ইউসুফ কামাল : আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব সর্বাধুনিক যন্ত্র দিয়ে। সর্বাধিক গভীর কোন অঞ্চল সেটা পরিমাপ করা সহজ, কোন অঞ্চলে তিমি হাংগরেরা বেশি বাস করে সেটাও বের করা এখন খুবই সহজ কাজ। পৃথিবীর মানুষের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য কাজ ছিলো টাইটানিক, যা কখনোই পানিতে ঢুববে না। সেটাও প্রকৃতির কাছে খুব সহজে হেরে গেছে। বিজ্ঞান হেরে গেছে প্রকৃতির কাছে, সাথে হেরে গেছে হাজারো মানুষের অহংকার। মহাসাগরের গভীরতা মাপা যায়, কিন্তু কেন যে মানুষের আয়ুস্কাল মাপা যায় না সঠিকভাবে সেটা এখনো কি মাপা যায়? যায় না, যেমন যায়নি আমার বন্ধু নিজামের স্ত্রীর অতি আপন জনদের সাথে মিলিত হওয়ার সময় জানা সম্ভব ছিলো কিনা, কতক্ষণ পরে তারা মিলিত হবে এটা কি মেপে বের করা যেতো?
বাংলাদেশে সম্ভবত ২০০৫/২০০৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ চলাচল করতো ঢাকা থেকে – লন্ডন ননষ্টপ ফ্লাইট। পরে পরিচালনা বন্ধ হয়ে যায় অন্যান্য রুটের সাথে প্রতিযোগীতায় না পারার কারণে। এর মুখ্য কারণ হলো অধিকাংশ যাত্রী মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রীক হওয়ার জন্য। তখন বেশ কয়েকবার আমি আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছি বৃটিশ এয়ারওয়েজে আমেরিকা যাতায়াত করার কারণে। সরাসরি লন্ডন থেকে আড়াআড়ি ওপারে ওয়াশিংটনে পাড়ি দেওয়ায় সময় লাগতো মোট সাত ঘন্টার মতো। আর ঢাকা থেকে লন্ডন পৌঁছতে তখন লাগতো নয় ঘন্টার মতো। ভ্রমণের জন্য একটা আরামপ্রদ জার্নি। মোট ১৬ ঘন্টার জার্নি ছিলো সেটা। এখন অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য ছুয়ে যাওয়া বিমান সংস্থা এমিরিটাস, কাতার, কুয়েতসহ বিমান সংস্থাগুলো মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক হওয়ায় যাত্রী বিমানগুলো একটু অন্য রুটে ঘুরে যায় বিধায় শুধু আটলান্টিক পাড়ি দিতেই প্রায় এগারো ঘন্টা লেগে যায়। সেই আটলান্টিক দুঃস্বপ্ন জড়িয়ে ধরে আছে বন্ধু নিজামের বুক জুড়ে। একসময় ও ছিলো আমার নিউইয়র্কের প্রতিবেশী। নিজাম অবশ্য থাকতো আমার থেকে অনেকখানি দূরে, দেখা না হলেও কথা হতো প্রায় রোজই। সবটুকুই ছিলো ওর বুক ভাংগা দুঃখের কথা। দেশ থেকে প্রথম বার আমেরিকা আসার সেই সুখকর ফ্লাইটের উড্ডয়নকালীন সময়ই আমার বন্ধু পতœী চিরবিদায় নিলেন স্বামীর ঘাড়ে মাথা রেখে। দেশে থাকতে গ্রাজুয়েশন করেই ও একটা ঔষধ কোম্পানীর চাকুরীতে ঢুকে গেল। আর আমি উঁচ্চশিক্ষার নেশায় ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস আর নতুন নতুন বন্ধু বান্ধবীর মোহময় পরিবেশে কয়েক বছর কেটে গিয়েছিল। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার নেশাই আমাকে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো অনেকগুলো বছর। ঔষধ কোম্পানীর চাকুরী শেষ করে আমেরিকা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওর মেয়ের কাছে অবসর জীবন কাটাবে বলে।
কিন্তু বিধি বাম আটলান্টিক ওর সেই স্বপ্ন আর পূর্ণ করতে দিলা না। সে কাহিনী বলতে বলতে এখনো আবেগে ওর কন্ঠ স্তদ্ধ হয়ে আসে। মাঝ আকাশে থাকতেই হঠাৎ করে ওর স্ত্রীর মাথাটা ওর ঘাড়ের উপর নেতিয়ে পড়ে। হার্টের অসুখ আগেই ছিল কিন্তু সেটা যে এত দূর এগোবে সেটা ধারণাই করেনি। নিজাম চমকে ওঠে প্রথমে আলতো ধাক্কা দিলেও কোন নড়াচড়ার ভাব বুঝতে না পেরে এ্যাটেন্ডেন্টকে ডাক দেয়, পরে সবাই বুঝতে পারে সময় শেষ। ‘সিভিয়ার এ্যাটাক’ এ সব শেষ। মাঝ সাগরে আর কোথাও কোন এয়ারপোর্টেও নামার উপায়ও ছিলো না। এখন আমারো কেন জানি মন আর পাড়ি দিতে চায় না ঐ মরন সাগরকে। যে সাগর নিজামের নিজের সুখের স্বপ্নগুলোকে তছনছ করে দিয়ে গেছে টর্নেডোর মতো, ওগুলো মনে হলেই এখনো বিষাদে মনটা ভরে ওঠে। সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজামের অশ্র দুঃখেভরা চেহারাটা। ওর স্ত্রীর হঠাৎ করে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে বিমানের ক্রুসহ আটলান্টিকের উপর উড্ডয়মান বিমান যাত্রীদের মধ্যে থাকা চিকিৎসকেরাও ওকে রক্ষা করতে পারেননি। নিজাম ভালো মানুষ, সারাজীবন মেডিকেল প্রফেশনে কাটিয়ে দিয়েছে মেটামুটি সততার সাথেই। প্রচন্ড ভালোবাসতো নিজের স্ত্রীকে, যদিও ওদের সেটেল্ড ম্যারেজ ছিলো। বিবাহ পরবর্তি দিনগুলিতে দু’চারটা ছোট খাট রোমাঞ্চকর বিদেশ ভ্রমণও যে করেনি তা নয়, দেশে থাকতে চাকরীর মধ্যেই বউকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরেও বেড়িয়েছে।
একটু বেশি রোমান্টিক চরিত্রের কারণে ওর স্ত্রীর আব্দারে ও একটু আধটু বেশিই সাড়া দিতো। নিজামের বাবার সংসারের সদস্য সংখ্যা একটু বেশি হওয়ায় সংসারটা খুব একটা স্বচ্ছল ছিলো না। নিজের বাড়তি কিছু খরচ মেটাতে নিজে প্রাইভেট টিউশনারী করে চালিয়ে নিতো।
নিজাম নিজে ছাত্র হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলো না। পারিবারিক অথবা নিজের বিভিন্ন চাহিদা মিটানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে টিউশন করা শুরু করে দিলো। তখন অনেকেই এটা করতো। মফস্বল শহরের অনেক চাকুরীজিবী পরিবারের অনেকেই এই শ্রেণীর ছাত্রদের দিয়ে তাদের সন্তানদের গৃহশিক্ষকতা করাতেন। এতে সংসারের জন্য বিষয়টা অনেকটা সাশ্রয়ও হতো। যেখানে ওর মেয়ে তার বাচ্চাদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলো তাদের নানা-নানীকে অভ্যর্থনা করার জন্য। আর সেখানে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হলো লাশের জন্য। কি নির্মম কষ্ট। কি নিষ্ঠুরতা। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ডেথ সার্টিফিকেট, কাষ্টম ঝামেলা, ইমিগ্রেশন ঝামেলা মিটাতে। ওরা আমাদের দেশের মতো হাতে হাতে লাশ ধরিয়ে দেয় না, ওদের তত্বাবধানে বডি গোরস্থানে দিয়ে আসে। কবরে নামানোর সময় শুধু মুখ দেখতে দেয়।
এখনো নিজাম নিউইয়র্ক শহরে মেয়ের সাথেই বাস করে। একাকী নাতীদের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়। অবসরে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকে উদাস নয়নে, হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া জীবন সংগীনি, ভালোবাসার প্রেয়সীর মুখটা কল্পনা করে। যে স্বপ্ন নিয়ে সন্তানদের সাথে দেখা করতে এসেছিলো সেটা ছাড়াই ওদের মা চলে গেল শুধু আটলান্টিকের মত গভীরতাময় বেদনা নিয়ে নিজামকে একা ফেলে। একাকীত্বই যে নিজামের এখন চির সাথী, তাই অবসরের সময়গুলোকে পার করে নিতে নাতীগুলোর সাথে সময় কাটায়। মলিন মুখে শুন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভালোবাসার সেই হারিয়ে যাওয়া মুখাবয়বটা আকতে চেষ্টা করে। আর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে হাতড়ে বেড়ায় অহর্নিশ। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, হিউষ্টন, ইউএসএ