ইউসুফ কামাল : আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায়
দেখতে আমি পাইনি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি
আমার হ্রদয় পানে চাইনি\
আমার সকল ভালোবাসায়
সকল আঁধার সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে
আমি তোমার কাছে যাইনি
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে
আমার খেলায়
আনন্দে তাই হেসেছিলাম
কেটেছে দিন হেলায়
তখন আমি ভালো রকমের অসুস্থ। ডাঃ সালাম অপারেশন করতে চাইলেন, কি করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। রোবোটিক সার্জারী করতে বল্লেন, তার জন্যে যেতে হবে ভারত অথবা সিংগাপুর।
সমস্যা হলো তখন চারিদিকে করোনা’র প্রাদুর্ভাব প্রচন্ড রকমে ছেয়ে গেছে, এই অবস্হায় একাকী ভারত যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কার সাথে যেতে হবে, একাকী তো সম্ভব নয় আর কেউ যেতেও সাহস পাচ্ছে না, একাকী বিভ‚য়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকলে কে দেখবে? কে যত্ন আত্তি করবে? মহা সংকট, আমার জীবনে একটা ক্রান্তিকাল চলছে তখন। কিছুই করার নাই, এখানে যে টাকা খরচ হলো তার চেয়ে কম টাকায় ভারত কিম্বা সিংগাপুর থেকে চিকিৎসা করে আসতে পারতাম। কিন্তু বিধি বাম পারিপাশ্বকিতায় আর বিকল্প কোথাও যেতে পারলাম না, ডাঃ সালামের ছুরি কাঁচির নীচেই জান কবুল করে শুয়ে পরলাম।
তিন মাস পর পুনরায় টেষ্ট করে আবার এক অনিশ্চিত জীবন, ডাঃ সালামের পরামর্শে হিঊষ্টনের মেথোডিষ্টে করতে হবে বাকী চিকিৎসা। যেহেতু হিউষ্টনে থাকি ডাঃ ওখানেই পরবর্তি চিকিৎসাটা নিতে বল্লেন ডা: হকের অধীনে। আর জীবনের চরমতম ঘটনাটা সেখানেই যে ঘটবে কেই বা জানতো সেটা। সেই হার্টথ্রব করা উর্মিলা আমার কুষ্টিয়া কলেজের সহপাঠি, এক অনন্যা শ্রেণীর মেয়ে। হাসপাতালে প্রথম দৃষ্টিতে ওকে আমার চিনতে একটু দেরী হয়েছিলো। উর্মিলা প্রথম দৃষ্টিতেই চিনে ফেল্লো আমাকে। ফাইলে আমার রিপোর্টে আমার নাম আগেই দেখেছে। ওরা জানে চিকিৎসায় ওদের কি কি করতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম কতদিন তুমি এখানে, দেশ ছেড়ে পৃথিবীর এই প্রান্তে? নিদেনপক্ষে একটা খোঁজও তো নেই। একদম উধাও হয়ে গেলে? দেখলাম ও এখনো আগের মতোই, স্বল্প বাক মানুষই রয়ে গেছে। ছোট ছোট উত্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। বল্লো, একটা স্কলারশীপের মাধ্যমে এই দেশে চলে এসেছিলাম পড়াশুনা করতে। সেটা শেষ করে রেডিয়েশন টেকনোলজির উপর ডিপ্লোমা শেষ করে এখানে জয়েন করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। বল্লাম, বেশ বড় একটা দায়িত্ব নিয়ে আছো। উর্মিলা, তোমার সাথে যে এখানে দেখা হবে আমরা কেঊ না জানলেও মনে হয় ভবিতব্য ঠিকই জানতেন। আমি তো এখন সরাসরি তোমার পেশেন্ট তোমার অধীনে। হাসি দিয়ে বল্লো, ভয় নেই। শত্রæ তো হইনি এখনো আগের মতো বন্ধুই ভাবতে পারো। আর হারিয়ে যাবার জন্য কেউই তো একা দায়ী নয়। বললাম, এখন তো তোমার সাথে পঁয়ত্রিশ দিন রোজ দেখা হবে, তারপর? হয়তো আবার বিচ্ছেদের করুণ সুর বাজতে থাকবে। আমার কথায় করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো, মনে হলো যেন একটা বড় আকারের হিমবাহ ভেংগে তলিয়ে গেল আটলান্টিকের অতল জলে, নিঃশব্দে। রেডিও থেরাপিষ্ট বিভাগের প্রধানরা সাধারণতঃ রোগীর কাছে এসে দাঁড়ায় না, তারা সব সময় টিভিতে মনিটরিং করতে থাকে। তিনজন সহকারী ধরে টেবিলে শুইয়ে দেয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার ধরে শোয়া থেকে তুলে বসিয়ে দেয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম দিন রেডিয়েশন টেবিলের উপর আমার বসে থাকা অবস্থা থেকে উর্মিলা পরম যতেœ দু’হাত দিয়ে শরীরের ভর নিজে ধরে টেবিলে শুইয়ে দিলো।
আবার রেডিয়েশন শেষ হবার পর পরম যত্নে যেন একটু সময় নিয়ে, দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তুলে বসিয়ে দিলো। ওর আন্তরিকতায় ভালোবাসার মৃদু স্পর্শের মধ্যেও যে একটা গভীরতা আছে, সেটা বুঝতে বাকী রইলো না কারোই। অন্যান্য নার্স তিন জন নিজেরা নিজেদের মধ্য আড় চোখে চাওয়া চাওয়ি করলো যা আমার দৃষ্টি এড়াতে পারলো না। উর্মিলা তুমি কতদিন হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলো? কত যুগ হবে? হিসাব করতে গেলে হয়তো অনেক সময় লেগে যাবে, তাই ও পথে না যেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করলাম। পাথরের মতো স্থির চোখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই, চশমা পড়েছে বয়সের কারণেই হবে হয়তো। শুধু কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। কিছুই বল্লো না, একটু হাসলোও না। রোজ একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে আমার চিকিৎসাটা চলতো, ঐ সময়টা ও নিজের দায়িত্বটা ওর সহকারীর উপর দিয়ে পুরো সময়টা আমার জন্য ব্যাস্ত থাকতো। শেষের দিন জিজ্ঞেস করলাম তোমার সাথে আর কে থাকে এখানে? সেই পুরোন অভ্যাস জুতা শুদ্ধ পা দিয়ে অন্য পায়ের সাথে পা ঘষতে ঘষতে বল্লো, মেয়ে থাকে এই বছর পনেরো তে পরবে। এই হাসপাতালের কাছেই ‘রেইনট্রি ফরেষ্ট’ রোডে বাসা। পনের মিনিটের পথ। বল্লাম, চিনি আমি ঐ রাস্তা দিয়েই রোজ গাড়ি নিয়ে আসা-যাওয়া করি। উর্মিলা বল্লো, আমার তো আর কেউ নাই, দেশের সাথেও কোনো যোগাযোগ নাই। আমার খবর কেউ নেয় না, আর আমিও কারো সুখ দুঃখে নাই। এই একাকীত্বময় জীবনে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রশ্ন করলো, বল্লো তুমি কি এখানেই থাকো? বল্লাম, হাসপাতাল তোমার বাসা থেকে পনেরো মিনিট দূরে, আর আমার দূরত্ব পঁয়ত্রিশ মিনিট। এ্যালোরি কোর্টে থাকি, এই শহরেই। একই দেশ, দু’জনের বসবাস সামান্য একটু দূরত্বে কিন্তু এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে অনেকগুলি সময় নিশঃব্দ পদক্ষেপে। এত কাছাকাছি তবু দেখা হয়নি জানা হয়নি, হাত বাড়ালেই নাগালের মধ্যে পাওয়া যেত। কথাটা শুনে গভীর দৃষ্টি নিয়ে উর্মিলা আমার দিকে তাকালো।
এমনি করেই সম্পর্কগুলো অজান্তেই হারিয়ে গেছে অজানার পথে। কেমন করে জানি না আমার জীবনের ভালো সময়গুলো পার হয়ে গেছে, আর আমার সুস্থ শরীরে অসুস্থতা বাসা বেঁধেছে। বল্লো, ভয় নেই আমি রিপোর্ট দেখেছি, তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। বল্লাম, তোমার উপর আমার অনেক আস্থা। যা আগেও ছিলো আর সেটা এখনো আছে। কিছুই বল্লো না শুধু মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সারা দেশে অস্থিরতা, যে পারছে পালিয়ে জীবন রক্ষা করছে। উর্মিলারা পরিবারসহ বনগাঁ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। আমি এক বন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ট্রেনিং এর জন্য ভারত যাচ্ছিলাম। উর্মিলা বল্লো, শরণার্থীদের ভীড়ে আমি তো হারিয়েই গিয়েছিলাম। কান্নারত অবস্থায় ছুটেছুটি করছিলাম বাবা-মা’র জন্য। তুমি দেব দূতের এসে হাজির হয়েছিলে। মোহিনী মিল এলাকাতেই আমরাও থাকতাম মোটামুটি দুই /তিন বাড়ি পর। উর্মিলার যেন পুরোন দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে বল্লো, তুমি ঐ মুহূর্তে আমাকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলে। আর ষ্টেশনের মাইকে এ্যানাউন্সমেন্ট করার জন্যই তো আমি সেদিন সবাইকে ফিরে পেয়েছিলাম। সেদিন হারিয়ে গেলে, কোথায় যেতাম ভাবলেই এখনো শিউরে উঠি। এক কথায় তুমি আমার জীবন রক্ষাকর্তা। কোথায় ছিলে তুমি এতদিন, সেই ফিরে তো এলে কিন্তু জীবন সায়াহ্নে কেন? স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে এসে কুষ্টিয়ার ঐ এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিলাম, কিন্তু অনেকের মতোই উর্মিলাদের পরিবারও যুদ্ধের পরে আর দেশে ফিরে আসেননি। ভারতেই রয়ে গেছে বলে জানতাম, বলতে গেলে মনের অতলে হারিয়েই গিয়েছিলে উর্মিলা আমার স্মৃতি থেকে। মনে পড়লো ওর প্রিয় গানটার প্রিয় লাইন দুটো বল্লাম, সেই লাইন ক’টি একটু শোনাবে? লজ্বা পেয়ে বল্লো, এই খানে এই হাসপাতালে? কানে কানে বল্লাম, খুব আস্তে আস্তে বলো, কেউ শুনবে না।
কেমন যেন একটা মায়াময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর আমার বেড সাইড টুলে এসে বসলো।
খুব ধীর লয়ে মৃদু স্বরে গাইতে শুরু করলো –
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে
আমার খেলায়
আনন্দে তাই হেসেছিলাম
কেটেছে দিন হেলায় \
গান শেষে ও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, গানটার রেশটা ধরে রাখতে।
বল্লাম, উর্মি এই গানটার এই কয়েকটা কথার আবেদন যেন আমার এই সুদীর্ঘ জীবনের মধ্যে একটা করুণ অধ্যায়।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : রাজবাড়ী, ঢাকা, বাংলাদেশ