সিন্ডি ব্ল্যাকস্টক : (অতি স¤প্রতি কানাডার বিভিন্ন জায়গার ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুলের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর গণকবর আবিষ্কারের পর সারা কানাডা জুড়ে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ বিরাজ করছে। গিটসান ফার্স্ট নেশন এর সদস্য সিন্ডি ব্ল্যাকস্টক গত ৩০শে জুন ২০২১ তারিখে কানাডার পাঠকপ্রিয় পত্রিকা ‘ম্যাক্লিন্স’ এ শিক্ষার্থীদের বিষয়ে একটি কলাম লেখেন। সিন্ডি ব্ল্যাকস্টক কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ফার্স্ট নেশনস চাইল্ড অ্যান্ড ফ্যামিলি কেয়ারিং সোসাইটি, কানাডা’র নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সিন্ডি ব্ল্যাকস্টক এর কলামটি ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন ম মাসুদ হোসেন খান।)

সিন্ডি ব্ল্যাকস্টক: আমি বিশ্বাস করি আবাসিক স্কুলের মাটির নিচে সমাধিস্থ ছোট্ট হৃদয়গুলো নিশ্চিত করে যে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি অবিচার করার সময় শেষ হয়েছে।
আবাসিক স্কুলের বেঁচে যাওয়া ছাত্ররা জানত কোথায় শিশুদেরকে মাটি দেয়া হয়েছিল কেননা তাদের মধ্যে অনেককেই কবর খুঁড়তে হয়েছিল। ট্রুথ এন্ড রেকন্সিলিয়েশন কমিশনের কাছে তাঁরা সত্য প্রকাশ করেছে এবং এই প্রজন্মের ফার্স্ট নেশন, মেইতিস এবং ইনুইট শিশুদের প্রতি অবিচারের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য এবং যাতে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেটা নিশ্চিত করতে তাঁরা দেশকে ৯৪টি কাজের পরিকল্পনা (call to action) দিয়েছে। আমাদের কেউ কেউ তাদের কথা শুনেছিল, কিন্তু তাঁরা যা বলেছিল তা অধিকাংশের কাছে খুবই সংঘাতমূলক- তাই, মানুষ এগুলোকে ‘গল্প’ আখ্যা দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল। বেঁচে যাওয়া আদিবাসী শিশুরা অবশ্যই অনুভব করেছিল যে তাঁরা নিঃশব্দে চিত্কার করছিল।
কবর দেয়া শিশুরা তাদের পরিবার থেকে দূরে, স্কুলে ভয় ও একাকীত্বের সঙ্গে মারা গেছে। স্কুলগুলো ১৮৩০ এবং ১৯৯৬ সালের মধ্যে কানাডা সরকার ও চার্চ পরিচালিত অনেকটা পুনঃশিক্ষা ক্যাম্পের মত ছিল। অনেকেই বেঁচে যেত যদি জনকল্যাণের ভাবনা অটোয়াকে ১৯০৭ সালে ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্সের প্রধান চিকিত্সা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. পিটার হেন্ডারসন ব্রাইস প্রস্তাবিত জীবনরক্ষাকারীসংস্কার বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করত। ব্রাইস বুঝেছিলেন যে য²া রোগ পুষ্টিহীন শিশুদেরকে অন্যদের চেয়ে ২০ গুণ বেশি মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করছিল যখন ইন্ডিয়ানদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে অসম বাজেট এবং নিম্নমানের স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হত। ইভিনিং সিটিজেন ১৯০৭ সালে শিরোনাম করেছিল, “স্বাস্থ্যের নিম্নতম প্রয়োজনীয়তার প্রতি নিরঙ্কুশ অবহেলা” আর স্কুলগুলো ছিল “রোগের সত্যি কারের হট বেড।” অন্যান্য খবরের কাগজ লিখেছিল যে শিশুরা “মাছির মত মারা যাচ্ছে,” যা ১৯০৮ সালে আইনজীবী স্যামুয়েল হিউম ব্লেককে বলতে বাধ্য করেছিল, “কানাডা মৃত্যুর প্রতিরোধ যোগ্য কারণগুলি কাটাতে ব্যর্থ হয়েছে, এটি নিজেকে হত্যাযজ্ঞের অপ্রীতিকর ঘনিষ্ঠতায় নিয়ে আসে।”

কানাডা ব্রাইসের সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করে এবং তাঁকে ১৯২২ সালে সরকারী চাকুরি থেকে বিতাড়িত করে চুপ থাকতে না চাওয়ার জন্যে। একই বছর, ব্রাইস অটোয়ার বই বিক্রেতা জেমস হোপ এন্ড সন্স এর কাছে তাঁর “একটি জাতীয় অপরাধের গল্প” শিরোনামের প্যামফ্লেট নিয়ে যান। এরপর এমন আরও শিরোনাম প্রকাশিত হয়, কিন্তু এরপর গল্পটা থেমে যায়- আর শিশুরাও। ব্রাইস ১৯৩২ সালে মারা যান এবং কানাডার ইতিহাস থেকে তাঁকে মুছে ফেলা হয়। তাঁর পরিবার বিলাপ করেছিল যে, “কাজটা শেষ হল না।” তিনি অবশ্যই অনুভব করেছিলেন যে, তিনিও নিঃশব্দে চিত্কার করছিলেন।

ফার্স্ট নেশন, মেইতিস এবং ইনুইট বাবা-মায়েরা প্রায়ই এ ব্যাপারে কথা বলতেন কিন্তু তাঁদের কথায় কান দেয়া হতো না, আর মৃত্যুর ফাঁদে বাচ্চাদের পাঠাতে অস্বীকার করায় তাদের অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিল। যখন বাবা-মা কারাগারে, সরকার তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিল। কয়েক দশক ধরে, আবাসিক স্কুলগুলিতে শিশু নির্যাতন, অবহেলা ও মৃত্যুর রিপোর্টের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষ নিয়মিতভাবে ফেডারেল সরকারকে উদ্বেগ জানিয়ে ছিল। কানাডাকে বল মিডিয়া ঝড়ের অপেক্ষায় ছিল আর যথারীতি তাদের কাজ চালিয়ে যায়।
আমি ১৯৬৪ সালে উত্তর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেছিলাম। আমি ঐ স্কুলগুলোর কোন একটাতে থাকতে পারতাম কিন্তু আমি রক্ষা পেয়েছি। আমি মনে করতে পারি যে আমি ক্লাসে একমাত্র “ইন্ডিয়ান” শিশু ছিলাম আর ভাবতাম অন্য ইন্ডিয়ান শিশুরা কোথায়। শহরের মানুষদের একটা উত্তর ছিল- ইন্ডিয়ানরা এত নির্বোধ আর মাতাল ছিল যে তাঁরা শিখত না, এবং তাঁরা শুধু কল্যাণ ভাতা দিয়ে চলত।

ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কামলুপ্সের ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুলে ২১৫ জন শিক্ষার্থীর গণকবর আবিষ্কারের পর জুতা প্রদর্শনের মাধ্যমে শোক ও প্রতিবাদ জানানো হয়

আমি কয়েক দশক পরে আবাসিক স্কুলগুলো সম্পর্কে সত্য ঘটনা শুনতে শুরু করি। প্রথমে কেবল দুর্বলভাবে, এবং তারপরে ক্রমবর্ধমান শক্তি দিয়ে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা তাদের সত্যগুলি জানালেন, প্রচন্ড বেদনা নিয়ে, যাতে তারা নিশ্চিত করতে পারে যে এটি তাদের নাতিনাতনিদের ক্ষেত্রে কখনও ঘটবে না। এগুলি এখন বোঝা যাচ্ছে: কেন এত লোক মদ্য ও মাদক সেবন করে এই বেদনা দূরে রাখার চেষ্টা করে, কেন অন্যরা নিরুদ্দেশ হয়ে মারা গিয়েছে জনগণের অস্বাভাবিক নীরবতার মাঝে। সরকারের উপনিবেশিক প্রকল্পটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে, ভুল তথ্য দিয়ে এবং গতানুগতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী বিগত কালের ভয়াবহতা ও অবিচার সম্পর্কে কথা বলেছেন অতীত কাল ব্যবহার করে- সম্ভবত এই প্রজন্মের ফার্স্ট নেশন, মেইতিস এবং ইনুইট শিশুদের জন্য সরকারের চলমান মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যবস্থা সম্পর্কে জবাবদিহিতা এড়াতে পারে।
কানাডা বাচ্চাদেরকে আবাসিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেইন্ডিয়ান অ্যাক্ট ব্যবহার করেছিল এবং এটি এখনও কার্যকর রয়েছে। দেশ বলে যে আমি একজন “স্ট্যাটাস ইন্ডিয়ান”। আমার এমন একটি কার্ড রয়েছে যা এটি বলছে, তবে তার মেয়াদ কয়েক দশক আগে শেষ হয়ে গেছে এবং আমি এটি নবায়নের পরিকল্পনা করি না। আমি কানাডার বর্ণবাদী খেলার কোন অংশ চাই না।

তবুও আমি এই দুষ্ট উপনিবেশিক খেলায় একজন খেলোয়াড় এবং আপনিও। ১৯৬৬ সালে একটি রাজকীয় কমিশন এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ২০ বছরের পরিকল্পনা করেছিল এবং ব্রাইস এক শতাব্দী আগেও সরকারী সেবায় বৈষম্য তুলে ধরেছিল, তা সত্তে¡ও ইন্ডিয়ান অ্যাক্টটি এখনও বহাল রয়েছে।

ব্রাইসের প্রতিবেদনের একশো বছর পরে, ফার্স্টনেশনস চাইল্ড অ্যান্ড ফ্যামিলি কেয়ারিং সোসাইটি এবং ফার্স্টনেশনস অ্যাসেম্বলি ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার মামলা দায়ের করেছে। কানাডা এই মামলাটি পূর্ণ শক্তি দিয়ে লড়াই করেছে আইনগত কৌশলের উপর নির্ভর করে আদিবাসী শিশুদেরকে তাদের পরিবার থেকে পৃথক করে আবাসিক স্কুলগুলিতে বেশি খরচে রাখায় তাদের প্রতি যে বৈষম্য করা হয়েছে সে ব্যাপারে কোন রকম বিবেচনা না করে। এর ফলে তাদের অপ্রতিকারযোগ্য ক্ষতি আর কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালে, মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল কানাডাকে অবিলম্বে তার বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। সরকার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে কিন্তু ‘তা মানেনি। ট্রাইব্যুনাল আরও ১৯টি আদেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছে এবং কানাডার চলমান অমান্যতাকে যুক্ত করেছে শিশুদের অপ্রয়োজনীয় পালন স্থানের সাথে যেখানে তিনজন মারা গেছে।
আমি জানতাম বাচ্চাদের কফিনে কত খরচ হয় কারণ আমাকে তাদের জন্য প্রায়শই তহবিল সংগ্রহ করতে হত।
কানাডা সরাসরি বাচ্চাদের হত্যা করেনি — কিন্তু তাদেরকে এমন পরিস্থিতিতে রেখেছিল যেখানে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। জর্ডান রিভার অ্যান্ডারসনের মতো বাচ্চারা, যে ২০০৫ সালে পাঁচ বছর বয়সে একটি হাসপাতালে মারা গিয়েছিল, কখনও এক দিনের জন্যেও কোন পরিবারিক বাড়িতে থাকেনি, কারণ কানাডা এবং ম্যানিটোবা ফার্স্টনেশনস হওয়ার কারণে বাড়িতে তার যত্ন নেওয়ার খরচ দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। অথবা ১৫ বছর বয়সী শ্যানেন ক‚স্টাচিনের মতো একজন অনুপ্রেরণাশীলক্রি শিক্ষানুরাগী যিনি ২০১০ সালে তার পরিবার থেকে কয়েকশত মাইল দূরে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার আগে “নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় বিদ্যালয়ের” জন্য সারাজীবন লড়াই করেছিলেন, কারণ তাদের নিজ এলাকায় কোন উচ্চবিদ্যালয় ছিল না। থান্ডারবে, অন্টারিওর একটি নদীতে সাত জনফার্স্ট নেশন যুবককে পাওয়া গিয়েছিল, তারা সেখানে উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে গিয়েছিল কারণ ওটা ওয়াতাদের নিজ স¤প্রদায়ের এলাকায় একটি স্কুল তৈরি করতে পারেনি। অবশ্যই প্রতিটি শিশু মারা যায়নি, তবে কয়েক প্রজন্মের আবাসিক বিদ্যালয়ের ট্রমা এবং অসম ফেডারেল পাবলিক সার্ভিসের কারণে অন্যরা কখনও ট্যাপ থেকে পরিষ্কার জল বের হতে বা অন্য শিশুদের চেয়ে ১৪ গুণ বেশী সংখ্যায় পালন গৃহে বেড়ে ওঠেনি।

জুনের মাঝামাঝি, কমলা শার্ট এবং কমলা ফিতা পরিধানকারী ফেডারেল মন্ত্রীরা কানাডার পাসপোর্টে ফার্স্ট নেশনের নাম “অনুমোদন” দেওয়ার বিষয়ে এবং আরও ভালভাবে, আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের ঘোষণা কানাডার আইনে সংযুক্ত করার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। আমি এই সম্মেলনগুলি দেখতে পাইনি কারণ আমি তখন ফেডারেল কোর্টে কানাডার আইনজীবীদের দু’টি ট্রাইব্যুনাল আদেশ বাতিল করার চেষ্টা দেখছিলাম যেখানে ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট ব্যতিরেকে ফার্স্ট নেশনের শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করার ক্ষতিপূরণ (এবং তারা এখনও শিশু) এবং সংরক্ষিত এলাকার বাইরে আদিবাসী বাচ্চাদের জন্য সরকারী সেবা প্রদানে অর্থায়ন এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। আমি উত্তর-পূর্ব অন্টারিওর সেন্ট অ্যানির আবাসিক স্কুল থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সাথে একটি সংবাদ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলাম যারা ফেডারেল সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই থামিয়ে দিতে বলেছিল। সেই স্কুলটিতে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি বাড়িতে তৈরি বৈদ্যুতিল চেয়ার ছিল।

আমি বিশ্বাস করি যে কমলুপ এবং মেরি ভাল আবাসিক বিদ্যালয়ের মাটিতে সমাধিস্থ এই ২১৫ এবং ৭১৫ ছোট্ট সোনামণিদের আত্মারা এসেছে এটি নিশ্চিত করতে যে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচিত কর্মকর্তাদের সাথে ট্রুথ এন্ড রেকন্সিলিয়েশন কমিশন সম্পর্কে আমাদের কথা বলা চালিয়ে যাওয়া উচিত, এমনকি যদি আমরা মনে করি যে তাঁরা শুনছে না, কারণ শেষ পর্যন্ত তারা সকলেই ভোট কেন্দ্রে আমাদের কথা শুনবে।