ইউসুফ কামাল : দোতালায় বেডরুমের জানালার পাশে লেক, জানালার পাশের ইজি চেয়ারে বসে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোই সময় কেটে যায়। বিকেলের দিকে অনেকে ছোট ছোট মটর চালিত প্লাষ্টিকের ভেলা নিয়ে ঘুরতে বের হয়। টানা তিন দিনের অনবরত বৃষ্টিতে লেকের পানির উচ্চতা অনেক খানি বেড়ে গেছে। একটু জোরে বৃষ্টি হলে দৃষ্টিসীমাও ঝাপসা হয়ে আসে, দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে আসে দূরের কিছু দেখা যায় না। ঘুম থেকে আজ উঠতেই একটু দেরী হয়ে গেলো হয়তো বৃষ্টির জন্যেই, নাস্তা করার তাগিদও অনুভব করছি না। বৃষ্টির অবিরাম ধারা পড়তে দেখলে কেন জানি ছোট বেলা থেকেই আমার মনটা খারাপ হয়ে আসে। তখন হয়তো মা’য়ের বকুনির ভয়ে বের হতে পারতাম না কিন্তু সেই অনুশাসনটা এখনও মনের ভিতরে রয়েই গেছে। মা নেই কিন্তু মায়ের শাসন যে কত প্রয়োজন ছিল তখন এখন বুঝতে পারি। কেটলী থেকে গরম পানি, দুধ, কফি, হাল্কা চিনি মগে নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে জানালার পাশের চেয়ারে যেয়ে বসলাম। পানিতে বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য জানালার কাঁচটা একটু তুলে দিলাম, শব্দের সাথে সকালের ঠান্ডা পরিস্কার একটা বাতাস ঘরে ঢুকে পড়লো। সকালের পরিচ্ছন্ন বাতাস লম্বা শ্বাসে বুক ভরে নিলাম। ছন্দপতন হলো সেল ফোনের ভাইব্রেশন এর শব্দে। হাতের কাছেই ফোন মাথা ঘুরিয়ে ফোনের ডিসপ্লেতে নাম দেখলাম উর্মিলা। বুঝলাম আজকে ওর ছুটির দিন মানে শনিবার তা না হলে এ সময়ে ফোন দেওয়ার কথা না, অন্য দিন হলে ওর তো ডিউটিতে থাকবার কথা।
ফোন ধরতেই ওপার থেকে বল্লো, ব্যাস্ত নাকি? বল্লাম, না তো বসে আছি মন খারাপ। উদ্বেগ জড়িত কন্ঠে জিজ্ঞাস করলো, কেন? কি হয়েছে? হেসে বল্লাম, বৃষ্টি যে, তাই। শব্দ করে হেসে উঠলো উর্মিলা বল্লো, ঘর থেকে বের হতে পারবে না তাই? বল্লাম, বিষয়টা অমনই। তবু দুপুরের দিকে একটা জরুরি কাজ আছে বের হতে হবে। মন ভালো হয়ে যাবে বাসায় চলে আসো দুপুরের দিকে, উর্মিলার সরাসরি আমন্ত্রণ।
আজ খিচুরী রান্না করবো সাথে ইলিশ ভাজা। বৃষ্টির দিনের খাবার। আমার প্রিয় খাবার। বল্লাম, গতকাল তোমাদের সবার কথা খুব মনে পড়েছিলো। একটু কাজ আছে বারোটার দিকে ওটা শেষ করে আসবো। ইচ্ছে করে ওর দিদি প্রমিলার কথা আগ বাড়িয়ে কিছু বল্লাম না। না জানি ও কি ভাবে নেবে! সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রমিলাকে যে ওদের বাড়ীর দায়িত্ব অর্পণ করে এসেছিলাম সেটাও ওকে বলা হয় নাই। ও কি সব বিষয় জানে? চিন্তা করলাম আজ বলবো। ঠিক তিনটার দিকে উর্মিলার বাসার দরজার কলিং বেল টিপলাম। উর্মিলা দরজা খুলে হাসি মুখে বল্লো, ভিতরে এসো। তোমার অপেক্ষায় বসে আছি, সোজা ডাইনিং টেবিলে চলে এসো। বুঝলাম ও এখনো খায়নি। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। বড় বড় বাটিতে সমস্ত খাবার প্লেট দিয়ে ঢাকা দেওয়া যাতে ঠান্ডা না হয়ে যায়। উর্মিলা বল্লো, দেখো তো ঠান্ডা হয়ে গেলো নাকি? ঠান্ডা হলে মাইক্রোওভেনে গরম করে দেবো। বল্লাম, না চলবে। তুমি ও এসে বসে পড়ো। উর্মিলা একটা প্লেট নিয়ে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। আমার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বল্লো, যা রেধেছি তুমি খেতে পারবে কিনা? উর্মিলা খিচুরীর সাথে ডিমের মামলেট তুলে দিল প্লেটে। পরে আবার দু’ টুকরো ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে বল্লো, দেখো তো খাওয়া যায় কিনা? বল্লাম, আবার ইলিশ মাছ করেছো কেন? আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বল্লো, আজকে মা’য়ের কথা মনে হলো বৃষ্টির দিনে মা ইলিশ খিচুরী রান্না করতো তাই তোমার জন্য আমি রান্না করলাম। জানি তোমার ভালো লাগবে। কত মজা লাগতো, আমরা দুই বোন আর বাবা মা এক সাথে মাদুর পেতে বসে খিচুরী খেতাম। বলতে বলতে ওর গলার স্বরটা ধরে এলো। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো অশ্রæ লুকানোর জন্যই হয়তো বা। প্রসংগ ঘুরানোর জন্য বল্লাম, কতদিন যে ইলিশ আর খিচুরী খাই না, আহা। আসো এক সাথে শুরু করি। চুপ করে আছে দেখে বল্লাম, কি হলো শুরু করছো না কেন? তুমি যে বল্লে খুব ক্ষুধা লেগেছে। শুরু করো। খেতে খেতে বল্লাম, আচ্ছা উর্মিলা তোমার দিদি প্রমিলার সাথে কি তোমার যোগাযোগ আছে? ও মুখ ঘুরিয়ে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বল্লো, কেন বলো তো? উর্মিলা বল্লো, না সেই যে রফিক ভাইয়ের সাথে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো আর দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে রফিক ভাই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন দুই তিন বছর আগে। তবে সব খবরই পাই। দিদিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, জানি না এ জীবনে আর দেখা হবে কিনা? বল্লাম, আমার সাথে যুদ্ধের পর দিন দুয়েক দেখা হয়েছিলো। রফিক ভাইয়ের কথা তোমার মুখে শুনলাম। খুব জানতে ইচ্ছা করে প্রমিলা কেমন আছে? উর্মিলা নিজের প্লেটের খাবার নাড়া চাড়া করতে করতে বল্লো, আমি জানি তুমি উদ্যোগি হয়ে দিদিকে ফিরিয়ে এনে বাড়িতে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলে। আমার কাছে বিষয়টা খুব ভালো লেগেছিলো। কাজটা একজন যোগ্য অবিভাবকের মতো হয়েছিলো। দিদির যে কি উপকার তুমি করেছিলে সেটা বলার ভাষা আমার নেই। মাথা গোঁজার ব্যাবস্থা না হলে দিদি’র কি যে হতো! তখন থেকে তোমার কথা মনে পড়তো, আসলে তুমি যে আমার কথা চিন্তা করেই এসব কিছু করেছিলে সেটা আমি দূর থেকে শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম।
সেই প্রথম জীবন থেকেই তুমি আমাকে পছন্দ করতে, ঐ বয়সে বেশী কিছু বুঝতাম না। দিদি যখন রফিক ভাইয়ের হাত ধরে বাড়ী থেকে চলে গেল তখন বুঝেছিলাম দু’জনের মধ্যে প্রচন্ড বিশ্বাসের সৃষ্টি না হলে পরস্পরের প্রতি এমন ধরনের নির্ভরশীলতা আসে না। আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলো আমাদের পাশের বাড়ীর, তোমার হয়তো মনে আছে আমরা এক সাথে তোমাদের ব্যাডমিন্টন খেলা দেখতাম। বল্লাম, মনে আছে আমার। উর্মিলা বল্লো, দিদি রফিক ভাইকে ভালোবাসতো আমি জানতাম, যে দিন দিদি চলে গেলো শুধু আমাকেই বলে গিয়েছিলো। হাত ধরে কেঁদে বলেছিল, তোরা ভালো থাকিস। সে কথা আমি এতো দিন কাউকে বলিনি, শুধু আজকে তোমাকে বল্লাম। দিদি বেচে আছেন এখনো, রফিক ভাই নেই। দুই ছেলে ভালো চাকরী করে, ওরা সবাই ভালো আছে। কতগুলো বছর চলে গেছে আমাদের জীবন থেকে তাই না! দিদিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, জন্মের পর থেকে এক সাথে বড় হয়েছি। কত মান অভিমান, খুনসুটি করেছি দু’জনে। না জানি কেমন আছে, চোখের দেখাও হয় না কত দিন, কত বছর। কাছে থাকলে বোঝা যায় না কিন্তু দূরে চলে গেলেই ভালো লাগার মানুষগুলোর জন্য মন কাঁদে। সেই পুরনো পরিচিত জায়গাগুলো আমাকে খুব টানে কিন্তু কি করবো। যেতে ইচ্ছে করলেও যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভাবছি আর এক বছর চাকরী করবো, তারপর ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবো যে খানে যেতে মন চায় চায় চলে যাবো।
কিন্তু আমি নিশ্চিত কোথাও যাওয়া হবে না। এটাই জীবনের বাস্তবতা এটাই জীবনের পরিণতি। ক্ষনে ক্ষনে জীবনের পরিকল্পনা গুলো পরিবর্তিত হতে থাকে, সেই কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের উর্মিলা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চলে গেলাম ভারতে ওখান থেকে স্কলারশীপ নিয়ে চলে এলাম টেক্সাসের নোভা কলেজে। তারপর ডিপ্লোমা পাশ করে এই পেশায়। দেখো কত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে। ঘর বাঁধলাম, ঘর টিকলো না জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে ভর করলো। সন্তানেরা লেখাপড়া করে যার যার মতো আস্তে আস্তে স্থায়ী হতে থাকলো… আমি যে একা সেই একা। জীবনে কত কিছুই তো করতে চেয়েছিলাম কিন্তু কৈ তার কিছুই তো করতে পারলাম না। জীবনের সময় শেষ হয়ে আসছে কিন্তু জীবনের সব কাজ কি শেষ করা সম্ভব হবে? (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ