মণিজিঞ্জির সান্যাল : প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত মানুষ নিজেদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা আর ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে নৃত্যকে। কালের বিবর্তনে শিল্পপ্রেমিক মানুষেরা তাই নৃত্যকে মর্যাদা দিয়েছেন অন্যতম প্রধান ‘কলা’ হিসেবে। নৃত্যের কালযাত্রার বিভিন্ন ক্ষণ, ধরন আর বাঁক নিয়ে ‘বাংলা কাগজ’ এ ধারাবাহিকভাবে লিখছেন লেখক ও নৃত্যশিল্পী মণিজিঞ্জির সান্যাল।
নৃত্যের ইতিহাস
পর্ব : এক
নৃত্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা ও পর্যলোচনার শুরুতেই প্রথমেই মনে প্রশ্ন আসে নৃত্য মূলত কি? নৃত্যের সংজ্ঞাই বা কি হতে পারে? মানুষের মনের অনুভূতি বিভিন্ন দৈহিক ভঙ্গিতে বা মুদ্রায় উপস্থাপনের নামই হল নৃত্য।
শিল্পকলা হিসেবে নৃত্যের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
(১) নৃত্য মানুষের একটি প্রাগৈতিহাসিক কলা।
(২) নৃত্য মানুষের নান্দনিকতা ও অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম।
(৩) নৃত্য সমস্ত জনগোষ্ঠীর কাছেই সাংস্কৃতিক চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
(৪) আদিমকাল থেকেই মানুষের আনন্দ প্রকাশ এবং বিনোদনের একটি প্রধান দিক ছিল নৃত্য।
(৫) পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর নৃত্যের ভঙ্গিমার মধ্যেই একটি বৈচিত্র লক্ষ করা যায়।
(৬) প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নৃত্যকলার সাথেই যুক্ত থাকে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র সাজপোশাক।
বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নৃত্যকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা — ধ্রূপদী নৃত্য, আদিবাসী নৃত্য, লোক নৃত্য, আধুনিক নৃত্য।
সামাজিক ইতিহাস চর্চায় নৃত্যের ইতিহাসের একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে।
যেমন —
(১) নৃত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দিকের পরিচয় ও সামাজিক অনুভূতি প্রকাশের ধরন সম্পর্কে জানা যায়।
(২) ভারতের নৃত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে দেবদাসী প্রথার কথা জানা যায়। প্রাচীনকালে অবিবাহিত নারীরা অনেক সময় দেবতাদের কাছে নিজেদের আত্মনিবেদন করতেন। দেবতাদের বিনোদনের জন্য নৃত্য, গীত সহ মন্দিরে নানা সেবামূলক কাজের সঙ্গে দেবদাসীরা যুক্ত থাকতেন।
(৩) নৃত্য থেকে সামাজিক ইতিহাস চর্চার নানা উপাদানও পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে আদিবাসী সমাজের নৃত্যের ধরনের কথা বলা যায়। আদিবাসী সমাজে কোন একক নিত্য নেই। তারা যৌথভাবে সঙ্গবদ্ধ হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন। এটি থেকে তাদের জোট বদ্ধ সমাজজীবনের ঐতিহ্যের কথা জানা যায়।
(৪) সবশেষে বলা যায়, নৃত্যের ইতিহাস চর্চা থেকে যে কোন নৃত্যের উদ্ভবের পশ্চাৎপটের ইতিহাস এবং নৃত্যকলার বিভিন্ন ধারাগুলো সংক্ষেপে জানতে পারা যায়।
মানুষের মনের মধ্যে নানান রকম প্রশ্ন জাগে। আসলে মনটাই তো একটা আস্ত পৃথিবী। আর সেই পৃথিবীর আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে যেকোনো পথের শুরুটা জানতে মন চায় বৈকি! তেমনই মনে প্রশ্ন জাগে এই নাচ নিয়ে। কিভাবে শুরু হল এই নাচ। ঠিক কোন সময়টাতে শুরু হল এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই নাচের সূত্রপাত ইত্যাদি।
পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এই নাচ বা নৃত্যের ইতিহাস উদ্ধার করা কঠিন। এই কারণেই কঠিন কারণ নাচ প্রায়শই স্পষ্ট সনাক্তযোগ্য শারীরিক নিদর্শন যেমন পাথরের সরঞ্জাম, শিকারের সরঞ্জাম বা গুহা চিত্রকর্মের মতন কখনই পেছন ছেড়ে যায় নি। নাচ যে কখন মানব সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠল তা নির্ভুলভাবে সনাক্ত করা সম্ভব নয়।
নাচের এই প্রেরণা আদিম যুগের মানুষের মধ্যে ছিল। সেই সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আচার, উদ্যাপন এবং বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল এই নাচ। প্রত্নতাত্তি¡ক প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নাচের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন ভারতে ৩০,০০০ বছরের পুরানো ভীমবেটকা প্রস্তরক্ষেত্র চিত্রকর্ম এবং মিশরীয় সমাধির চিত্রগুলিতে খ্রিষ্টপূর্ব ৩,৩০০ বছর আগের নৃত্যের চিত্র তাই চিত্রিত করে। অনেক সমসাময়িক নৃত্যের রূপ প্রাচীন ঐতিহাসিক, লোক নৃত্য, আনুষ্ঠানিক নৃত্য, এবং জাতিগত নৃত্যে পাওয়া যায়।
ভীমবেটকা গুহার বর্ণনা সর্বপ্রথম ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ অধিকারি ডাবলু কিঙ্কাইট দ্বারা একটি পত্রিকায় পাওয়া যায়। এখানকার আদিবাসিদের কাছ থেকে জানা যায় যে এটি একটি বুদ্ধ স্থল ছিল। B.S.Bakonar একজন প্রথম পুরাতত্ত¡বিদ ছিলেন যিনি সর্বপ্রথম এই স্থানটির সন্ধান করেছিলেন। গুহার ভেতরের চিত্রকলা দেখার পর তার মনে হয় এই গুহার চিত্রকলার সঙ্গে ফ্রান্সের এবং স্পেনের চিত্রকলার কিছু সম্পর্ক আছে। তারপর তিনি ১৯৫৭ সালে একটি টিম গঠন করে এখানে কাজ করতে শুরু করেন এবং অনেক গুহা বসতি আবিস্কার করেন ।
ভীমবেটকা প্রাচীন এই গুহাটি ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের রায়সেন জেলায় অবস্থিত। রাজধানী ভূপাল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে রায়সেন জেলার আবদুল্লা শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে মোট ৭ টি পাহাড় আছে যার মধ্যে ভীমবেটকা পাহাড়ে প্রায় ৭৫০টিরও বেশি গুহা আছে। এখানে ভারতের মানুষ প্রথম বসবাস করেছে তার প্রমান পাওয়া যায় । এই গুহার ভিতরে অনেক পুরানো চিত্র আছে যা আজ থেকে প্রায় ৩০০০০ বছরের আগের চিত্র। এই চিত্রের রঙ ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। এটি মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণ কেন্দ্র। এটি দেখার জন্য প্রতিবছর দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন।
ভীমবেটকা গুহা নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। মহাভারতের ভীম নামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এই কাহিনি। ভীমবেটকা শব্দের অর্থ হল ভীমের বসার স্থান। কথিত আছে, পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের সময় এখানে বাস করেছিলেন। আর ভীমবেটকার সংলগ্ন লাক্ষাজুহার জঙ্গলেই দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চক্রান্তে লাক্ষা নির্মিত গৃহ সুকৌশলে নির্মাণ করেন। মধ্যপ্রদেশের এই জায়গাটির নাম ভীমবেটকা কেন, তারও একটি নির্দিষ্ট গল্প আছে মহাভারতে। অজ্ঞাতবাসকালে এখানেই জরাসন্ধের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের। একটানা দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল ভীম বনাম জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধ। শেষ দিন এখানেই জরাসন্ধকে পরাস্ত এবং হত্যা করেন ভীম। তারপর এই গুহাগুলির সামনের চাতালে একটি প্রস্তর খণ্ডে বসে বিশ্রাম নেন। সেখান থেকেই এর নাম ভীম কা পৈঠা বা ভীমবেটকা। ফলে ইতিহাস, পুরাণ, কথা উপকথা মিলিয়ে ভীমবেটকা এক রূপকথা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের বুকে।
নাচ সামাজিক যোগাযোগের একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যা আদিম মানুষদের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে আজকের সেরা নৃত্যশিল্পীদের দুটি নির্দিষ্ট জিন রয়েছে, যা তাদের ভাল সামাজিক যোগাযোগকারী হওয়ার প্রবণতার সাথে যুক্ত।
শুরুর দিকের অনেক উৎসব উদ্?যাপনের জন্য নৃত্য গুরুত্বপূর্ণ বা অপরিহার্য ছিল, যেমন মৌসুম উপলক্ষে, শস্য কাটা বা জন্ম ও বিয়ের অনুষ্ঠানগুলি সম্পাদন করা। এই জাতীয় নৃত্য সারা পৃথিবীতেই পাওয়া যায়।
নৃত্য ধর্মীয় বা শমনীয় রীতিতে পরিবেশিত হতো, উদাহরণস্বরূপ খরার সময় বৃষ্টি নাচ পরিবেশিত হতো। প্রাচীন চীনা গ্রন্থে বৃষ্টির জন্য শামানদের নাচের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিশরে কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নৃত্য। একইভাবে নৃত্য আফ্রিকানদের মধ্যে আচার এবং অনুষ্ঠানে অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। প্রচুর ভারতীয় ধ্রæপদী নৃত্য আচার অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হতো। মন্দিরগুলিতে এবং ধর্মীয় উৎসবগুলিতেও নৃত্য পরিবেশিত হতো। যেমন ভারতের রাস উৎসবের নৃত্য এবং তিব্বতের চাম নৃত্য।
চাম নাচ এক ধরনের মুখোশ এবং পোশাকধারী নাচ, যা তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পর্কিত এবং বৌদ্ধিক অনুষ্ঠানে পালিত হয়। এই নৃত্যের মাধ্যমে প্রায়ই সমবেদনশীল ভাবনাগুলোর প্রচার করা হয় এবং যারা দয়ালু, করুণাময় এবং সমবেদনশীল তাদের প্রশংসা করা হয়। চাম নাচকে এক ধরনের ধ্যান এবং ভগবানের পুজোর মত করে তুলনা করা হয়। চাম নাচে, সাধারণত সুরকারই প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং তিনি একটি করতাল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাল বজায় রাখেন। তবে ড্রাময়েন চাম নামক এক বিশেষ প্রকার চাম নাচে গিটার জাতীয় এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যাকে বলা হয় ড্রাময়েন। চাম নাচের মাধ্যমে মূলত, নবম শতাব্দীর খ্যাত র্ন্যিং-মা শিক্ষক পদ্মসম্ভব এবং অন্যান্য প্রমুখ ঋষিদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করা হয়।
ছিংহাই প্রদেশের কুমবুম আশ্রমের এক বিশেষ চাম নাচ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নাচের মাধ্যমে দুই বিখ্যাত তর্কশাস্ত্রবিদ মহেয়া এবং কমলাসিলার মহাবিতর্ক অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যদিও চাম নাচের উৎস কি তা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়, তবে চাম নাচ তন্ত্রবিদ্যার সাথে সম্পর্ক রাখে। হিমালয়ের পাদদেশ থেকেই এর উৎপত্তি এতে কোনো বিতর্ক নেই। অনেকের মতে অষ্টম শতাব্দী শেষ দিকে রাজা ত্রিসঙ দেস্টান এক আশ্রম বানাতে বাধা পেয়েছিলেন এবং তিনি গুরু পদ্মসম্ভবকে মন্দশক্তি দূর করতে আদেশ দেন, যাতে আশ্রম বানানো সম্ভব হয়। গুরু পদমসম্ভব খারাপ শক্তি দুর করার জন্য চাম নাচ করেন এবং সেখান থেকেই এই নৃত্যের উৎপত্তি।
চাম নাচে মুখোশ এবং উজ্জ্বল পরিধান ব্যবহার করা হয়। মুখোশ নানান অঞ্চলে নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি। কাঠ, পিতল, ব্রোঞ্জ এবং সুতির কাপড় এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। মুখোশে উজ্জ্বল রঙ দিয়ে কারুকাজ করা হয়। চাম নাচের বিশেষ পরিধান সাধারণত দৈনন্দিন কাপড়ের উপরেই পরা হয়। পরিধান উজ্জ্বল রঙের হয় এবং এর হাতগুলো অপেক্ষাকৃত চওড়া বানানো হয়। এমব্রডরি, কাঠ, ধাতু এমনকি প্লাস্টিকের ও নানা অলঙ্কার এতে ব্যবহার করা হয়।
ভূটান, তিব্বত, ভারতে এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়। ভূটানের প্রত্যেক জেলায় সেচু নামক এক বার্ষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে চাম নাচ সঞ্চালন করা হয়। সন্ন্যাসী, মঠবাসিনি এবং গ্রামবাসীদের দ্বারা এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়। রাজকীয় প্রদর্শন শিল্প শিক্ষায়তন এই অনুষ্ঠান পরিচলনা করে।
এছাড়া তিব্বতে সাধারণত মনলাম প্রার্থনাসভা অনুষ্ঠানে বহু দর্শকের সামনে এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতবর্ষে সিকিম, ধর্মশালা এবং লাদাখে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং ধার্মিক অনুষ্ঠানে চাম নাচ অনুষ্ঠিত হয়।
নৃত্যের আর একটি প্রাথমিক ব্যবহার নিরাময়ের আচারে। ব্রাজিলিয়ান রেইন ফরেস্ট থেকে কালাহারি মরুভূমি পর্যন্ত বহু সংস্কৃতি এই উদ্দেশ্যে নৃত্যের ব্যবহার ছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় নৃত্য ম্যাকাব্রেস অংশগ্রহণকারীদের রোগ থেকে রক্ষা করেছে বলে মনে করা হয়। যাইহোক; এই নাচের অতিরঞ্জিত বা নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ এবং সময়কাল কখনও কখনও ক্লান্তির কারণে তাদের মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে।
একটি সিংহলি কিংবদন্তি অনুসারে, কান্দিয়ান নাচের সূত্রপাত ২৫০০ বছর আগে, এমন একটি যাদু নৃত্যের আচার থেকে যা মন্ত্রমুগ্ধতা ভেঙ্গে এক রাজার রহস্যময় অসুস্থতা থেকে আরোগ্যলাভে সহায়তা করেছিল।
নৃত্যের প্রাথমিকতম কাঠামোগত ব্যবহারগুলির মধ্যে একটি সম্ভবত পরিবেশন শিল্পকলা এবং পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে ছিল। এটি কখনও কখনও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনুভূতি প্রকাশেও ব্যবহৃত হয়। এটি “ভালবাসা তৈরির” উৎসের সাথেও যুক্ত। লিখিত ভাষাগুলি সৃষ্টির আগে, এই গল্পগুলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম পদ্ধতি ছিল নাচ।
ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে, নাচের প্রথম দিকের উল্লেখ রয়েছে মহাকবি হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াডে । প্রথমদিকে গ্রীকরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সমস্ত আবেগকে প্রকাশ করে এমন একটি পদ্ধতি হিসাবে নৃত্য শিল্প তৈরি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইরিনিসদের নাচ। এই নাচ দর্শকদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার করে। গ্রিক দার্শনিক, অ্যারিস্টটলের, কবিতার সাথে নাচ স্থান পেয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন, কিছু নৃত্যশিল্পীরা ইশারায় ছন্দ প্রয়োগ করে আচার, আবেগ এবং ক্রিয়া প্রকাশ করতে পারে। বিশিষ্ট গ্রিক ভাস্করগণ নৃত্যশিল্পীদের আবেগ অনুকরণ করার জন্য তাদের মনোভাব অধ্যয়ন করতেন।
ভারতের নৃত্যের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভারতীয় নৃত্যকলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা–
(১) ধ্রæপদী বা ক্লাসিক নৃত্য
(২) লোক নিত্য
(৩) আদিবাসী নৃত্য
এক — ধ্রুপদী নৃত্য বা ক্লাসিক্যাল ডান্স
ধ্রুপদী নৃত্যকলা হল ভারতের প্রাচীনতম নৃত্যকলা। এখানে নাচের মুদ্রা ও ব্যাকরণ গুলি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন।
ভারতের উপমহাদেশে ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল নৃত্যের ৮টি ঘরানা লক্ষ্য করা যায়।
(১) ভরতনাট্যম — তামিলনাডু
(২) কত্থক — উত্তর পশ্চিম ভারত
(৩) কথাকলি — কেরল
(৪) মনিপুরী — মনিপুরী
(৫) ওড়িশি — উড়িষ্যা
(৬) কুচিপুড়ি — অন্ধ্রপ্রদেশ
(৭) মোহিনীঅট্টম — কেরল
(৮) সত্রিয়া — আসাম
ভারতের ধ্রুপদী নৃত্যকলার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন —
উদয়শংকর, অমলা শংকর, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, শম্ভু মহারাজ, কেলুচরণ মহাপাত্র,
রুক্মিনী দেবী, মল্লিকা সারাভাই।
দুই — লোকনৃত্য
লোকনৃত্য ধ্রæপদী নৃত্যের মতো কোন মুদ্রার ব্যবহার নেই। এটি ধ্রæপদী নৃত্য থেকে অনেকটাই সরল এবং সহজ। লোকনৃত্যে অনেকে একসাথে যৌথভাবে নৃত্য করে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের আলাদা আলাদা লোকননৃত্য আছে। আমাদের রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোকনৃত্য হল —
(১) ছৌ নাচ – পুরুলিয়া
(২) রাবণকাটা নাচ — বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
(৩) ঝুমুর নাচ — বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া
(৪) রনপা নাচ
(৫) রায়বেঁশে নাচ
তিন — আদিবাসী নৃত্য
আদিবাসীদের সহজ সরল জীবনধারার মতো আদিবাসী নৃত্যের মুদ্রাগুলোও সহজ সরল। সাধারণত সমান্তরাল তালে আদিবাসী সমাজের নাচের মুদ্রাগুলো প্রদর্শিত হয়। আদিবাসী সমাজে কোন একক নৃত্য নেই। পুরুষ ও মহিলা সকলে সমবেতভাবে একসঙ্গে যৌথভাবে এখানে নৃত্য পরিবেশন করেন।
আদিবাসী নৃত্যের দুটি উদাহরণ হলো —
সাঁওতালি নৃত্য এবং করম নাচ।
কিছু ভারতীয় নৃত্যকলার পরিচয়
(১) উত্তর ভারতের নৃত্যশৈলী — কত্থক, ওড়িশি
(২) দক্ষিণ ভারতের নৃত্যশৈলী — কথাকলি, ভরতনাট্যম
(৩) পূর্ব ভারতের নৃত্যশৈলী — মনিপুরী, সত্রিয়া, ছৌ নাচ।
(৪) দুটি আঞ্চলিক নৃত্যের নাম — রবীন্দ্রনৃত্য, ছৌ নাচ (বাংলা) ডান্ডিয়া (গুজরাত)।
(৫) দুটি লোক নৃত্যের নাম — রনপা নাচ, ঝুমুর নাচ।
(৬) দুটি আদিবাসী নৃত্যের নাম — সাঁওতালি নৃত্য, করম নৃত্য।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : লেখক ও নৃত্যশিল্পী, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত