ইউসুফ কামাল : হিউষ্টন মেথডিষ্ট হাসপাতাল থেকে এক মাসের উপরে (পঁয়ত্রিশ দিন) রেডিয়েশনের লম্বা একটা কোর্স শেষ করেছি সুদীর্ঘ পাচ মাস আগে। ডাঃ হক প্রখ্যাত অনকোলজীষ্ট, উনার তত্বাবধানে রেডিয়েশন শুরু করেছিলাম আর উনার সার্বক্ষণিক তত্বাবধানেই যথারিতী কোর্স শেষ করেছিলাম। শরীরে ক্লান্তির ধাক্কা শুরু হয়েছিলো রেডিয়েশন চলাকালীন সময় বিশ পঁচিশ দিন পর থেকেই। আর সেই কারণেই পরের দিকে ডোজ কমিয়ে দিতো। দুর্বলতা আর ক্লান্তি নিয়ে সারা দেহ মন আর চলতে চাইতো না। উর্মিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এর কারণ সম্মন্ধে। ও বলেছিলো আস্তে আস্তে দুই তিন মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। বাসা থেকে পুরো সময়টাই একা গাড়ী চালিয়ে যেতাম আবার রেডিয়েশন শেষ করে গাড়ী চালিয়ে ফিরে আসতাম। আমার চেয়েও বয়স্ক কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা আমার মতোই একা একা গাড়ী চালিয়ে আসা-যাওয়া করতো। দেখে নিজে কিছুটা অনুপ্রাণিত হতাম, মনে সাহস পেতাম। এখানে তো ড্রাইভার রাখা সম্ভব না (আর্থিক দিক বিবেচনায়) তাই পরিবারের কেউ এ দায়িত্ব পালন করে থাকে। ছেলে-মেয়ে বা অন্য কেউ, আমার জন্য সেটা তখন সম্ভব হয় নাই। তাই আমি নিজেই যাওয়া-আসা করতাম। শেষের দিকে বেশি ক্লান্তি লাগতো, তবু ত্রিশ মিনিট মনের জোর ঠিক রেখে যাওয়া-আসা করতাম। আমার নিজের দেশের অনুপাতে আমেরিকায় ড্রাইভিং এ ঝুট ঝামেলা কম, সব কিছুই নিয়মমাফিক। আইন মেনে চল্লে তেমন কোন সমস্যা হয় না। সব লাল হলুদ সবুজ বাতির ব্যাপার। যার যার ট্রাকে সে সে গাড়ী চালায় এর কোন ব্যাতিক্রম হয় না। আর সেটা হলেই দুর্ঘটনা অবধারিত। যেখানে মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সেখানে কোন ট্রাফিক কনষ্টেবল এর প্রয়োজন নাই। একমাত্র দুর্ঘটনা ঘটলে তবেই রাস্তায় সার্জেন্ট ও রেসকিউ কার এর দেখা মেলে। মাঝে মাঝে উর্মিলা জিজ্ঞাসা করতো গাড়ী চালিয়ে আসতে সমস্যা হচ্ছে না তো? হাসি দিয়ে বলতাম, না তেমন খারাপ লাগছে না। আর লাগলেই বা কি করা, কে আর আনা নেওয়া করবে বলো? উর্মিলা হাসি দিয়ে বলতো, তুমি সারাজীবনই শারীরিকভাবে ফিট এখনও তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। এর কারণ মনের জোর আর যেটা তোমার বরাবরই খুব শক্ত।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু না খেয়ে অভুক্ত অবস্থায় (সেটাই নিয়ম) গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পরতাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে আর নয়টা সাড়ে নয়টার মধ্যে (রেডিয়েশন নিয়ে) বাসার ফিরে নাস্তা করতাম। রেডিয়েশনের রিসেপশনে আপ্যায়নের চমৎকার ব্যাবস্থা, রুমের ভিতরে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। দুই মেশিনে চা কফির ব্যাবস্থা আর পর্যাপ্ত পরিমাণ বোতলের পানি। সব কিছু আছে, যার যেটা দরকার সেটা নিয়ে নেওয়া যায়। সব কিছু বিনামূল্যে, সত্যিকারে জনসেবা বলতে যা বোঝায়। প্রথমের দিকে বুঝিনি, রিসিপশনিষ্ট মার্থা প্রথম দিন বলে দেওয়াতে আমার জন্য বুঝে নিতে সুবিধা হয়েছিলো। সময় হতেই ভিতর থেকে অন ডিউটি নার্স এসে ডেকে নিয়ে যেত। ড্রেসিং রুমে ঢুকে জামা কাপড় খুলে হাসপাতালের গাউন পরে নিদিষ্ট রুমে চলে যেতে হতো। তারপর উর্মিলার হাতে নিজেকে সোপর্দ করে দেওয়া, সে নিদির্ষ্ট বেডে সযতেœ শুইয়ে দিয়ে মেশিন চালু করে বাইরে চলে যেত। দশ বারো মিনিট পর মেশিন বন্ধ হলে রুমে ঢুকে সযতেœ বেড থেকে তুলে বসিয়ে দিতো। তারপর ড্রেসিং রুমে যেয়ে নিজের পোষাক পরে বের হয়ে চলে আসা। প্রতি সোমবারে ডাঃ হক বিগত সাতদিনের ফলাফল দেখতেন, প্রধানত: উনি শরীরের ওজনটার উপর বেশী খেয়াল করতেন। সমস্যা হলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় কেটে গেল তিন মাস। তিন মাস পর রক্ত পরীক্ষা। এর মধ্যে দুই দিন উর্মিলার সাথে ফোনে কথা হয়েছে, ও কিছুটা উদ্বিগ্ন রক্তের পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য। ব্যাস্ততার জন্য সময়ও পায় না আলাদাভাবে কথা বলার মতো, চাকুরী আর সংসার নিয়েই সময় শেষ। বেচারা সারাদিন অফিস ডিউটি করে বাসায় ফিরে মেয়েকে সাথে নিয়ে সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে রান্নার কাজ করে ফেলে।
ছেলে ভার্জিনিয়ায় জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে ছুটিতে মায়ের সাথে দেখা করতে আসে হিউষ্টনে। তিন মাস পর নিদিষ্ট দিনে এসে রিসেপশনিষ্ট মার্থাকে রক্ত পরীক্ষার কথা বলতেই ও আমাকে পাঠিয়ে দিলো অন ডিউটি নার্সকে দিয়ে নিদিষ্ট রুমে রক্ত পরীক্ষার জন্যে। যাবার সময় উর্মিলার সাথে দেখা, চোখ তুলে চাইলো স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বল্লো, টেষ্ট এর রেজাল্টটা কিন্তু জানাবে সময় মতো। পরীক্ষার পর তৃতীয় দিন ডাঃ হক নিজেই আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন রক্ত পরীক্ষার রেজাল্ট। বল্লেন, রক্তের রেজাল্ট ভালো। তুমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
বিরাট একটা বোঝা যেন নেমে গেল মন থেকে, ফোন করে জানালাম উর্মিলাকে। ও হেসে বল্লো আমি তোমাকে দেখে এমনই ধারণা করেছিলাম, যাইহোক রেডিয়েশন পরবর্তি কিছু সমস্যা হতে পারে সে ব্যাপারে ড: হক তোমাকে বলে দেবেন। সম্ভব হলে কাল দুপুরের পর একবার আমার অফিসে এসো। পরদিন হাসপাতালে যেতেই মনে হোল ও যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। রিসেপশন থেকে মার্থাকে দিয়ে ফোন করাতেই উর্মিলা বেরিয়ে এলো বল্লো চলো তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে কার পার্কিংয়ে এসে বল্লো, তুমি আমার গাড়ী ফলো করে পিছন পিছন আসো। কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না। ‘রেইনি ফরেষ্ট ট্রি’ রোড ধরে একটু এগিয়ে বাম দিকের একটা বাসার ড্রাইভ ওয়েতে গাড়ী ঢুকিয়ে দিয়ে উর্মিলা নেমে বল্লো, এসো। গাড়ী পার্কিং করে কোন কথা না বলে ওর পিছনে পিছনে আসতেই দেখি উর্মিলা ব্যাগ থেকে চাবি বের করে ওর বাসার দরজা খুলে ফেলেছে। মুখ ঘুরিয়ে আমাকে ভিতরে ঢুকতে বল্লো। আমাকে বসতে বলে ও ভিতরে চলে গেলো। সাজানো গোছানো বাসা, বাসায় যে মানুষ জন কম সেটা বোঝা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের ইউনিফর্ম বদলে দুই কাপ কফি নিয়ে এসে বসলো আমার সামনে। সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বলো তো আমি কে? ওর কথায় প্রথমে একটু হতচকিয়ে গেলাম। উর্মিলা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বল্লো, তুমিতো জানো আমি সেই কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের মেয়ে মিলা। পৃথিবীর মধ্যে এখন কজন আর আমাকে চেনে বলতে পারো? সময়ের পরিক্রমায় দু’একজন ছাড়া আমাকে সবাই ভুলে গেছে। যুদ্ধের সময় বাবা মা এর সাথে ভারত যাবার পথে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে কুষ্টিয়া কোর্ট রেল ষ্টেশনে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তুমিও মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এ অংশ নিতে ভারত যাচ্ছিলে। আমাকে খুব ভালো করে চিনতে, মনে মনে পছন্দও করতে। তোমার চোখের ভাষা পড়তে তখন আমার ভুল হতো না। শক্ত করে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে – বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে, ষ্টেশনের মাইকে বাবা মার সন্ধান করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলে। ভাগ্যিস তখন তুমি ছিলে, না হলে আমি তখন কোথায় ভেসে যেতাম, হারিয়ে যাওয়ার খাতায় আমার নামও যোগ হতো। একা হয়ে যেতাম চির পরিচিত মহল থেকে, পরিচিত হতাম নতুন কোনো নামে। আসলেই তুমি একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ, অন্য আর দশ জনের মত না।
এখনও তো আমি সেই একাই। ভাসতে ভাসতে পৃথিবীর এই কুলে এসেও আবার মানুষ চিনতে ভুল করলাম, ঘর বাঁধলাম ভুল একজনের সাথে সেও পাঁচ বছর পর চলে গেল অন্য জনের হাত ধরে। মাঝে মাঝে ভাবি মানুষ এমন কেন? ভাগ্যিস এই খানে চাকরী করতাম তাই ছেলে মেয়ের হাত ধরে রাখতে পেরেছি, লেখাপড়া করাতে পারছি না হলে কি যে হতো? এখন এই পৃথিবীতে আমি একা, আমার আর কেউ নেই। কারো সাথে বসে যে সুখ দুঃখের কথা বলবো সেরকম একটা মানুষও আমার নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে এসেও কথা বলার মতো একজনকেও পাই না। একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় ফিরে যাই সেই হারানো দিনগুলোতে, কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলের স্মৃতিময় দিনগুলো যা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ভুলতে পারি না বলতে পারো এ কেমন জীবন আমার? কি অবলম্বন করে বেচে থাকবো? বলতে পারো? (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ