ইউসুফ কামাল : তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা ..
মন জানো না
একজনে সুরে সুর তোলে একতারায়
আর একজনে মন্দিরাতে তাল তোলে ..
মনে আছে স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে বনি এম’এর সেই বিখ্যাত গানগুলোর কথা। উদ্দাম বাঁধ ভাংগা নৃত্যের সাথের রাসপুতিন, রিভারস অব ব্যাবিলন, ড্যাডি কুল গানগুলো তখন ঝড় তুলে একাকার করে ফেলেছিল সমগ্র যুব সমাজের মধ্যে। অডিও ক্যাসেটে জনপ্রিয় এই গান গুলো রেকর্ড করে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে শুনেছি কত শত বার তার কোন হিসেব নেই। রাস্তার পাশের মার্কেটের মিউজিক শপগুলোর প্লেয়ারে অনবরত বেজেই চলতো গানগুলো, মনে হতো এর থেকে বোধ হয় যুব সমাজ আর বের হতে পারবে না। যেমন বের হতে পারেনি অসময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া গায়িকা নাজিয়া হাসানের ভ‚বন মাতিয়ে ফেলা ‘ডিসকো দিওয়ানে’ গান থেকে। (১৯৬৫-২০০০) দুরারোগ্য রোগ লাং ক্যানসারে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলো অল্প কয়েকটা গানের মধ্যে ডিসকো দিওয়ানে অ্যালবামের বিশেষ একটি গান দিয়ে সমগ্র পৃথিবী জয় করে নেওয়া নাজিয়া হাসান কে। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের পর পৃথিবী আর তাকে ধরে রাখতে পারেনি। জীবনকে বিকশিত করার আগেই প্রতিভাধর এই শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
মনে পড়লো সে দিন কানাডায় স্থায়ী হওয়া বন্ধু বিদ্যুৎ সরকার ফোন করে জানতে চাইলো-ডিসকো দিওয়ানে গানের শিল্পীর নামটা সে ভুলে গেছে আমার মনে আছে কিনা? তার মানে আমার বন্ধু ও তার মনের নেইবার হুডের বন্ধুদের নাম ভুলে গেছে! আমার বন্ধুর মতো অনেক মানুষ ভুলে গেছে তাদের এক সময়ের ভালো লাগা গানের স্রষ্টাদেরকে। নেটে সার্চ দিলে হয়তো পুরনো গানের অ্যালবামে পাওয়া যাবে গানগুলো। ইচ্ছে করলে শোনাও যাবে কিন্তু সেই বিশেষ ভালো লাগা মুহূর্ত গুলো কি এখন আর ফিরে পাওয়া যাবে? হারিয়ে গেছে মনের সীমানা ঘিরে থাকা মনের সেই প্রিয় ও ভালো লাগা বিষয়গুলো। এখন আর নেই অনেক দুরে সরে গেছে, যোজন যোজন দুরে।
বাঁশী বাজে ঐ দুরে চেনা কি অচেনা সুরে,
এ লগনে মন মোর রয় না ঘরে।
তখন সারা মন জুড়ে ভাল লাগাটা লেগে থাকতো মোহাম্মদ আলী সিদ্দীকির সেই কালজয়ী গান, এখন তো সেটা ও আর নেই। মনের অলিন্দে আয়েসি ভংগিতে থাকা সেই সময়ের ভালোলাগা গান গুলো এখন কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। মন থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে ভালো লাগার সেই সময়গুলো। বোরহান সিদ্দিকী ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা কালীন সময়ে আমার হলের রুমমেট। পরিমিত স্বভাবের বোরহান ছিলো অর্থনীতির ছাত্র, দেশের বাড়ী বরগুনা, বরিশাল। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থির পরিবেশের মধ্যেও সে নিজেকে স্বকীয় ধারায় ধরে রাখতে পেরেছিলো। বন্ধুর সংখ্যা খুব একটা বেশী ছিলো না ওর, বড় জোর দুই /তিনজন। স্বাভাবিক পোষাক পরিচ্ছদেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো, তার ঐ পছন্দের পোশাকেই সে সব সময় ফিট ফাট থাকতে পছন্দ করতো। বোরহানের শখের মধ্যে ছিলো বিরহের গান শোনা । আর গান শোনার ব্যাতিক্রমি বিশেষত্ব হলো, পছন্দের বিশেষ গানগুলো একবারে পাঁচ/সাত বার শোনা। গজলের ভক্ত ছিলো দারুনভাবে। গোলাম আলী আর চিত্রা সিং এর গানই ছিলো ওর বেশি পছন্দের। এই দুই শিল্পীর গান দিয়ে ভরা ছিলো ওর ওয়াকম্যান এর ক্যাসেটগুলো। সেই বোরহানের মতো ভাললাগার প্রতিবেশীরা সবাই এক সময় বদলে যায়, কর্মজীবনে ঢুকে বাস্তব জীবনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। পরে চেনাই যায় না পূর্বের আর বর্তমানের মানুষটিকে। বোরহানের সাথে সব শেষে দেখা হবার সময় শুনেছিলাম বিসিএস দিয়েছে, অপেক্ষা করছে রেজাল্টের। সেটাও কত বছর আগের কথা। আর দেখা হয়নি আমার সাথে। বোরহানের কিছু ভালো গুনের জন্যই হয়তো তাকে এখনো মনে আছে। ও ছিলো স্বচ্ছল বাবা মায়ের সংসারের এক মাত্র সন্তান, টাকা পয়সার টানাটানি তার মধ্যে কখনোই ছিলো না। বাহুল্য ব্যায় করতে দেখি নি কখনো, মোটামুটি সব দিক দিয়েই সে ছিলো ভালো লাগার মতো একজন রুচিবান মানুষ। বোরহান তার ‘ওয়াকম্যান’ এর জন্য শাহবাগের বাবুল ইলেকট্রনিক্স থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী একই গান পর পর পাঁচ বার করে রেকর্ড করিয়ে আনতো। শুনতে আশ্চর্য্য লাগলেও বাস্তবে বোরহান তাই করতো। ওয়াকম্যানের হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতো, তাতে আমার আর ঘুমের কোন ব্যাঘাত হতো না। আমার সুবিধা অসুবিধার দিকে বোরহানের ছিলো প্রচন্ড সজাগ দৃষ্টি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সম্পর্কটা খুবই আন্তরিকতায় ভরা ছিলো। রুমমেট হিসাবে আমার ভাগ্যটা বলতে হবে ভালোই ছিলো, রুমের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা নিয়ে আমার কোন চিন্তা করতেই হতো না কখনো।
সেই রুমমেট এর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলে অকস্মাৎ ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ মিশনে। আমি তখন ভার্জিনিয়ায় থাকি। পাসপোর্ট রিনিউ করতে এম্বেসীতে গিয়েছিলাম আর সেখানেই ওর সাথে দেখা। দুর থেকে ও ই আমাকে প্রথম দেখেছে, লম্বা পা ফেলে কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবেগ মিশ্রিত স্বরে ডাকলো, ‘রুম মেট’। দীর্ঘ দিন পর খুব পরিচিত একটা ডাকে পিছনে দাঁড়ানো বোরহানকে দেখে চমকেই উঠেছিলাম, দেখি ও আমার দিকে তাকিঁযে মিটমিট করে হাসছে। আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল কিছুক্ষন, ছাড়তে ওর দিকে তাকাতে দেখলাম হাতের বুড়ো আংগুল দিয়ে চোখের কোনাটা একটু মুছে নিলো। বুঝলাম, খুব সংগত কারনেই অতীতের স্মৃতিগুলো ওকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে, যেখান থেকে ও বের হতে পারছে না। বল্লো রুমমেট আপনাকে অনেক খুঁজেছি, কষ্টের মুহূর্তে ভালো বন্ধুর খুব প্রয়োজন। আমার জীবনের নিঃসঙ্গতার সময় আপনাকে পাশে পেলে দুঃখ বোধটাকে একটু হাল্কা মনে হতো। সবার সাথে তো আর দুঃখ শেয়ার করা যায় না। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম বোরহানকে, একটু মোটা হয়ে গেছে হয়তো বয়সের কারনে সেই সাথে মাথার চুলের সংখ্যা অনেক কমে মাথায় চকচকে একটা টাক দেখা যাচ্ছে। সেই পরিচিত কন্ঠস্বর আর হাসি, আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বল্লো, পৃথিবীটা গোল তাই না! শেষ পর্যন্ত্য তা হলে দেখা হলো! দেখা হয়ে গেলো বোরহানের সাথে। ছেলের সাথে এসেছে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কি একটা কাজে আমারই মতো। ছেলে অফিসের মধ্যে ঢুকেছে, আমরা এ্যামবেসী ভবনের বাইরে কার পারকিংয়ে দাড়িয়ে কথা বলছি। হাসতে হাসতে বল্লাম, এখনো কি চিত্রা সিংয়ের ঘুম পাড়ানী গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে হয়? হেসে বল্লো, নাহ্। বিয়ের পর বৌয়ের রাগপ্রধান গান শুনে ঘুমুতে যেতাম আর সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে তার চলে যাওয়ার পর। এখন পুরনো কথা ভেবে সময় কাটাই।
ওর শেষ কথায় চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। বিষন্ন মুখে বল্লো, না আগে তো কল্পিত দুঃখে থাকতাম এখন বাস্তব দুঃখ নিয়ে থাকি। ছেলের এখানে ছয় মাস থেকে আবার দেশে চলে যাই, ছয় মাস পর আবার ফিরে আসি এমনি করেই আসা যাওয়া আমার এখনকার জীবন। একাকিত্তে¡র এই যন্ত্রনা বয়ে বেড়ানো অনেক কষ্টের। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ