পছন্দ করি। আমার স্বামী জোসেফও প্রচন্ড দিলখোলা মানুষ ছিলো, বড় মনের মানুষ ছিলো বলেই ওর ওমন অবস্থাতেও আমি ওঁকে বিয়ে করেছিলাম। আর এই কারণে জোসেফ আমার উপরে অনেক কৃতজ্ঞও ছিলো। মাঝে মাঝেই বলতো, আমি মনে হয় তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম। এই ব্যাপারে ওর মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতো, সব কিছু মিলে শেষের দিকে ও কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো। ওর স্থাবর অস্থাবর সব কিছু আমাকে উইল করে দিয়ে গিয়েছিলো, আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। বলতো, একা কি করে থাকবে তুমি? ও জানতো এ দেশে সন্তানেরা বৃদ্ধ বয়সে পিতা মাতাদের বোঝা টানতে চায় না। তাই বয়স্করা সবাই সিনিয়র হোমে চলে যায়। জোসেফ বলতো, আমার চলে যাবার পর তোমার যাতে কোন অসুবিধা না হয়। তাই সব কিছু তোমাকে দিয়ে গেলাম। তোমাকে যেন কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে হয়। আমি স্থবির হয়ে বারবরার জীবনের দু:খময় অংশটুকু শুনছিলাম। বারবরা বল্লো, বাবার সংসারে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছিলাম আর এখন জোসেফের অর্থ সম্পত্তি আর আমার পেনশনের টাকা মিলিয়ে এত সম্পদ আর অর্থ আমার হাতে মাঝে মাঝে মনে হয়, অভাব বোধ থাকাটাই হয়তো ভালো। জোসেফ আমার ঘাড়ে যেন অর্থের একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গেছে অজান্তেই। বারবারা ইন্ডিয়ানা ষ্টেটের অধিবাসী, ওর মা এর মৃত্যুর পর ওর বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। সব মিলিয়ে ওর ভাই বোনের সংখ্যা ছিলো নয় জন। এত বড় পরিবারের সব সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মিটানো বাবার একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ছেলেবেলা থেকেই বিচক্ষন বারবারা তাই হায়ার স্কুল শেষ করে সেনাবাহিনীর মেডিকেল বিভাগের চাকরিতে যোগ দিয়ে নার্স হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন। ট্রেনিং জীবন শেষ করে ভিয়েতনামের যুদ্ধকালীন হাসপাতালে যোগ দেন। আর সেই হাসপাতালেই মাইন বিস্ফোরণে ভীষণভাবে আহত জোসেফের সাথে পরিচয় হয় বারবারার। প্রচন্ড উদ্যোমী সুদর্শন যুবক জোসেফের এক পা কেটে ফেলার পর সে মানসিকভাবে ভেংগে পড়েন। হতাশাগ্রস্থ অবস্থা থেকে বারবারার একনিষ্ঠ সেবায় জোসেফ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, জেরিকো, নিউইয়র্ক, ইউএসএ