ড: বাহারুল হক : (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিকালে বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশটা হাল্কা হয়ে গেল। আমার ছেলে সিদ্ধান্ত নিল রাতের খাবারটা বাহিরে কোথাও খাবে। ইন্টারনেট নিয়ে বসে গেলাম। দেখি ম্যানহাটনে বাসার কাছে কি আছে। পেয়ে গেলাম দুইটা। বাসা থেকে একেবারে কাছে, হাঁটা পথ। দুইটির একটি ফরিদা সেন্ট্রাল এশীয়ান কুইজিন এন্ড গ্রীল। অপরটির নাম কাশ্মীর ফুডস। স্ট্রীটের একই ইন্টারসেকশনের দুই বিপরীত দিকে এই দুই খাবার হোটেলের অবস্থান। ফরিদা একটি উজবেক হোটেল। অপর দিকে কাশ্মীর হলো একটি কাশ্মীরি হোটেল। প্রথমেই গেলাম কাশ্মীরি হোটেল দেখতে। গেলাম; ভিতরে ঢুকলাম। সামনের শো কেইসে রাখা আছে নানা রকম মিষ্টি। মিষ্টির পাশে আছে অন্য কিছু খাবার। আমি এবার ভিতরের অবস্থা দেখার প্রতি মন দিলাম। টেবিল, চেয়ার, মেঝে ইত্যাদি দেখে নিলাম; সেগুলো কেমন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন তাও দেখলাম। স্পেস দেখলাম। সর্বোচ্চ কতজন একসাথে বসতে পারবে তা দেখলাম। দেখলাম এক কোণায় দুইজন যায়নামাজ বিছিয়ে নামায পড়ছে। খাবার কি আছে, দাম কেমন তা জেনে নিলাম। কাষ্টমারের ভিড় ভাট্টা নাই। ত্রিশ শতাংশ চেয়ার খালি। কাশ্মীর দেখা হলে বের হলাম এবং হাঁটতে থাকলাম ফরিদার দিকে। দশ / পনের মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম ফরিদা হোটেলে। আমি গিয়ে দেখি ভিতরে প্রবেশের জন্য ফরিদার সামনে কয়েকজন কাষ্টমার দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদের পেছনে না দাঁড়িয়ে সোজা দরজায় গেলাম। যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে কাষ্টমারদের রিসিভ করছে তার সাথে কথা বললাম। আমার কথা শুনে সে খুব খুশি হলো এবং আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। দেখলাম এটা কাশ্মীরের চেয়ে ছোট। কাশ্মিরের মত অত কাষ্টমার একসাথে এ হোটেলে বসতে পারবে না\ তবে ভিতরে সবকিছু বেশ সুন্দরভাবে সাজানো এবং পরিস্কার। ছাদ বেশ ঊঁচু। দেয়ালে প্রতাপশালী উজবেক রাজা বাদশাদের ছবি টাঙানো আছে। তাদের সাজ পোশাক দেখে মনে হলো যেন মুঘল বাদশাদের দেখছি। রাজা বাদশাদের ভিড়ে আছে প্রখ্যাত উজবেক পুরুষদের ছবি। সে সব পুরুষদের তালিকায় আছে ওমর খৈয়াম, আল-বিরুনি, বাবুর। ওমর খৈয়াম, ইতিহাসের পাতায় অবাক বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভার এক অমর নাম। তার বহুমুখী প্রতিভার কারণে সারা বিশ্বের মানুষ ওমর খৈয়াম নামটির সাথে সুপরিচিত। তিনি তার সময়ের চেয়ে আধুনিক ছিলেন। তিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও জরাজীর্ণ ইতিহাস বদলে দিয়ে নিজেই রচনা করে গেছেন নতুন ইতিহাস। যদিও তিনি আমাদের কাছে অন্যতম সেরা মুসলিম কবি হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তিনি ছিলেন একাধারে একজন দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, হাকিম ও শিক্ষক। তিনি অত্যন্ত জটিল গণিত নিয়ে কাজ করেছেন। সেই তিনি আবার লিখেছেন আধ্যাত্মিক, প্রেম ও দ্রোহের মধুর সব কবিতা। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কাজ করেছেন এবং প্রণয়ন করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ বর্ষপঞ্জিকা। আবার কখনো চতুষ্পদী কবিতার অমর সঙ্কলন ‘রুবাইয়াত রচনা করেছেন। আধুনিক বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে তার হাতে, কাজ করেছেন ইউক্লিডিয় জ্যামিতি নিয়েও। ভূগোল, বলবিদ্যা, খনিজবিজ্ঞান, আইন, এমনকি সঙ্গীতও বাদ যায়নি তার জ্ঞানপিপাসার তালিকা থেকে। জীবনের শেষ দিকে এসে হয়েছেন শিক্ষক। শিক্ষাদান করেছেন ইবনে সিনার দর্শন ও গণিত বিষয়ে। তার ছিল তীব্র জ্ঞানপিপাসা, তাই প্রচুর বই পড়তেন। বই পড়ার ব্যাপারে তার কোনো বাছবিচার ছিল না। যে কোনো বিষয়ের বই তার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল। বলা হয়ে থাকে, তার বই পড়ার নেশার কারণেই তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হতে পেরেছিলেন। বাবুর ছিলেন ভারতে মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাবুরের পুরো নাম মীর্জা জহির উদ্দীন মোহাম্মদ বাবুর। তিনি সম্রাট হুমায়ুনের পিতা আর হুমায়ুনের পুত্র ছিলেন সম্রাট্ট আকবর। ভারতে মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলে বাবুর উজবেকদের চোখে একজন বীর এবং বাবুর উজবেক বলে উজবেকরা বাবুরকে নিয়ে গর্ব বোধ করে। বাহিরে অপেক্ষমান কাষ্টমারদের দেখেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম ফরিদার খাবার নিশ্চয় সুস্বাদু তা না হলে কাষ্টমারের এমন ভিড় থাকবে কেন। যাই হোক, আমি কাশ্মীর দেখলাম এখন দেখলাম ফরিদা। তুলনামুলকভাবে ফরিদাকেই আমার কাছে বেটার মনে হলো। কাষ্টমারদের গেট-আপ, সাজ- গোজ দেখে মনে হলো এটা মোটামুটি বিত্তবানদের খাবার ঘর। খাবারের দাম ও মনে হয় কাশ্মীরের চেয়ে বেশি হবে। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানলাম আমার ধারনাই সঠিক; খাবারের দাম কাশ্মীরের চেয়ে বেশি। যাই হোক, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ফরিদার অতিথি হবো। ম্যানেজারকে বললাম একটা কর্ণার আমাদের জন্য রাখতে। ঘন্টা খানেক পর আমরা দশ জন আসছি। রাতের খাবার আমরা ফরিদাতে সেরে নিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে ওয়েটার বিল নিয়ে এলো। টাকার এমাউন্টটা জানা হলে ভাবলাম অন্য সব ব্যাপারে উজবেকরা উজবুক হলেও টাকা-পয়সার হিসেবে কোন উজবুকি ভাব নাই; বরং ভারি টনটনে। আমার ছেলে বিল পরিশোধ করেলো। তার গেষ্টরা সবাই হাত তালি দিয়ে যুগপথ শোকরিয়া ও অভিনন্দন জানালো তাকে। ফরিদা থেকে বের হয়ে সবাই রাস্তায় আসলাম। বাহিরে রাস্তা ফুটপাথ নোংরা হয়ে আছে গাছের পারা পড়ে। আজ সারা দিন যে বৃষ্টি হলো বাতাস বইলো এ ঝরা পাতা তারই ফল। পাতা ছাতার ভিতর দিয়েই আমাদের হাঁটতে হয়েছে। আশ্চার্য, দিন কেটে গেল কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের কোন উপস্থিতি টের পেলাম না। টরন্টো হলে এতক্ষণে সব ছাপ হয়ে যেত। নাছির ভাইর সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বললাম। ফরিদার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হলো। সবাই বেশ পরিতৃপ্ত। ভাগিনা নিহাল চলে যাবে তার বাসায়। ওকে কাছে পেয়েছি (যদিও অল্প সময়ের জন্য), এটা একটা খুব আনন্দ স্মৃতি হয়ে থাকবে। সবার সাথে কোলাকোলি করে নিহাল বিদায় নিল সবার কাছ থেকে এবং পথ ধরলো তার রেল স্টেশনের দিকে। আমি তাকিয়ে থাকলাম।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, কে জানে আবার কবে দেখা হবে! যদি টরন্টো আসেতো খুবই ভালো হবে। যাই হোক হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে আসলাম সবাই। আর মাত্র একদিন থাকবো এই নিউ ইয়র্ক শহরে। বেশি রাত জাগলাম না। ঘুমিয়ে পড়লাম একটু তাড়া তাড়ি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। আকাশে মেঘ নাই, বায়ুর বেগ স্বাভাবিক। সুন্দর একটা দিনের সূচনা। আমি মর্নিং ওয়াক করবো বলে বাসা থেকে বের হলাম। নিচে নেমে একটু অবাক হলাম। দেখি কয়েক জন পরিচ্ছন্ন কর্মী নাছির ভাইদের বহুতল বিরাট ভবনের সম্মুখটা পরিস্কার করার কাজে ব্যাস্ত। ভবনের পোর্টিকো এবং পোর্টিকোর সাথে লাগোয়া ফুটপাথ পানি দিয়ে ধৌত করতেছে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। অবাক হলাম দেখে যে নিউ ইয়র্কের অন্য এলাকায় ঝাড়ু দিতেই পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সময় পায় না সেই নিউ ইয়র্কের একটা এলাকায় একটা ভবন পরিস্কার করতে ব্যাবহৃত হচ্ছে পানি! আমি ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম ভ্যাসেলের দিকে। চল্লিশ মিনিট পর ফিরে এসে দেখি সব পরিস্কার একেবারে ঝকঝকে। ভবনের রিসেপসনিষ্ট এবং নিরাপত্তা কর্মীদের কখনো ব্যাস্ত দেখলাম না। ওদেরকে খুব রিলাক্সড মুডে পাই সবসময়। আসলে অভিজাত এলাকার অভিজাত বাসিন্দাদের ভবন বলে কোন ক্যাওয়াস বা হাঙ্গামা নাই এবং সে জন্য ওরাও থাকে বেশ নিশ্চিন্ত। আমি কোন দিন এ ভবনের গেষ্ট রুমটা দেখিনি। আজ ধীর পায়ে গেলাম সেখানে। গিয়েতো আমি অবাক। মস্তবড় এক রুম অথচ একেবারে অতিথি শূন্য। ফাইভ ষ্টার হোটেলের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে দামি দামি সব সোফা চেয়ার, টেবিল, সাইড টেবিল দিয়ে।। আমি ঢুকে কিছুক্ষণ বসলাম। তারপর ফিরে গেলাম নাছির ভাইর বাসায়। আজ কোন তাড়া নাই। সিদ্ধান্ত নেয়া হোলো আজ আমরা জ্যাকসন হাইটসে যাব। তারপর সেখান থেকে চলে যাব ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ১১ মেমোরিয়াল এবং মিউজিয়াম দেখতে। জ্যাকসন হাইটস কুইনস বরোতে অবস্থিত একটা বহুজাতিক নেইবারহুড। বাসিন্দাদের অর্ধেকই অসাদা এবং এরা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ। এরা এসেছে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, ম্যাক্সিকোর মত গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশ থেকে। এখানে এশীয়ানদের সংখ্যাও কম নয়। এশিয়ার তিব্বত, নেপাল, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষও অনেক। মজার ব্যাপার হলো এরা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়নি। এরা এদের লোকজন নিয়ে পকেট সৃষ্টি করে রেখেছে। পকেটগুলো হয়ে গেছে এক একটা মিনি দেশ, যেমন, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এরকম। পৃথক পৃথকভাবে পকেট সৃষ্টি করলেও তারা কিন্তু এথনিক ওয়ার বা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হয় না। এই পৃথকতা কালচারের কারণে অন্য কোন কারণে নয়। অন্যভাবে বিচার করলে দেখা যাবে বহুজাতিক সব স¤প্রদায় এখানে বেশ মিলে মিশে আছে। একটু বেলা করেই বের হলাম আমরা। নাছির ভাইর গাড়ি ম্যানহাটন থেকে ছুটছে কুইনস-এর দিকে। কুইনসের শেষ প্রান্তে এই বহু আকাঙ্খীত জ্যাকসন হাইট্স নেইবারহুড। সেখানে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা আমাদের লক্ষস্থল। বার বার অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখে যাচ্ছিলাম আমার লোকদের, তাদের দোকান-পাট, ব্যাবসা বানিজ্য স্থল। আমার এক ভাই আমাকে বলেছিল- দাদা তুমি যখন দেখবে লোকজনের ভিড় আর সে ভিড়ের মধ্যে যদি শুনতে পাও- “ভাইসা, এমুই আইয়েন। আন্নের লগে কথা আছে”, তাহলে বুঝবে তুমি জ্যাকসন হাইটস এসে গেছ। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে দুপুর বেলায় পৌঁছে গেলাম জ্যাকসন হাইটস। কান খাড়া করে রেখেছি সেই মোহন বাক্যটি শুনার জন্য- “ভাইসা, এমুই আইয়েন, আন্নের লগে কথা আছে”। জ্যাকসন হাইটস একটি ঘন বসতিপুর্ণ এলাকা। প্রয়োজনের তুলনায় পার্কিং এরিয়া কম। যাই হোক, নাছির ভাই তার গাড়িটা রাখার জন্য একটু জায়গা পেলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। মনে পড়ে গেল সেই পুরানো প্রবাদ- ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কথা তোলার সুযোগ এখানে রয়ে গেছে। অবশ্য রাস্তা ফুটপাথ দেখে মনে হলো এ এলাকার প্রতি সিটি কর্পোরেশনের পর্যাপ্ত মনোযোগ নাই। আমি খুবই ব্যাথিত হয়েছি সে এলাকার সবচেয়ে চালু একটা খাবার হোটেলে (বাঙালী) ঢুকে। বিচিত্র রকমের খাবার তৈরি হয় এ হোটেলে। কাস্টমারের ভিড় লেগে আছে। বসার জায়গা সহজে পাওয়া যায়না। আমরা বসলাম। আমি গেলাম ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমটা হোটেলের সাথে মানায় না। ওয়াশরুমটার দৈন্যদশা দেখে বুঝলাম ওয়াশরুম যে একটা অত্যান্ত গুরুত্বপুর্ণ রুম এটা হোটেল মালিক বুঝে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এরা ওয়াশরুমকে কেন এত গুরুত্তহীন মনে করে বুঝলাম না। ইচ্ছা করলেই ওযাশরুমকে পরিস্কার ঝকঝকে রাখা সম্ভব। ফুটপাথে এটা সেটা বেচাবিক্রি হচ্ছে ছোট ছোট দোকানে। আমার স্ত্রী দেখে বললেন- কি ব্যাপার, এতো দেখছি ঢাকার গাওছিয়া মার্কেট। নাছির ভাই কি কি যেন কিনলেন। আমি এদিক ওদিক হাঁটলাম। তারপর আবার গাড়িতে। বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া করলাম। পড়ন্ত বিকালে নাছির ভাই আবার বের হলেন আমাদের নিয়ে।

এবার গন্তব্যস্থল ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ১১ মেমোরিয়াল এবং মিউজিয়াম। নিউ ইয়র্কে ২০০১ সনে সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে কি ঘটনা ঘটেছিল তা বিশ্ববাসী জানে। ৯/ ১১ বললেই মানুষের মনো জগতে ভেসে উঠে এক অভাবনীয় দুঃসহ স্মৃতি। সে ঘটনায় নিহত হয় প্রায় ৩০০০ হাজার মানুষ। তাদের স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে ঘটনা স্থলে তৈরি করা হয়েছে এক স্মৃতিস্তম্ভ আর এক মিউজিয়াম। স্মৃতিস্তম্ভটি আমি চতুর্দিক থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সত্যি বলতে কি, স্তম্ভটি আমাকে কোন ভাবেই আকর্ষণ করলো না। ওটা দিয়ে কাকে কি বুঝানো হলো তা-ও বুঝলাম না। যে কোন বিষয়ে আমেরিকার আছে সর্বোত্তম উত্কর্ষতা। এই বিষয়ে আরো বেশি উত্কর্ষতা দেখানোর সুযোগ ছিল বলে আমার মনে হলো। তবে সেদিন নিহতদের নাম অক্ষয় রাখার জ্ন্য অন্য যে ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। সেখানে বানানো হয়েছে দুইটি পুল। সে দুইটি পুল টুইন পুল হিসেবে পরিচিত। প্রত্যেকটা পুল বর্গাকৃতির। প্রত্যেকটা পুলের চার পাশের উঁচা পাড় থেকে পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে পুলের মধ্যে। বিরামহীনভাবে পড়ছে এ পানি। পানি পতনের কোন শেষ নাই। আমরা পুলের পাড়ের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে পানিপতন দেখলাম। পুল দুইটি বিশেষ এক কায়্দায় তৈরি করা হয়েছে; দিনরাত ২৪ ঘন্টা পানি ঝরে পড়ছে পুলে কিন্তু পুল পানিতে কখনো ভরে উঠছে না। পুলের তলদেশ দিয়ে পানি অন্যত্র সরে যায়। প্রত্যেকটা পুলের চতুর্দিকের পাড়ে লাগানো হয়েছে ব্রঞ্জের মোটা পাত। সে পাতের উপর খোদাই করা আছে ৯/১১ ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত ২৯৯৭ জন দুর্ভাগা মানুষের নাম। নিহতদের কারো কারো আপনজন এখানে এসে নামের উপর হাত রেখে আজো কেঁদে উঠে। টুইন পুল- এর কারণে সেখানে সর্বদা বিরাজ করে এক বেদনা বিধুর পরিবেশ। পুরো এলাকা অস্ত্রধারী পুলিশের নজরে থাকে সবসময়। পুরো এলাকা যে কোন রকম দুর্ঘটনা মুক্ত রাখাই এসব পুলিশের কাজ। সঁন্ধ্যা হলে সূর্য্য ডুবে গেলে পুরো এলাকা আলোয় ভরে উঠে। টুইন পুলস দেখা হলে চলে গেলাম মিউজিয়াম দেখতে। মিউজিয়াম দেখতে আসা ভিজিটরদেরকে কিছু বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়, যেমন এখানে ধুমপান এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ, ১০ বছর বা তার নিচের বয়সী কেউ মিউজিয়ামে ভিজিটর হিসেবে প্রবেশ করার অনুমতি পাবে না, ব্যাক্তিগত ফটোগ্রাফির অনুমতি থাকলেও বানিজ্যিক কাজে মিউজিয়ামে ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ। আর হলো সার্ভিস এনিম্যাল ছাড়া অন্য কোন চতুষ্পদী প্রানি নিয়ে কোন ভিজিটর মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে পারবেনা। আমরা ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ১১ মেমোরিয়াল এবং মিউজিয়াম দেখতে গেলামও শেষ বিকেলে । আবার জ্যাকসন হাইটসে ঘুরে ঘুরে আমরা হয়ে পড়েছিলাম ক্লান্ত। ফলে আমরা মিউজিয়াম আর দেখলাম না। ফিরে গেলাম বাসায়। নাছির ভাইর বাসায় সে রাত ছিল আমাদের শেষ রাত। রাত পোহালে আমরা ছাড়বো এই নিউ ইয়র্ক নগরী।