ডঃ বাহারুল হক : আমেরিকার শহরগুলোর মধ্যে টরন্টো থেকে সবচেয়ে কাছের শহর নিউ ইয়র্ক। প্লেনতো আছেই। দিনভর বাস-ট্রেনও চলে। বহু দূরের শহর ডালাস, সিকাগো, অস্টিন, হিউস্টন ঘুরেছি কিন্তু নিউ ইয়র্ক যাওয়া হয়নি। ঐ যে রবি ঠাকুর বলেছেন —
“দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু”।
এবার যাবো বলে পাকা সিদ্ধান্ত নিলাম। গত পরশু পুত্রকে নিয়ে বের হলাম; সাথে আমার স্ত্রী। গন্তব্যস্থল টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রাত তিনটায় পৌঁছে গেলাম বিমানবন্দরে। ‘চেক-ইন শেষ করে ছেলে চলে গেল বাসায়। আমি আর আমার স্ত্রী সিকিউরিটি- ইমিগ্র্যাশন শেষ করে পৌঁছে গেলাম বিমানে উঠার গেইটে। ভোর ছয়টায় ওয়াশিংটন অভিমুখে আমাদের ফ্লাইট। আসলে আমরা যাচ্ছি নিউ ইয়র্ক। তবে ফ্লাইট সরাসরি নিউ ইয়র্ক অভিমুখি নয়। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমান আমাদের টরন্টো থেকে নিয়ে যাবে ওয়াশিংটন। ওয়াশিংটন থেকে আরেক ফ্লাইটে যাওয়া হবে নিউ ইয়র্ক। সময় হলে আমরা উঠে গেলাম বিমানে। বিমানে ঢুকেই আমি অবাক। এত চিপা ছোট বিমান! বিমানতো না, যেন খাঁচা। আস্তে গিয়ে বসলাম সিটে। সিট তো না, যেন চাইল্ড কেয়ার হোমের বাবুদের চেয়ার। ষোলটি সারি। প্রতি সারিতে চারটি সিট। যাত্রীদের মধ্যে যাদের উচ্চতা ছয় ফুট বা তার চেয়ে বেশি তারা মাথাটা নুইয়ে ভিতরে হেঁটেছেন। বসার কিছুক্ষণ পর আমার খারাপ লেগে উঠলো। মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে। গরম লাগতেছে। পাশে বসা আমার স্ত্রীকে বললামÑ “ওভার হেড এয়ারের ফ্লো বাড়িয়ে দাও এবং তোমারটাও আমার দিকে ঘুরিয়ে দাও”। না, বাতাসেও কাজ হচ্ছে না। ঘাম বের হবার উপক্রম। কি করবো! চট করে সুয়েটার খুলে ফেললাম। না, কাজ হচেছ না। এবার সার্ট খুলে ফেললাম। গায়ে এখন শুধু সুতির একটা মোটা গেঞ্জি। হাঁ, এবার ভালো লাগছে। হাঁ, বিমানও এতক্ষণে উড়াল দিল। আমার দম বন্ধ হওয়া ভাব চলে গেল। বেঁচে গেলাম। অনেক ধরনের বিমানে চড়েছি আমি। কিন্তু আমেরিকান এয়ারলাইন্সের মত বনেদি এয়ারলাইন্সে আজ যে অভিজ্ঞতা হলো সেরকম আগে কখনো হয়নি। এক ঘন্টা পনের মিনিট পর বিমানের উড়াল শেষ হলো। ততক্ষণে আমরা আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনের মাটিতে। এবার লাউঞ্জে বসে অপেক্ষার পালা। দুই ঘন্টা পর উঠতে হবে আরেকটি বিমানে যেটি আমাদের নিয়ে যাবে নিউ ইয়র্ক সিটিতে। আশ্চার্য, যে বিমান থেকে নামলাম সে বিমানে যাত্রীদের কিছুই খেতে দেয়া হয়নি; এমন কি এক কাপ কফিও না। অথচ এটা ছিল একটি ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট- টরন্টো (কানাডা) টু ওয়াশিংটন (আমেরিকা) আর বিমান ছিল আমেরিকান এয়ার লাইন্সের মত এয়ারলাইন্সের বিমান। আমার স্ত্রী বললেন- “বড় এয়ারলাইন্সের ছোট বিমান; ছোট বিমানে ছোট আয়োজন।” আমি বললাম- “কোথায় দেখলে ছোট আয়োজন? কোন আয়োজনইতো নাই। এক কাপ কফিওতো নাই’। কথা বলে লাভ নাই। কফি খেতে হবে। ‘স্টার বাক’ গেলাম। কফি নিলাম একটা। দাম নিল চার ডলার। বাপরে! চার ইউএস ডলার! অর্থাৎ ৫.৬৫ কানাডিয়ান ডলার। অথচ ১.৮৫ ডলারে টরন্টোতে ভালো কফি পাওয়া যায়।
কফিটা হাতে নিয়ে যেই বসতে যাব স্ত্রীর পাশের চেয়ারে অমনি কফিটা হাত থেকে পড়ে গেল। আমরা বিমানবন্দরের গেটে অপেক্ষা করছিলাম যেই গেট দিয়ে আমরা নিউ ইয়র্কগামী বিমানে উঠবো। নিউ ইয়র্কগামী যাত্রীরা একে একে এসে গেটে জমা হচ্ছে: বোর্ডিংয়ের ডাক পড়লেই উঠে যাবে বিমানে। বোর্ডিংয়ের প্রায় সময় হলো। অপেক্ষমান যাত্রীদের সংখ্যা দেখে মনে হলো এটাও হবে ছোট বিমান। বোর্ডিংয়ের ডাক এলো; উঠে গেলাম বিমানে। এটাও ছোট বিমান, তবে আগেরটার মত তত ছোট নয়। এটা ন্যারো বডি এ ৩১৯ এয়ারবাস। এর প্যাসেঞ্জার ক্যাপাসিটি বেশি। বসতে গিয়ে দেখি আমার আর আমার স্ত্রীর সিট পাশাপাশি নয়। বিমানবালাকে বললে সে পাশাপাশি সিটের ব্যবস্থা করে দিল। অসম্ভব কর্মপটু সদা হাসি মুখের এক বয়স্কা বিমানবালাকে বললাম- “আমার সাথে পানি নাই। ঠিক দশটায় আমাকে ওষুধ খেতে হবে। আমার পানি দরকার। তোমাদের কাছে পানি হবে”? বিমানবালা চোখ উল্টিয়ে বললো- “বলো কি, পানি থাকবে না”? আমি একটু বাঁকা স্বরে বললাম- “না, তোমাদের কাছে তো খাবার দাবার থাকে না, তাই ভাবলাম হয়তো পানিও নাই’। না, পানি তুমি পাবে বলে বিমানবালা আমাকে আস্বস্থ করে চলে গেল। আমি তার চলে যাওয়া দেখছিলাম আর ভাবতেছিলাম এমন বয়স্কা বিমানবালাতো আমি অন্য কোন এয়ারলাইন্সের বিমানে দেখি নাই। এরকম কেন হলো! কোন কারণ নিশ্চয় আছে। থাকগে! বিমান আকাশে ছুটছে নিউ ইয়র্কের দিকে? ঠিক দশটায় সেই বিমানবালা হাতে এক গøাস পানি আর মুখ ভরা হাসি নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে। তাকাতেই বললো- “এখন দশটা, তোমার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে; এই নাও পানি”। আমি পানিটা হাতে নিলাম আর ভাবলাম কি আশ্চার্য! আমি দশটায় ওষুধ খাবো, পানি দরকার, তার কাছে শুধু জানতে চেয়েছিলাম পানি আছে কিনা। সে পানি, অষুধ, দশটা সবই মনে রেখেছে এবং ঠিক দশটায় পানি হাতে এসে আমাকে অষুধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বুঝলাম সে কত দায়িত্বশীল এবং এই বয়সেও কেন সে চাকুরিতে বহাল। ঠিক এক ঘন্টা চৌদ্দ মিনিট পর আমাদের বিমান নিউ ইয়র্কে অবতরণ করলো। ঐ টরন্টো-ওয়াশিংটন খাঁচা বিমানের মত এ বিমানেও যাত্রীদের কিছুই খেতে দেয়া হয়নি। বুঝলাম আমেরিকান এয়ারলাইন্স ছোট ট্রিপে কোন রকম খানা দেয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।
বিমান থেকে বের হয়ে এবার হাঁটা দিলাম। এক্সিট দেখে দেখে হাঁটছি। অনেকটা পথ হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম লাগেজ কালেকশন রুমে। সুটকেসটা বেল্ট থেকে নিয়ে বেরুবার দরজায় যেতেই দেখি ছেলেসহ আমার শ্যালক নাছির ভাই আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কাছেই নাছির ভাইর গাড়ি দাঁড়ানো। গাড়িতে উঠে বসলাম। নাছির ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন; তার পাশের সিটে আমি বসা। বসে বসে এদিক ওদিক দেখছিলাম। যেদিকে তাকাই দেখি একটা বৃক্ষ লতার উপস্থিতি একটা শান্ত নিরিবিলি ছায়া সুশীতল পরিবেশ। নাছির ভাইকে বললাম- “শহর কি অনেক দূরে? উঁচা উঁচা সব ভবন কোথায়?” তিনি বললেন- “এইতো আমরা বিমানবন্দরের চৌহিদ্দি পেরিয়ে মূল শহরে প্রবেশ করবো”। হঠাৎ বৃক্ষলতার মায়াবী বন্ধন ছিহ্ন করে গাড়ি মোড় দিয়ে মিশে গেল সেই পথে যে আছে শুধু ভবন আর ভবন। নাছির ভাইর গাড়ি থামে চলে, থামে চলে; গাড়িতে কোন গতি নাই। বললাম কি ব্যাপার? নাছির ভাই বললেন- “ট্রাফিক বেড়ে গেছে। রাস্তায় জ্যাম লেগে গেছে।” আমি বললাম- “ওহ ট্রাফিক জ্যাম? কি আর করা? বাসা থেকে ফোন আসে- “কি কর? এত দেরি হচ্ছে কেন”? নাছির ভাই স্ত্রীর সাথে সহাস্যে ঠাট্টা করলেন। বুঝলাম নন্দিনী নাছির ভাইর মধুরভাবে বন্দিনী। যাক, অনেক সময় ব্যায় হলেও সুন্দরভাবে বাসায় পৌঁছলাম। হাত মুখ ধুয়ে টেবিলের দিকে গেলাম। টেবিলের উপর চোখ ফেলে ভাবিকে বললাম, “ভাবি আমরাতো টরন্টো থেকে এসেছি”। ভাবি বললেন- “কোথা থেকে এসেছেন তা আমি কি জানি না”? আমি বললাম- “না, ভাবি, আপনি জানেন না। আপনি জানেন আমরা আফ্রিকার দুর্ভিক্ষকবলিত দেশ ইথিওপিয়া থেকে এসেছি”। ভাবি হেসে বললেন- “যাই বলেন না কেন, সব খেতে হবে”। কথা না বাড়িয়ে বসে গেলাম। তারপর আস্তে আস্তে খাওয়া শুরু করলাম। কুমিরের মত এক পেট খেয়ে বিছানায় চলে গেলাম। ভিষণ ঘুম ঘুম লাগছে। কাল রাতে একটুও ঘুম হয়নি। যেহেতু আমাদের টরন্টো-ওয়াশিংটন ফ্লাইট ভোর ছয়টায়, আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে রাত তিনটায়, এবং আমাদের বাসা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এক ঘন্টার দীর্ঘ পথ, আমরা বাসা থেকে রওয়ানা দিলাম রাত দুইটায়। রাত দুইটায় রওয়ানা হতে হবে জানলে কার আর বিছানায় গেলে ঘুম আসবে? আমরাও তাই বিছানায় শুয়েই ছিলাম; ঘুম আর আসেনি। হালকা নিদ্রায় কিছু সময় ব্যায় করলাম। বিকালে একটু ঝর ঝরে লাগতেছিল। নিউ ইয়র্ক নগরীও বিকালের হালকা রোদে বেশ আমোদিত। নাছির ভাই বললেন- “চলেন যাই আপনাদের নিয়ে কোথাও যাই। আমার শ্যালকের বাসা ম্যানহাটনে। তার বাসার কাছেই আছে এক আকর্ষণীয় স্থাপনা-ভ্যাসেল। এটি যে স্থানে নির্মিত হয়েছে সে স্থানের নাম হাই লাইন পার্ক। পার্কের ভিতরে এই ভ্যাসেলের অবস্থান। এটি ওভাল আকৃতির এক বিশেষ স্থাপনা। ভ্যাসেল একটি ষোল তলা ভবন যার উচ্চতা ১৫০ ফুট। এর ভিতর আছে ২৫০০ সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো এক বিশেষ কায়দায় একটার সাথে আরেকটি সংযুক্ত। নাছির ভাই আমাদের ভ্যাসেল দেখাতে নিয়ে গেলেন। চারদিকে হেঁটে দেখলাম। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। এটা কি জন্য দর্শনীয়, এটা দেখার কি আছে আমি কিছুই বুঝলাম না। কি দেখতে লোকজন আসতো, ভিতরে প্রবেশ করে কি দেখতো বুঝার সাধ্য আমার নাই। ভ্যাসেল কেন নাম হলো তাও বুঝলাম না। হাই লাইন পার্কের ভ্যাসেল দেখা হলো কি হলো না বলা মুস্কিল। তবে প্রবেশ অনুমতি থাকলেও আমি হয়তো প্রবেশ করতাম না। এই ভ্যাসেল কোনভাবেই আমাকে আকর্ষণ করেনি।
বলা যায় প্রবল বিকর্ষিত হয়ে নাছির ভাইকে তাড়া দিলাম অন্য কোথাও অন্য কিছু দেখার জন্য পথ ধরতে। আমরা হাই লাইন পার্ক ত্যাগ করে নাছির ভাইর গাড়িতে উঠে বসলাম। নাছির ভাইর গাড়ি এবার ছুটছে নিউ ইয়র্কের বর্তমান আকর্ষণ লিটল আইল্যান্ড পার্কের দিকে।
২০ মিনিট চলার পর আমাদের গাড়ি পৌঁছে গেল লিটল আইল্যান্ড পার্কে। এটি পাবলিকের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে ২০২১ সনে মে মাসে। অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই লিটল আইল্যান্ড পার্ক। পার্কটি দেখেই মন ভরে গেল। শহরের মধ্য দিয়ে বহমান হাডসন নদীর বুকে তৈরী করা হয়েছে এই পার্ক। প্রথমে নদীর বুকে স্থাপন করা হয়েছে টিউলিপ ফুল আকৃতির ১৩২টি পিলার। পিলারগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় পিলারতো নয় যেন বাগানে মাটি খুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ১৩২টি টিউলিপ। সবগুলো টিউলিপ একটা আরেকটার সাথে লাগানো। পিলার নির্মাণ শেষ হলে টিউলিপের কাপগুলো। মাটি দিয়ে ভরা হয়েছে। যেহেতু কাপগুলো একটা আরেকটার সাথে লাগানো তাই মাটি ভরাটের পর হয়ে গেল একটা মাঠ। যেহেতু মাঠটি মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিহ্ন এবং নদীর উপর ভাসমান তাই এর নাম দেয়া হয়েছে আইল্যান্ড আর এই আইল্যান্ড আকৃতিতে ছোট তাই এর নাম হয়েছে লিটল আইল্যান্ড। আইল্যান্ডের মাটি শক্ত হলে, প্রকৌশলী দ্বারা আইল্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেলে এই আইল্যান্ডকে পরিণত করা হয় এক দৃষ্টিনন্দন পার্কে। পার্কে রুপান্তরের কাজ শেষ হলে এটি হয়ে যায় লিটল আইল্যান্ড পার্ক।
পাবলিকের জন্য খুলে দেয়ার পর থেকে প্রতিদিন পাবলিকের ঢল নামে এই অনিন্দ সুন্দর পার্কে। পার্কটির রুপ দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল। তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গেল। বাসা থেকে বেরুবার সময় গরম কাপড় নিয়ে বের হইনি। তাই ঠান্ডা অনুভব করছিলাম।
নাছির ভাইও তাই আমাদের নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। রাতে আবার খাওয়া দাওয়া। টেবিলের উপর এলাহি কান্ড করে রেখেছেন ভাবি। ভাবি নাটোরের মেয়ে। আমি তাই বললাম- “ভাবি, নাটোরের কাঁচাগােল্লা কোথায়?” ভাবির উত্তর- “খুঁজেছি সারা নিউ ইয়র্কে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না বাংলাদেশের এই অমৃত”। (চলবে)