ইউসুফ কামাল : আমার প্রথম আমেরিকা যাত্রার বাহন ছিল ‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ’। ঢাকা-লন্ডন হিথ্রো-ওয়াশিংটন ডুলাস। ঢাকা থেকে নয় ঘন্টায় লন্ডন হিথ্রো তারপর ওখান থেকে সাত ঘন্টায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকার মাটি স্পর্শ করতে ওয়াশিংটন ড্যুলাস এয়ারপোর্টে নামতে হতো। তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বাংলাদেশে তাদের ব্যাবসা পরিচালিত করতো। এরপর বহুবার আমেরিকায় যাওয়া আসা করেছি, আমার কাছে এখনও মনে হয় ওটাই ছিলো দেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার সবচেয়ে কম কষ্টের ভ্রমণ। প্রথম আমেরিকার মাটিতে পা রেখেই বুঝলাম আবহাওয়া পুরোপুরি আমার দেশের বিপরীত। তারপরও এতো শীতকে কেমন করে মানুষ মানিয়ে নিয়েছে? বাস্তবতা হলো এই প্রচন্ড শীতকেও মানুষ জয় করে ফেলেছে। শীতের জন্য কেউ ঘরে বসে থাকে না, সর্বত্রই হীটারের ব্যাবস্থা। ঘরে, গাড়িতে, অফিস, দোকান, মল সর্বত্রই হিটিং এর ব্যবস্থা যাতে শীতে কোন কিছু বন্ধ না থাকে। রওয়ানা হওয়ার আগেই আমার মেয়ে ফোনে বলে দিয়েছিলো, প্রচন্ড শীত পড়েছে। মাঝে মাঝে বরফও পড়ছে, জরুরী কিছু শীতের কাপড় নিয়ে এসো আর বাকীটা এখানে আসবার পর পছন্দ মতো কিনে নেওয়া যাবে।
জীবনের প্রথম লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে আসা, বোর্ডিং ব্রীজ দিয়ে টার্মিনাল বিল্ডিং এ নেমে ভাবলাম কোন দিকে যাবো, কি করা যায়! বেশী চিন্তা না করে লোকজনকে অনুসরণ করে হাঁটা শুরু করে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেখি মূল টার্মিনাল ভবনে যাবার জন্য সবাই লাইনে চেকিং এর জন্য দাঁড়িয়ে গেল, আমিও তাদের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। সবার মতোই হ্যান্ড লাগেজ, জুতা, বেল্ট, মানিব্যাগ, ঘড়ি খুলে স্ক্যানিং বেল্টের ট্রে তে দিয়ে নিজে চেকিং এর গেটে দাঁড়ালাম। চেকিং শেষে স্ক্যানিং হয়ে যাওয়া জিনিষপত্র ট্রে থেকে নিয়ে আবার পড়ে ফেল্লাম। হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম এখন কি করি? মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে, বেশী দেরী হয়ে গেলে কানেকটিং ফ্লাইটটা যদি মিস করে ফেলি তা হলে তো সর্বনাশ। আশেপাশে তাকালাম জিজ্ঞাস করার মতো কাউকে পাওয়া যায় নকি? এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা পর্যায়ের একজনকে পেয়েও গেলাম, দেখে ব্রিটিশই মনে হলো। বোর্ডিং পাশ হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে যেয়ে জানতে চাইলাম, ওয়াশিংটন ডুলাস এর বিমান কোন গেটে? কোন দিকে যাবো? ভদ্রলোক আমার অসহায়ত্ব অবস্থা দেখে যা বোঝার বুঝে ফেল্লেন, বোর্ডিং পাশ দেখে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন কি করতে হবে। টিভি স্ক্রীনে ফ্লাইট নম্বর গন্তব্যস্থল অনুসরণ করতে বল্লেন। কতক্ষন পর পর চেক করলেই পেয়ে যাবেন, ফ্লাইট নাম্বারটা মনে রাখবেন। দেখলাম অনেক টিভি কিছুটা পর পর, যাত্রীরা সবাই টিভির সামনে দাঁড়িয়ে তাদের গন্তব্য, স্থান, সময় ও গেট নম্বর মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে। ভদ্রলোকের নির্দেশ মতো হাঁটা শুরু করলাম, বেশ খানিকটা পথ হাঁটার পর টিভি চেক করে বোর্ডিংয়ের গেট নং ও পেয়েও গেলাম। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, একটা বিরাট দুশ্চিন্তা যেন মাথা থেকে নেমে গেলো। মনে মনে ঐ বিদেশী ভদ্রলোককে আবারও অনেক ধন্যবাদ জানালাম।
ঘন্টা তিনেক ট্রানজিট পিরিয়ড পার করে আবার বিমানে চড়ে বসলাম আমেরিকার উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য করলাম এই পারের বিমানটি গতবারের বিমানের চেয়ে বেশ বড় আকৃতির, আর এদের দেওয়া খাদ্য ও সেবার মানও অনেক উন্নত। এশিয়ান আর ইউরোপীয়ান যাত্রীদের মূল্যায়ন ওদের কাছে যে ভিন্নতর সেটা পরিস্কার বুঝে ফেল্লাম। আমেরিকাগামী এবারের বিমানে বাঙ্গালী চেহারার যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম, মাত্র অল্প কয়েকজন ভারতীয় যাত্রীও দেখলাম। দীর্ঘ সাত ঘন্টায় নির্বিঘ্নে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকার মাটি স্পর্শ করলো ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের বোয়িং। ইমিগ্রেশনে পাসপোর্টে সিল চাপ্পর শেষে লাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ ট্রলিতে তুলে রওয়ানা দিলাম বের হওয়ার জন্যে। সামনেই কাষ্টমস্ চেকিং। কাষ্টমসের নরম্যাল জিজ্ঞাসাবাদ সেরে বাইরে বের হওয়ার গেট পার হতেই দেখি বড় একটা হল ঘর লোকে পরিপূর্ণ। বুঝলাম সবাই অপেক্ষা করছে তাদের আপন জনের জন্য।
সবার চোখ যাত্রীদের বের হয়ে আসার গেটের দিকে। যারা বের হয়ে আসছে, আপনজনের দেখা পেয়ে তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে আলোর ছটা। পরিস্কার দেখা যাচ্ছে আপন জনের সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তগুলো কতো আবেগ ও প্রাণবন্ত। এ যেন এক মিলন স্থল। এই তীব্র শীতের মধ্যেও যার কোন রকম ব্যাত্যয় ঘটেনি। আমি গেট দিয়ে বের হতেই আমার মেয়ে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। হাতে ধরা ভারী জ্যাকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে বল্লো, তোমার কোটের উপরে এটা গায়ে দিয়ে নাও। বাইরে অনেক ঠান্ডা, কথা না বাড়িয়ে ওটা গায়ে দিয়ে ফেল্লাম অতি দ্রুততার সাথে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা শুরু, টার্মিনালের পার্কিং থেকে মেয়ে জামাই ওদের হোন্ডা ওডিসি গাড়ীটা এনে তাড়াতাড়ি লাগেজগুলো গাড়িতে তুলে রওনা দিলো বাড়ীর দিকে। গাড়ী চলতে শুরু করে দিলো। গাড়ীর হিটারের কল্যাণে ধীরে ধীরে গাড়ীর ভিতরের শীতের উপস্থিতি কমতে শুরু করে দিয়েছে, তখন আর মনে হলো না বাইরে মাইনাস লেভেলের শীত চলছে। জীবনের প্রথম আমার আমেরিকায় আসা, আশে পাশের বাড়ীঘর রাস্তা সব যেন ছবির মতো মনে হতে লাগলো। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চারিদিক, হাজার হাজার গাড়ী কিন্তু নেই কোন শব্দ বা হর্নের আওয়াজ। সব গাড়ী আলো জ্বালিয়ে ছুটে চলেছে যার যার গন্তব্যে। অবাক বিস্ময়ে চারিদিক দেখছি স্বপ্নের দেশ, কোটি মানুষের কল্পনার দেশ এই সেই আমেরিকা। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিট গাড়ী চলার পর আমরা পৌঁছে গেলাম মেয়ের ‘স্প্রিংফিল্ডের’ বাড়ীতে।
দুই দিনের জার্নিতে ক্লান্ত শরীর। মেয়ে বল্লো, শাওয়ার নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ো সকালে কথা হবে। হাল্কা গরম পানিতে গোসলের ফলে শরীরের ক্লান্তিগুলো আস্তে আস্তে চলে গেলো। হাল্কা কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোরে ঘুম থেকে হাঁটা হাঁটি করার অভ্যাস আমার দীর্ঘ দিনের কিন্তু লম্বা জার্নির জন্য কাল সকালে বাইরে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মিসেস বারবারা’র সাথে আমার দেখা হলো আমেরিকায় পৌঁছাবার পর তৃতীয় দিন সকালে। বাসার প্রধান দরোজা খুলে বেরিয়েই পাশের বাসার সামনে নজর পড়লো, মনে হলো পাশের বাসার মালিক সকালে হাঁটতে বের হয়েছেন সাথে চেনে বাঁধা কুকুর। হাত নেড়ে হাই জানালো, প্রত্যুত্তরে আমিও হাত নাড়লাম।
মনে হলো কি যেন বল্লেন, একটু এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বল্লো, আমি বারবারা তোমাদের প্রতিবেশী। তোমার মেয়ে দুই দিন আগে তোমার আসবার কথা আমাকে বলেছিলো। তোমার মেয়ে খুব ভালো, আমি ওঁকে অনেক পছন্দ করি। ষাটোর্ধ বারবারাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লাগলো। বল্লাম, তুমি কিন্তু এখনো অনেক প্রীটি। ধন্যবাদ। বারবারা চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বল্লো, তুমি তো মানুষকে ভালোই খুশী করতে পারো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ