কামাল কাদের : আমাদের দেশের সচীবদের দাপট চোখে পড়ার মতো। মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক কর্মীদের ক্ষমতার প্রভাব আজ আছে কাল নেই, তবে সচীবরা সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সদর্পনে ক্ষমতার চারিপাশে বিচরণ করে বেড়ান। সে জন্য তাদের মূল্যই আলাদা। কোন দল দেশ শাসন করছে অথবা কোন মন্ত্রী তার পদ হারালেন, সে নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সচীবরা হলেন মন্ত্রী, পাতি মন্ত্রীদের “লাইফ ব্লাড”। সত্যিকার অর্থে সচীবরাই দেশ চালান। এমনই একজন দাপুটে সচীব হলেন মিস্টার হাফিজুর রহমান। অর্থনীতিতে এম,এ,পাস করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস যোগ দেন। তার কয়েক বছর পর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে বিলেত থেকে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে ডিগ্রী নেন। বেশ দক্ষ অফিসার হিসেবে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন। রহমান সাহেবের বেশভুষা, চালচলন সবই যেন একেবারে সাহেবী কায়দায়। কি শীত, কি গ্রীষ্ম সব ঋতুতে তিনি “থ্রি পিস” সুট পরে থাকেন। ধুমপানে ভীষণ আসক্ত। সব সময়ে গোরা সাহেবদের মতো চুরুট অথবা পাইপ টানেন। মোট কথা, তিনি পুরোপুরি বিলেতি সাহেব, শুধু গায়ের রংটা ছাড়া। টাকা -পয়সা প্রচুর কামাচ্ছেন। টাকার পিছনে উনাকে ছুটতে হয় না, টাকাই উনার পিছনে ঘুর ঘুর করে। সরকারি বেতন যা পান সে তো হাতের ময়লা, আসল আয় হলো যখন সরকারি পর্যায়ে মক্কেলদের সাথে কাজের বিনিময়ে টাকা-পয়সা লেনদেন হয়। অবশ্য টাকা পয়সার লেনদেনটা তার পার্সোনাল সেক্রেটারি সেরে ফেলেন।

পৃথিবীতে এমন মানুষ আছেন যাদের অফুরন্ত ধন-দৌলত আছে, আর আছে অঢেল টাকা-পয়সা, সহায় সম্পত্তি। রহমান সাহেব হলেন সেই শ্রেণীর একজন। প্রায় প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি কাঁচা টাকা বাড়িতে নিয়ে আসেন। নগদ টাকা ব্যাংকে রাখার সাহস বা সমুচীন মনে করেন না, যদি কোনো বিপদে পড়ে যান। দামী গাড়ি, বাড়ি সবই আছে। দেশে ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া শিখিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াসে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। বছরের কয়েকবারেই স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশে ভ্রমণে যান, দামী হোটেলে উঠেন। মনে মনে জীবনটাকে সার্থক মনে করেন। এত কিছু খরচ করার পর ও প্রচুর টাকা পয়সা রয়ে যায়। খরচ করার আর জায়গা থাকে না। কখন সখনো ভাবেন, কিছু টাকা পয়সা দান খয়রাত করলে কেমন হয়? আবার ভাবেন, পাপের পয়সা কি সত পথে লাগানো যায়? এদিকে তিনি পাপ – পুণ্য ঠিকই বুঝেন। নাহ, তিনি এ ব্যাপারে আর কোনো মাথা ঘামাতে চান না।

রহমান সাহেবের তিন মেয়ে, এক ছেলে। একমাত্র ছেলে মন্জুর সদ্য আমেরিকা থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে বাপের জোরে এক নাম করা বেসরকারী ব্যাংকে বড়-কর্তা হিসাবে একটা চাকরি বাগিয়ে নেয়। তার বেতন আকাশ চুম্বি। খাওয়া থাকার কোনো খরচা নেই। ঢাকা শহরে নামি দামী জায়গায় তাদের বাসস্থান। মোট কথা “বাবার হোটেলে” মনে হয় বেশ সুখেই আছে। সত্যি কি তাই?। দারিদ্রতা যেমন মানুষকে চরম বিপদে ফেলে দেয়, তেমনি প্রাচুর্যও কখনো কখনো মানুষের জীবনকে অসহ্য মানসিক বেদনায় পীড়ন করে দিতে পারে। তারই আভাস আজ কাল মনজুরের মনে প্রাণে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে।
এদিকে মিস্টার এবং মিসেস রহমান তাদের ছেলে মনজুরের বিয়ের সমন্ধে চিন্তা ভাবনা করছেন।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মন্জুর একজন উপযুক্ত অবিবাহিত যুবক। তাই বাড়ির সবাই মনে করছেন, অনায়েসে দেশের কোনো মহারথী লোকের মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে। মানুষ ভাবে এক, হয়ে যায় আরেক। যেই বিয়ের ব্যাপারে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঠিক তখনই বিনা মেঘের বজ্রপাতের মতো মিস্টার এবং মিসেস রহমানের চিন্তাধারায় ছেদ পড়লো। একদিন মনজুর ভোরবেলায় কাউকে না বলে তাদের ডাইনিং টেবিলে একটা ‘চির কুট’ রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। চিরকুটে লেখা, “আমি অজানার উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পড়লাম। প্রতিদিনের এই পার্থিব জীবন আমাকে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই এই পরিস্থীতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলাম। জানি না সফল হতে পারবো কিনা। কি পেয়েছি, আর কি পায়নি সেটা উপলব্ধি করার জন্য আমার এই যাত্রা। আমার একান্ত অনুরোধ তোমরা আমাকে খোঁজার চেষ্টা করোনা। ইতি :- তোমাদের অভিযোগহীন পুত্র, মনজুর”।

ছেলের চিরকুটটি পড়ে রহমান সাহেব মাথায় হাত দিয়ে পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়লেন। একমাত্র ছেলের জীবনে এমন কি সমস্যা বা দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো যার জন্য সে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো। আসলে মনজুরের জীবনে বেশ কিছুদিন ধরে একটা হতাশার ভাব বিরাজ করছিলো। সে কিছুতেই মা-বাবার লাগামহীন কার্যকলাপ মেনে নিতে পারছিলো না। বিশেষ করে তার বাবার নীতিহীন কদর্যরূপ তার বিবেককে বারে বারে আঘাত করে যাচ্ছিলো। তারই ফলপ্রসূ, সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো কোন অজানা পথের উদ্দেশে।

খুব পুরানো নই এমন একটা মাইক্রোবাসকে সে “কারাভ্যানে” (ভ্রাম্যমান বাড়ি) রূপান্তরিত করলো। যার মধ্যে থাকছে একটা শোবার ঘর, সাথে থাকছে রান্নাঘর, লাউঞ্জ এবং টয়লেট। মোটকথা একজন লোক অনায়াসে তার প্রতিদিনের ব্যবহারিক কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পারবে। প্রথমে মনজুর ভাবছিলো এই প্রাচুর্য ছেড়ে হয়তো তার কারাভানে থাকাটা কষ্টদায়ক হবে, কিন্তু কিছুদিন থাকার পর অভ্যাস হয়ে গেলো। মনজুরের কাছে মনে হলো এ যেন বিরাট আকাশের নীচে এক স্বপ্নপুরী।

কারাভ্যানটি নিয়ে সে সারা বাংলাদেশে চষে বেড়াতে লাগলো, যেন খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া পাখীর মতো ডানা মেলে আকাশের বুকে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করছে। দেশের নানা জায়গায় ঘোরা ফেরা করে এক শহরতলিতে সে কিছুদিনের জন্য সেখানে থাকার মনস্থির করলো। জায়গাটার বেশ কিছু দূরে সে দেখতে পেলো চারিদিকে ইট দিয়ে ঘেরাও করা বহু পুরানো এক আলিশান বাড়ি, মনে হয় এক কালে কোনো জমিদার বাড়ি ছিল এবং সেই বাড়ির ফটক দিয়ে নানা ধরণের, নানা বর্ণের লোক যাওয়া আসা করছে। তার মনে কৌতূহল জাগলো, ব্যাপার খানা কি? তাই সে কোনো চিন্তা ভাবনা না করে ওই ভগ্ন বাড়িটিতে ঢুকে পড়লো।
সময়টা তখন ছিল সন্ধেবেলা। ভিতরে ঢুকে মনজুর যা দেখতে পেলো তাতে সে ঘাবড়ে গেলো। এ যেন রীতিমতো একটা অপরাদের আখড়া। সময় যত বয়ে চললো, ততই নানা ধরণের নোংরামি বাড়তে লাগলো। তা দেখে মনজুরের মন মানসিকতা অসুস্থ হবার জোগাড় হলো। পাশ্চাত্য দেশের অবাঞ্চিত তরুণ-তরুণীদের মতো কল্কে হাতে নিয়ে গাঁজা, ওপিয়াম, হিং অথবা ওই ধরণের ড্রাগ কম বেশি সবাই হুক্কার মতো হুশ হুশ শব্দ করে টেনে চলছে। পরিবেশটা যেন শীতকালের ঘন কুয়াশার মতো লাগছে। সেই সাথে মাইক্রফোনে কান ঝাল পারা করা সুরে গান বাজিয়ে “ডিস্কোর” নাচের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছে। এখানকার সবাই বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত, অতীত এক কালে ছিল কিন্তু মনে হয় না তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে। মনজুর ভাবছে এ সমস্ত অপরাধমূলক কাজকর্ম কার ছায়াতলে হচ্ছে এবং কে বা করা এর অর্থের মদতদাতা। আবার এও ভাবছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার তার কি প্রয়োজন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল, কে জানে কোন ঝামেলায় সে জড়িয়ে পরে!

আবার সে তার “ক্যারাভান” গাড়িটি নিয়ে অজানা পথ চলা শুরু করলো। চলার পথে অনেক অচেনা লোকের সাথে দেখা -সাক্ষাৎ হলো, আর তার সাথে সাধারণ মানুষের জীবন এবং জীবিকা সমন্ধে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতে লাগলো। এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরাঘুরি করে দিন কাটছে। একদিন শহর থেকে বেশ কিছু দূরে একটা “আশ্রমের” দেখা পেলো। যথারীতি সে আশ্রমের ভিতরে ঢুকে পড়লো। সেখানকার পরিপাটি এবং সুন্দর পরিবেশ দেখে মন্জুর রিতীমত অবাক। ভিতরের সমস্ত জায়গাটি জুড়ে মনে হলো যেন প্রাকৃতিক সৌন্দের্য্যে ভরা ছোট খাটো এক গ্রাম, শহরের জীবনের ব্যস্ততা যেন এখানে থমকে আছে। সাধারণ লোকের বসতি। চাওয়া পাওয়ার চাহিদা কম। আশ্রমটির মাঝে বিশ / একুশটি বাংলো টাইপের মত ঘর। উপরে টিনের ছাউনি, চারিদিকে বাঁশের তৈরী বেড়া এবং ফ্লোরগুলি ইট দিয়ে বাঁধানো। মনজুর পরীক্ষামূলকভাবে কিছুদিন এখানে থাকার কথা চিন্তা করলো। ম্যানেজারের সাথে দেখা করে সে একটা ঘর ভাড়া নিলো। আশ্রমের ম্যানেজার মিস সায়িদা খানম নামে এক সুশিক্ষিত, মার্জিত ভদ্র মহিলা। পরিচয়ের পর মনজুর জানতে পারলো কেন তিনি তিনি এই সাদা মাটা জীবন বেছে নিলেন। তারই ভাষায় বলা যায়, “মা -বাবার সাথে থাকতাম। এম,এস-সি পাশ করে ঢাকা শহরে একটা বেসরকারী কলেজে অধ্যপনার কাজ করছিলাম। প্রিন্সিপাল সাহেবের অতিরিক্ত শাসন, ছাত্রদের উছশৃংখল আচরণ আর তার সাথে পরীক্ষার সময়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো। এও দেখলাম সমাজের ধনী, প্রতাপশালী মানুষগুলো যখন নিজেকে “গড” ভাবতে লাগলো, তখনই তারা দুর্বল মানুষের সাথে পশুর মতো ব্যাবহার করা শুরু করে দিলো। দেখুন, আজকাল মানুষের মনুষত্ব কতদূর নীচে নেমে গেছে। তারপর প্রতিদিনের রাস্তায় জ্যাম জোট আর “ইঁদুরের মতো দৌড়ানো” এ যেন এক শারীরিক এবং মানসিকভাবে আমাকে পীড়া দিয়ে যাচ্ছিলো। হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। বন্ধুদের সাথে একবার এই এলাকায় বেড়াতে আসি। মানুষের জীবনে অভাব অনটন, দুঃখ কষ্ট শুধু বইয়ের মধ্যে পড়েছি, কিন্তু এর ভয়াবতা কত তা জানতাম না। এখানকার আসে পাশে লোকদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে আমার টনক নড়লো। এই সাধারণ মানুষদের জীবন যাত্রা কত কঠিন, তবুও তারা কত সুখী। তাদের নেই কোনো অস্বাভাবিক চাহিদা, তারা অল্পতে তুষ্ট, নিজেদের মাঝে আছে শুধু ভ্রাতৃত্বের ভাব। তাই আর কিছু না ভেবে পিছনের জীবন ছেড়ে দিয়ে এখানে চলে এলাম।

এখানকার জীবনটা ভালো লাগছে। যা কিছু উপার্জন করছি হয়তো বা আগের মতো প্রাচুর্য নেই, তবুও তা দিয়ে চলে যাচ্ছে জীবন। বিকেলে গরীব ছেলে মেয়েদের সাথে তাদের ইস্কুলের লেখাপড়ার কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। এ সমস্ত বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়ে মানসিক ভাবে যে স্বাদ এবং আনন্দ পাচ্ছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। এখানে এখন যা কিছু পাচ্ছি ,তা পেয়ে নিজেকে অনেক অনেক সুখী ভাবছি। মনে হয় গ্রীষ্মের তপ্ত রোদের আড়ালে এ যেন বসন্তের মৃদু বাতাস।

এটা সত্যি, পিছনের জীবনে বিলাসিতায় জীবন যাপনের ফলে প্রথম দিকে এখানে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে এই পরিবেশটিকে মানিয়ে নিতে শিখি। তারপর সব ঠিক হয়ে যায়। কারণটা আর কিছুই না, আমরা তো মানুষ, আর মানুষ মাত্রই অভ্যাসের দাস।

ঢাকা শহরের জীবন ছিল চলমান ঊর্ধ্বগতিতে। মনের ভিতর কেমন যেন এক বিদ্রোহী ভাব জেগে উঠলো, তাই চলে এলাম এখানে কিছুটা স্বস্তির আশায়। শহরে যে কৃত্রিম ভালোবাসা, সম্মান পেতাম তার চেয়ে এখানকার লোকজন শত গুনে আমাকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। তাদের এই শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা মাঝে মাঝে আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়।

যখন আমার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে সবুজ মাঠের মনোরম দৃশ্যের দিকে ক্ষনিকের জন্য তাকিয়ে থাকি, তখন মনে হয় এর চাইতে সুন্দর জীবন আর কি হতে পারে! ঐ দূরে খোলা মাঠে একদল ভেড়া অথবা ছাগল মনের সুখে ছুটা ছুটি করছে কিংবা নিজেদের মাঝে ঝগড়া করছে, আবার মিল ও হয়ে যাচ্ছে, এ বিরল দৃশ্য শহরে কি দেখা পাবেন? কোনো এক অলস দুপুরে শালবনে অথবা বটবৃক্ষে একদল পাখী কিচির মিচির করে মনের সুখে ভাব আদান প্রদান করছে, সে দৃশ্য দেখলে মনটা প্রশান্তিতে ভোরে উঠে। আবার যখন দেখি কোনো এক আম বাগানে হঠাৎ করে বয়ে যাওয়া বাতাসের ভা?ে আমের মুকুল গুলি ঝরে পড়ছে, তখন মনে হয় এ দেখা যে আমার মনের খোরাক, প্রাণের খোরাক। এতদিন আমি কোথায় ছিলাম!

কখনো কখনো পুরোনো বন্ধু- বান্ধবীরা আমার সাথে দেখা করতে আসে, আর আমার এ জীবন দেখে হতাশায় মরে যায়। বলে, “সাঈদা, এ কেমন জীবন? এতো প্রাচুর্য্য ছেড়ে কেন এরকম জীবন বেছে নিলি?” আমি উল্টো তাদেরকে বলি, “তোরাই তোদের জীবনকে এই পৃথিবীর শান্তি এবং সৌন্দর্য্য থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করছিস, আমি খুব ভালো আছি, কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই”।

কখন ও আবার মজার ব্যাপার দেখা দেয়। একদিন আমি আমার এই ছোট্ট ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছি, তখন পাশের ঘরের বান্ধবীর কাছ থেকে শুনি, তার ঘরে ইদুর ঘোরা ফেরা করছে, তখন ভয়ে সপ্তাহ খানিক ঠিকমত ঘুমাতেই পারিনি। অথবা দূর্ভগ্যক্রমে কোনো এক মাঝরাতে আমার ঘরের টিনের চাল হতে বৃষ্টির পানি ঝরে আমার বিছানার চাদর, বালিশ, লেপ ভিজে একাকার হয়ে যায়, আমি আমার সাধারণ জ্ঞানের দক্ষতা দিয়ে অতি দ্রুত একটা শুকনো তোয়ালে নিয়ে ছাদের ছিদ্র টিকে “সেলু-টেপ” দিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয় তখন নিজেকে অনেক গর্বিত মনে হয়। এই আশ্রমের ঘরটিতে যেটাতে আমি থাকি, সে শুধু আমার এবং আমারই। তাতে আমি অফুরন্ত শান্তি এবং স্বস্তি পাই।

আশে পাশের সাধারণ লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করেছি। তাদের সাথে খেলা-ধূলা, হই হুল্লোড় করে বেড়াই ।এদের মাঝে অনেক গরীব লোক ও রয়েছে, তাদের জীবনের হাসি -কান্না দেখি, সেই সাথে সম্পৃত্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। অনেক সময় গল্প গুজবে মশগুল হয়ে পড়ি। এখানকার জীবনের মধ্যে যে স্বাধীনতা পাচ্ছি, তারই স্বাদ নিয়ে বেঁচে আছি। এই স্বাধীনতার স্বাদ আমি আমার শহরের জীবনে পায়নি, তাই আমি এই বাকি জীবনটা এদের মাঝেই কাটাতে চাই।

টাকা পয়সা আমাদের জীবনে অতি প্রয়োজনীয়, তাই বলে অতিরিক্ত সম্পদ দিয়ে কি হবে? বিশেষ করে গরীবদের চুষে, অবহেলিত, দুর্বল মানুষদের ক্ষতি করে”। বিরাট এক লেকচার দিয়ে সাইদা তার কথার জের টানলো।

মনজুর মনযোগ দিয়ে সাইদার কথাগুলি শুনলো। সে সাঈদাকে বললো, আজব ব্যাপার তো, “আপনার চিন্তা ধারার সাথে আমার ভাবনার অনেক মিল রয়েছে। সংক্ষেপে বলতে পারি, আমরা একই পথের পথিক। আমিও আমার বিলাসীতা জীবন ছেড়ে দিয়ে এই অজানা পথে পা বাড়িয়েছি। অবশ্য অভাব অনটনের জীবন চাইনা, শুধু বেঁচে থাকার জন্য যত টুকু প্রয়োজন সেটুকু পেলেই হলো”। কিছুক্ষন নীরব থেকে সাঈদার কাছ থেকে মনজুর জানতে চাইলো, “আচ্ছা এমনকি হয়না, আমার দুজনে মিলে এই আশ্রমটাকে আরো সুন্দর করে গড়ে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের কাঠামোকে সুদৃড় করি?”

“নিশ্চয়, আপনার ধারণাটা আমার কাছে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ মনে হচ্ছ”, সাঈদা জানাল।
“তাহলে, আর দেরী কেন?” মনজুরের হাসি মাখা প্রশ্ন।
“তবে তাই হোক!” সাঈদার তড়িৎ জবাব। শেষ
e – mail :– quadersheikh@gmail,com