রাশেদ নবী : জন হিউ ম্যাকলেনান কানাডার একজন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসে কানাডার সমাজ ব্যবস্থা এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক চিত্র সু²ভাবে উঠে এসেছে। তিনি ১৯০৭ সালে নোভা স্কোশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯০ সালের ৯ নভেম্বর মট্রিয়লে মৃত্যুবরণ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আজ ৯ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু দিনে ‘বাংলা কাগজ’ এর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাচ্ছি।
‘দুই নির্জন প্রান্তর’ যখন প্রকাশিত হয়, ১৯৪৫ সালে, তখন কুইবেক এ ইংরেজ ও ফরাসীদের সম্পর্ক ছিল হিমশীতল। ফরাসীরা প্রধানত কৃষিজীবী ও ক্যাথলিক আর ইংরেজরা নগরবাসী ও প্রোটেস্টান্ট। ঐতিহাসিক কারণে তাদের মধ্যে যে বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়েছিল, এই আর্থ-সামাজিক কারণে তা আরো উঁচু হয়। এটা কারো অজানা ছিল না। কিন্তু হিউ ম্যাকলেনান (১৯০৭-১৯৯০)এই সাংস্কৃতিক সংঘাত সফলভাবে উপস্থাপন করে তার ‘টু সলিটুডস’ উপন্যাসে। প্রকাশানার বছরেই উপন্যাসটি অর্জন করে গভর্ণর জেনারেল এওয়ার্ড। এর প্রায় দুই যুগ পরে তা প্যারিস থেকে ফরাসিতে অনুদিত হয় অনুরূপ শিরোনামে। বাংলা অনুবাদে আমরা তাকে বলতে পারি, ‘দুই নির্জন প্রান্তর’। এই পঁচাত্তর বছরের পুরানা উপন্যাস আমাদের আগ্রহের বিষয় হতে পারে যদি আমারা জানতে কৌতুহলী হই যে বাঙালি ক্যানাডিয়ান হিসাবে আমরা এই দুই প্রান্তের কত কাছে বা কত দূরে।
ম্যাকলেলান এর ভাষ্যে, ‘দুই নির্জন প্রান্তর’ কানাডার উপন্যাস। যার অর্থ হল এই উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টির সময় ধরে নেয়া হয়েছে এদের কেউ ইংরেজি-ভাষী, কেউ ফরাসি-ভাষী, আর কেউ কেউ দ্বি-ভাষী। এদেরকে কোনো অভিন্ন শব্দ দিয়ে সনাক্ত করা কঠিন। ‘ফরাসি-ভাষীরা যখন “Candiens” শব্দটি ব্যবহার করে তখন তারা প্রায় সবসময় তাদের নিজেদেরকে বোঝায়। তারা জানে তাদের ইংরেজি-ভাষী দেশবাসীরা ‘ইংরেজ’। ইংরেজি-ভাষী নাগরিকরাও একই নীতি অনুসরণ করে। তারা নিজেদেরকে বলে ক্যানাডিয়ান, আর ফরাসি-ভাষীদের ফরাসি-ক্যানাডিয়ান।’
উপন্যাসটির কাহিনী সংগঠিত হয় দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্র্বতী সময়ে মন্ট্রিয়েল এর নিকটবর্তী একটি কাল্পনিক ফরাসি গ্রামে। এর গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তালার্দ এবং তার পরিবার্। তালার্দ একজন অটোয়া-কেন্দ্রীক রাজনীতিক এবং বড় ভূমিমালিক। সে এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর সহায়তায় গ্রামে একটা ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। তার ছেলে মারিয়াস এবং অন্যসব গ্রামবাসী তার বিরুদ্ধে। তালার্দ এর লক্ষ্য তার অন্তমূর্খীন গ্রামের রূপান্তর ঘটানো এবং ইংরেজ কানাডার সাথে একীভূত করা। তার ছেলে এবং তার গ্রামবাসীরা মনে করে এই রূপান্তর তাদেরকে ইংরেজ কানাডিয়ানদের অধীনস্থ করবে; তাদের নিজের গ্রামে তারা ইংরেজদের শ্রমিকে পরিণত হবে।
পঁচাত্তর বছর পরে এই পটভূমির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ম্যাকলেলান তালার্দ এর মাধ্যমে যে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিল তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। কুইবেক এর ৭৫ শতাংশ মানুষ এখন বাস করে শহরাঞ্চলে এবং কুইরেক এর ফরাসিরা এখন ইংরেজি ও ফরাসি উভয় ভাষায় শিক্ষিত। শিল্প, বাণিজ্য এমন কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ফরাসিরা ইংরেজ কানাডিয়ানদের খেকে পিছিয়ে নেই। এই নতুন পটভূমির প্রেক্ষিতে পনের বছর আগে কানাডার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ গভর্ণর জেনারেল, মিকাইল জঁ মন্তব্য করে যে কানাডার দুই নির্জন প্রান্তরের দিন শেষ। কিন্তু এখনও যখনই কোনো মত-পার্থক্যে দেখা দেয়, তখনই ইংরেজ ও ফরাসি উভয় গোষ্ঠীই যে অভিব্যক্তির আশ্রয় নেয় তা হল, দুই নির্জন প্রান্তর বা টু সলিটুডস।
আমারা বাঙালি ও অন্যান্য অভিবাসী গভর্নর জেনারেল এর সাথে একমত হয়ে বলতে পারি যে দুই নির্জন প্রান্তরের দিন সত্যি সত্যিই শেষ। তবে আমাদের অবস্থান হবে একটু ভিন্ন ও সর্বজনীন – তা শুধু ইংরেজ ও ফরাসি কানাডিয়ানদের দ্ব›েদ্বর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কানাডার বড় বড় শহরের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ এখন অশ্বেতাঙ্গ বা ‘দৃশ্যমান সংখ্যালঘু’ – মন্ট্রিয়েলে এক-তৃতীয়াংশের বেশি, অটোয়ায় এক-চতুর্থাংশের বেশি এবং টরন্টো ও ভাঙ্কুভারে প্রায় অর্ধেক। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা সহজে বলতে পারি যে কানাডার দুই মেরু বিভাজিত হয়েছে বহু মেরুতে। আমরা কানাডার নবীন অধিবাসী, এবং কানাডিয়ান আত্মপরিচয় নির্মাণে ইংরেজ-কানাডিয়ান ও ফরাসি-কানাডিয়ানদের আন্তসংগ্রাম আমাদের প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ হয় নি। কিন্তু আমরা জানি সেই সংগ্রামের আগে এই উভয় গোষ্ঠীকেই দীর্ঘকাল ধরে বোঝাপড়া করতে হয়েছে আদিবাসী গোষ্ঠীর সাথে, যে গোষ্ঠীকে কানাডায় বলা হয় ‘প্রথম জাতি’। যে সময়কালে ‘দুই নির্জন প্রান্তরের’ কাহিনী সংঘটিত হয়, সে সময়ে এই প্রথম জাতির কন্ঠস্বর ছিল স্তিমিত। ফলে তাদের কেউ এই উপন্যাসের চরিত্র হিসাবে স্থান পায় নি। স্পষ্টত স্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের প্রতিনিধি হিসাবে হিউ ম্যাকলেলান এর একমাত্র উদ্বেগ ছিল দুই প্রধান শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সংঘাত; প্রথম জাতি সে পরিচয়ের অংশ হতে পারে নি। দদুই নির্জন প্রান্তর’ প্রকাশিত হবার দুই দশক পরে, ১৯৬৫ সালে, ম্যাকলেলান ‘দুই নির্জন প্রান্তর পুনর্বিবেচনা’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপে ম্যাকলিন্স ম্যাগাজিনে। সেখানেও সে একই উদ্বেগ প্রকাশ করে ভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে।
সুতরাং এটা বলা অসমীচিন হবে না যে ‘দুই নির্জন প্রান্তর’ থেকে আমরা যা পাই তা হল কানাডিয়ান আত্মপরিচয়ের খণ্ডিত সামাজিক ইতিহাস যেখানে প্রথম জাতির পরিচয় অনুপস্থিত। এই ইতিহাস উপেক্ষা না করে আমরা বাঙালি কানাডিয়ান হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, যা চায় অন্য নবীন অভিবাসীরাও। অপেক্ষাকৃত নবীন অভিবাসী হবার কারণে প্রথম জাতির সাথে আমাদের আন্তযোগাযোগ ক্ষীণ। আমরা এবং আমাদের মত অভিবাসী গোষ্ঠী ভাষাগতভাবে ইংরেজ বা ফরাসিদের নিকটবর্তী হলেও সাংস্কৃতিকভাবে উভয়ের দূরবর্তী, আবার একই সাথে আমরা নবীন অভিবাসী গোষ্ঠীও একে অপরের দূরবর্তী। আমরা যতই ইংরেজি বা ফরাসি বলি না কেন, ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতি থেকে আসার কারণে আমরা সহজে একে অপরের সাথে একাত্ম হতে পারি না। আমরা সরকারিভাবে সবাই ‘দৃশ্যমান সংখ্যালঘু’ গোষ্ঠীর সদস্য কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমরা সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের বাসিন্দা। ‘দুই নির্জন প্রান্তরের’ খণ্ডিত সামাজিক ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমরা যত তাড়াতাড়ি আমাদের মধ্যে সেতু তৈরি করতে পারব তত তাড়াতাড়ি আমরা পরিচয়ের অভিন্ন ভিত্তি তৈরি করতে পারব।
সংখ্যালঘু হিসাবে বাস করার একটা বড় বিপত্তি হচ্ছে আত্মপরিচয়ের দ›দ্ব ও গোষ্ঠীগত অর্ন্তমুখীনতা। সংখ্যালঘু বাঙালি কানাডিয়ান হিসাবে আমরা প্রতিনিয়ত এই বিপত্তির সম্মুখীন হই। ‘দুই নির্জন প্রান্তরে ফরাসি-ক্যানাডিয়ানদের অন্তর্মূখীনতা থেকে আমরা জানতে পারি যে তা একদিকে যেমন তৈরি করে অপরাপর গোষ্ঠীর প্রতি সংশয় ও বিদ্বেষ, অন্যদিকে তা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে করে দুর্বল। আমরা অবশ্যই সেই সম্ভাব্য সংশয় ও দুর্বলতা এড়াতে চাই।
রাশেদ নবী : লেখক ও অনুবাদক, অটোয়া, কানাডা