ইউসুফ কামাল : তোমার সাথে অনিমেষের সম্পর্ক, পরবর্তিতে বিবাহ সব কিছুই তো মনে হয় ভালো মতোই হয়েছিলো তাহলে ছন্দপতনের কারণ কি? আমার কথায় উর্মিলা যেন একটু থমকে গেলো, নিতান্তই ব্যাক্তিগত হলেও ও আমার সাথে তেমন একটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায় না ভেবেই প্রশ্নটা সহজভাবেই করলাম। উর্মিলার চুপ হয়ে যাওয়াতে আমি কি একটু বেশি অনধিকার চর্চা করে ফেল্লাম – ভেবে আমি নিজেও বিব্রত বোধ করতে থাকলাম। অচলাবস্থা কাটানোর জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে বল্লাম, আমি এমনিই জানতে চেয়েছি, কিছু মনে করো না তোমার সমস্যা থাকলে বলার দরকার নেই। ধরা গলায় উর্মিলা বল্লো, পৃথিবীতে এখন আমার দুই সন্তান আর দিদির পরে তুমি ছাড়া আমার কাছের আর কেউ নেই, অন্ততপক্ষে আমি সেটাই মনে করি। তোমাকে এবার এখানে পাওয়ার পরে আমার সাহসটা অনেক বেড়ে গেছে, আগের মতো এখানে কেউ নেই, আমি একা এটা মনে হয় না।
অনিমেষ চলে যাওয়ার পর আমি নিজেকে সম্পুর্ণ সংকুচিত করে ফেলেছিলাম, বলতে পারো বন্ধু আত্মীয়স্বজন কারো সাথেই যোগাযোগ রাখিনি। সবার অনিমেষ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি নিজেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সত্য কথা বল্লেও কেউ বিশ্বাস করতে চাইতো না, পৃথিবীময় সবার অবিশ্বাস যেন নারী জাতির উপর। দোষী হোক বা না হোক মানুষ মনে করে নারীই বেশি দোষী। আমার মনে হয় এর কারণ নারীরা প্রতিবাদী নয়, প্রতিবাদ করতে পারে না।
আমার কথায় তারা যে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারতো না সেটা তাদের চোখের ভাষায় স্পষ্ট বুঝতাম। নারীত্বের উপর তাদের এই অবিশ্বাস যে কতটা অপমানকর সেটা বুঝেই আমি সবার কাছ থেকে দূরে সরে থেকেছি। পাশ করে প্রথমে চাকরী পেলাম হিউষ্টন ক্যানসার হাসপাতাল ‘এন্ডারসন’ এ। অনিমেষ আগে থেকেই ওখানে চাকরী করতো, দেশের বাড়ী কুমিল্লা। প্রথম থেকেই সে আমার পিছনে লেগে থাকলো। ভালোবাসার প্রতিশ্রæতিতে আমাকে বেধে ফেল্লো, আমি তো একা। তখন পরামর্শ নেওয়ার মতো কেউ ছিলো না আমার। বলতে পারো একটা মোহের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। ছেলে বেলাতেই অনিমেষ ওর বাবা’র চাকরীর সুবাদে এ দেশে চলে এসেছিলো। অনেক ভেবে চিন্তে অনিমেষের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম। আমি মেথোডিষ্টে যোগদান করলেও ও এন্ডারসনেই থেকে গেলো, আমার সাথে মেথোডিষ্টে এলো না। তখনও আমি চিন্তা করতে পারি নাই ভিতরে ভিতরে ও এই সমস্ত কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ‘এন্ডারসন’ এ চাকরীর আট বছর পর আমি সিনিয়রিটি নিয়ে ‘মেথোডিষ্টে’ যোগদান করি। সিনিয়র হিসাবে আগের চাকরী থেকে শুধু বেতনই বেশী নয় অন্যান্য সুবিধাও অনেক বেশী। কিন্তু সমস্যাটা হলো অনিমেষকে নিয়ে, ওর মতিগতি আমার কাছে সুবিধা জনক মনে হচ্ছিল না। এখানে আসার দশ বছরের শেষে এই বাড়ীটা কিনে ফেলেছি। নিজের বাড়ী তাও আবার আমেরিকাতে আমার নিজের কাছেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু হয়েছে।
আমাদের বিবাহিত জীবনের দশ বছরের মাথায় অনিমেশ চলে গেলো তারই এক সহকর্মি মেক্সিকান বান্ধবীর কাছে। আমার সাথে যেভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো সেই একইভাবে ঐ বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে গৃহত্যাগী হলো, আমার কাছ থেকে ওর সন্তানদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেল। লসএ্যান্জেলস্ এ নতুন চাকরী নিয়ে, আমাদের ছায়া থেকে দূরে সরে গেলো। তখন আমার জীবন সংগ্রাম ভিন্নতর, চাকরীর সাথে সন্তানদের দেখাশুনা করা। সে এক অসম্ভবকে সম্ভব করার কাহিনী। এ সব সম্ভব হয়েছিলো একমাত্র এ দেশের কারণে, এ দেশের নাম যে আমেরিকা। আমার সন্তানেরা তখন একজন জুনিয়র স্কুলে আর অন্যজন সিনিয়র স্কুলের ছাত্রছাত্রী। ওরা নিজেরা নিজেদেরকে চলার মতো করে চলতে শিখে নিলো। সময়মতো নিজেরাই পোশাক পড়ে ব্রেক ফার্স্ট শেষ করে স্কুল বাসে করে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করে দিলো। ওরা নিজেরাই নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলতে সচেষ্ট হলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম এও কি সম্ভব? ভাই বোনের মধ্যে কত শক্ত ও সুদৃঢ় একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি অবিনাশের উপর ওদের মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রচন্ড একটা ঘৃণাবোধ। বল্লাম, অনিমেষ কি সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করতো না? উর্মিলা বল্লো, করেছিলো কিন্তু সে সন্তানদের কাছে এমনভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো যে ভুলেও আর ঐ চেষ্টা দ্বিতীয় বার করতে সাহস করে নাই।
সন্তানদের যখন নিজেদেরকে বোঝার মতো বুদ্ধি হয়ে যায় তখন খুব স্বভাবতই তারা মায়ের দিকে চলে যায়, তারা যখন বোঝে বাবা সবাইকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে তখন তাদের কে কোনভাবেই থামিয়ে রাখা যায় না। আমার প্রতি অবিনাশ যে অবিচার বিচার করেছে, আমার সন্তানেরা যে সেটা বুঝতে পেরেছে তার জন্য আমি ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ। লেখাপড়ার বিষয়ে ওদের যেদিকে পছন্দ, সে বিষয়ে আমি কোন রকম বাধা দিইনি। আস্তে আস্তে ছেলে মেয়ে যার যার সুবিধা মতো চাকরীতে যোগ দিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। আমি আমার নিজের কথা চিন্তা করে ওদেরকে আটকে রাখিনি। ওরা যেন আমার মতো ভুল না করে সেটাই মনে প্রাণে কামনা করি। ওদেরকে বলেও দিয়েছি যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার সাথে একটা পরামর্শ করে নিও, ভালো মতো যাচাই করে নিও। ওরা আমার কষ্ট দেখেছে তাই মনে হয় না ভুল করবে। খাওয়া শেষে উর্মিলা আমাকে লিভিং রুমে বসতে বলে বল্লো, তুমি কি চা কফি খাবে? আমি দুপুরের খাওয়ার পর কফি খাই যাতে ঘুম না আসে। বল্লাম, কফি চলতে পারে। উর্মিলার দেওয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে বল্লাম, আমার জীবন তো এখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার শেষ ধাপে, চিকিৎসার শেষ স্তর তো তোমার হাতের উপর দিয়ে পার হয়েছে। ভাগ্যের লিখন হয়তো এটাই ছিলো, সারাজীবনই দু’জনে সমান্তরাল রেখার মতো একটা অবস্থান বজায় রেখে চলেছি। ভালো মন্দের হিসেব তো কখনোই করিনি, সেই কিশোর বয়স থেকেই তো তোমাকে ভালো লাগে। জানি না কত দিন আর বেঁচে থাকবো, তবে আমাদের বেঁচে থাকার দিনগুলো যেন এমনি করেই কেটে যায় সেটাই কামনা করি। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ