মণিজিঞ্জির সান্যাল : কিছু কিছু নাম উচ্চারণ করলে মনটা খুব শান্ত হয়ে যায়। যেমন কিছু মানুষের সাথে কথা বললে মনটা ভাল হয়ে যায়। এমন কিছু পরিবেশও আছে যেখানে কিছুটা সময় থাকলে মনের ভেতর অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। তেমনই ভুটান নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর এক স্বর্গীয় অনুভূতি কাজ করে। সত্যি কথা বলতে কি অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্যে বা সত্যিই মনে শান্তি আনার জন্যে আর কোথাও নয়, সোজা চলে যেতে হবে এই ভূটানে। চোখ বন্ধ করে কিছু শব্দের ওপর ভরসা আর বিশ্বাস রেখে এই দেশটিতে একটিবার সশরীরে উপস্থিত হতে পারলেই বোঝা যাবে এই দেশটির মাহাত্ম্য। এমন সুন্দর স্নিগ্ধ শান্ত দেশ আর কোথাও নেই।
জানি এই মুহূর্তে পৃথিবীতে যে অসুখ চলছে সেক্ষেত্রে এখানে আসাটা সত্যিই সমস্যা। কিন্তু এই অসুখ তো চিরদিন থাকবে না।এই বিষাক্ত ভাইরাস একদিন চলে যাবেই যাবে, আর ঠিক তখুনি প্রস্তুতি নিয়ে উপস্থিত হওয়া যেতেই পারে এই মনোমুগ্ধকর ভূটানে, যাকে এক কথায় স্বপ্নের দেশ বলা যেতে পারে।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ভারত ও চীনের মাঝে অবস্থিত এই রহস্যময় এবং সুন্দর দেশটি পর্যটকদের জন্য বন্ধ ছিল। অতীতে ভূটান পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত অনেকগুলো আলাদা আলাদা রাজ্য ছিল। ১৬শ শতকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে এর আবির্ভাব ঘটে। ১৯০৭ সাল থেকে ওয়াংচুক বংশ দেশটি শাসন করে আসছেন। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভূটান একটি বিচ্ছিন্ন দেশ ছিল।
শুনলে অবাক হতে হয়, ভূটানে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত টিভি ও ইন্টারনেট আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি থেকে সমগ্র দেশকে আলাদা করা অসম্ভব ছিল, তাই রাজা এই নিয়ম বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন।
এই ক্ষেত্রে, ভুটান টেলিভিশনের ব্যবহার শুরু করা বিশ্বের শেষ দেশ।
২০০৪ সালে জনগণের অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্য গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস কমিটি গঠন করা হয়। এমনকি জনগণের বিভিন্ন কথা লেখার একটি কলাম রয়েছে যেখানে দেশটির মানুষ জীবনে সন্তুষ্ট কিনা তা লিপিবদ্ধ করতে পারেন।
সুখ মন্ত্রণালয়ও আছে এবং যেটি গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) টার্মটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যারা মোট জাতীয় সুখকে পরিমাপ করে। সুতরাং, জীবনের মান, আর্থিক এবং মানসিক মূল্যের মধ্যে ভারসাম্য দ্বারা নির্ধারিত হয়।
এখানে কোন গৃহহীন মানুষ নেই। ভূটানে রাস্তায় বাস করে এমন মানুষ নেই। যদি একজন মানুষ তাদের বাড়ি হারান, তাদের শুধুমাত্র রাজার শরণাপন্ন হতে হয়। তার কাছে গেলেই তিনি জমি ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন যাতে করে তারা চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। সুতরাং, বুঝতে কোনো অসুবিধে নেই ভূটানের মানুষ অনেক না থাকা সত্তে¡ও কেন সুখি।
আরো একটি বিষয় শুনলে মন ভাল হয়ে যায়।

ভূটানের প্রতিটি নাগরিকের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ভূটানে পুরনো ঐতিহ্যবাহী ও শাস্ত্রীয় ঔষধ উভয়ই প্রচলিত এবং একজন ব্যক্তি চিকিৎসা পদ্ধতিতে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ভূটানের লোকেরা ঐতিহ্যবাহী জামা-কাপড় পরিধান করেন। পুরুষরা ভারী পোষাক পরেন এবং মহিলারা লম্বা পোশাক পরেন। একজন ব্যক্তির অবস্থা এবং সামাজিক স্তর তাদের বাম কাঁধে আবৃত স্কার্ফের রঙ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাধারণ মানুষ সাদা স্কার্ফ পরেন, ধনী মানুষ এবং ভিক্ষুরা হলুদ রঙয়ের পোশাক বেশি পরেন।

এই দেশের মানুষ শান্তি চায়, অধিক অর্থকে প্রাধান্য দেয়নি কখনো। ভূটানের রাজা দেশে তামাক চাষ এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করার একটি আইন প্রণয়ন করেছেন। দেশটিতে তামাক কেনা অসম্ভব। পর্যটকদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সংগ্রহ করে তারপর তামাক জাতীয় দ্রব্য বা সিগারেট সাথে নিয়ে যেতে পারেন।

ভূটানের প্রতিটি মানুষ প্রাণী এবং প্রকৃতি সম্পর্কে যতœবান। দেশটি সত্যিই পরিবেশ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন। এমনকি তারা ক্রমবর্ধমান গাছের দিকেও বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেন। ২০১৫ সালে, ভূটানের মানুষ মাত্র এক ঘন্টায় ৫০০০০ গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন।
এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধ। যেহেতু এই ধর্ম প্রাণীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, সেখানে নিরামিষের প্রচলন বেশি। তাদের প্রধান এবং মৌলিক খাবার ভাত। ভূটানের মানুষ চা পান করতে পছন্দ করেন। তারা লবণ, মরিচ এবং মাখন দিয়ে কালো এবং সবুজ চা পান করেন।

যদিও ভূটানের রাজা দেশটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তবুও তিনি পুরো দেশে প্রবেশের অনুমতি দেননি। ভূটান ভ্রমণে আপনি শুধুমাত্র একদল পর্যটকদের সাথে যেতে পারবেন। সমস্ত নথি এবং ভিসা একটি রাষ্ট্র নিযুক্ত কোম্পানী দ্বারা ইস্যু করা হয়। পারমিট পেতে, আপনাকে অগ্রিম সমস্ত খরচ দিতে হবে যেমন ফ্লাইট টিকিট, হোটেল, ফি, ট্যুর অপারেটর এবং গাইড পরিষেবা, ভিসা, এবং বীমা। দেশটিতে আপনি শুধুমাত্র গাইড সাথে নিয়ে ভ্রমণ করতে পারবেন। আপনার নিজে নিজে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ট্যুর অপারেটর সমস্ত পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক প্রোগ্রামের আয়োজন করেন। দেশের মধ্যে এবং বাইরে সমস্ত ফ্লাইট পরিচালনার জন্য কেবলমাত্র একটি বিমান সংস্থা রয়েছে এবং হোটেলগুলোর দাম (সস্তা বা দামি কিনা) সরকার দ্বারা নির্ধারিত হয়।

ভূটানে নারীরা সম্মানিত তাদের উত্তরাধিকার ঐতিহ্য যেটি প্রমাণ করে। তাদের বাড়ি, গবাদি পশু, এবং জমির মতো সব সম্পত্তি এবং জিনিসপত্র ছেলে নয়, পরিবারের বড় মেয়েরা পেয়ে থাকেন।
এই দেশে ইকোলজি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে কোন রাসায়নিক পণ্য আমদানি বা ব্যবহার করা আইন বিরুদ্ধ। তারা যে সব কিছু ব্যবহার করে তা দেশের ভিতরে চাষ করা হয় এবং এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।

ভূটানের ভেতর বিদেশিদের বিয়ে নিষিদ্ধ! রাজা বিশ্বের বাকি দেশগুলো থেকে তাদের অনন্যতা এবং বিচ্ছিন্নতা রক্ষা করতে সবকিছু করেন। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের সময়, ভিক্ষুকরা মন্ত্র পাঠ করেন। এটা বলা হয় যে, এই প্রক্রিয়া নববধূদের একটি শক্ত মানসিক সংযোগ নির্মাণ করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী, পুরুষ নারীর বাড়িতে আসেন এবং যখন তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন, তখন তারা অন্য বাড়িতে নিজেদের মতো থাকতে পারেন।
ভূটানের ঝকঝকে রাস্তাগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এই দেশের রাস্তায় কোন ট্রাফিক লাইট নেই। তবে, এটি মানুষের জন্য কোন সমস্যা নয়। সমস্ত রোড সাইনগুলো হাতে আঁকা। সত্যি বলতে এখানকার রাস্তাগুলো বেশ চমৎকার, ঝকঝকে, পরিস্কার।

ভূটানের লোকেরা তাদের বাড়ি ঘর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন। ভূটানের যে জায়গাটির নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তার নাম পারো। ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে নদীর কোল ঘেঁষে পারো উপাত্যকায় গড়ে উঠেছে ‘পারো’ নামের এক অপূর্ব সুন্দর শহর। এই সুন্দর শহরের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস ও নানা রকম গল্প। আর তাই ভ্রমণ প্রেমীদের জন্য ভুটানের ‘পারো’ একটি ঠিক ঠিক লক্ষ্য, যা পরবর্তীতে হয়ে উঠবে ভ্রমণের স্মৃতিময় আনন্দ।

ভুটানের রাজধানী থিম্পু হলেও পারো ভুটানের সবচেয়ে সুন্দর এলাকা। বর্ডার এলাকা ফুন্টশিলিঙ থেকে পারোর দুরত্ব প্রায় ১৫৯ কিলোমিটার। থিম্পু হাইওয়ে ধরে পারো যেতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। থিম্পু হাইওয়ের ছুজম এলাকা থেকে থিম্পু আর পারোর রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। ছুজম থেকে বাঁদিকে ঘুরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পেরোলেই পাহাড়ি উপত্যকা শহর পারো। পারো নদী আর আপেল বাগানে ঘেরা ঝকঝকে শহরে দু-তিন দিনের সফর আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে যে কোনো মানুষের।
পারো উপত্যকার দুর্গ আশ্রম রিনপুং ডিজং এর এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দশম শতকের শুরুতে এই স্থানে পদ্মসম্ভব প্রথম একটি আশ্রম স্থাপন করেন। ১৬৪৪ সালে পুরনো ভিত্তির উপর ঙ্গাগ-দ্বাং-র্নাম-র্গ্যাল (ভুটান) একটি বড় আশ্রম নির্মাণ করেন। শতাব্দীব্যাপী এই পাঁচতলা ভবনটি তিব্বতীয়দের বহুবিধ আক্রমণ থেকে একটি কার্যকর সুরক্ষা দিয়েছে।

কাদামাটির পরিবর্তে প্রস্তর দিয়ে গড়া এই ডিজং এর নাম রাখা হয়েছে রিনপুং যার অর্থ
‘রত্নের স্তূপ’। কিন্তু ১৯০৭ সালে অগ্নিকাণ্ডে রিনপুং এর ‘থংদেল’ নামক একটি তুলায় অঙ্কিত চিত্র ব্যতীত সব সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। অগ্নিকাÐের পর পেলপ দাওয়া পেঞ্জর, পারো ডিজংটি পুনর্র্নিমাণ করেন। এর দেওয়ালগুলো পবিত্র মুখোশ ও পরিচ্ছদে সুশোভিত। কয়েক শতক আগে দাওয়া পেঞ্জর অন্যদের সাহায্য করেছিল, আর তার উত্তরসূরী পেনলপৎশেরিং অধুনা এই কাজ করেন।

ডিজং পর্বতের উপরে একটি প্রাচীন পর্যবেক্ষণ কক্ষ রয়েছে যা ১৯৬৭ সাল থেকে ভুটানের জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাহাড়ের উপরে গ্রেগর থানবিচলের এর সৌধ ও প্রতিকৃতি আছে, যিনি ১৯৯৫ সালে ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। ডিজং এর নিচে একটি মধ্যযুগীয় সেতু বরাবর পেনলপ ৎশেরিং পেঞ্জর এর রাজকীয় ভবন ‘আগয়েন পেলরি প্রাসাদ’ অবস্থিত।

পারোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান তাকসাং মনাস্ট্রি বা টাইগার নেস্ট। শহরের খুব কাছেই আপেল বাগানের মধ্য দিয়ে গাড়ি করে সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন তাকসাং মনাস্ট্রির নিচে। এখান থেকে প্রায় ৯০০ মিটার খাড়া পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয় টাইগার নেস্ট বা তাকসাং মনাস্ট্রিতে। মনাস্ট্রিতে না উঠতে পারলেও নিচের পরিবেশ আপনার মন ভরিয়ে দেবে। এরপরে যেতে পারেন রিমপুং জং, গোলাকার নজরমিনার তা জং, কিচু গুম্ফা, যাদুঘর বা সংগ্রহশালা দেখে কাছের ভিউ পয়েন্ট থেকে পারো শহরের অপরূপ দৃশ্য দেখতে কখনোই ভুলবেন না।

পারো ভুটানের সবচেয়ে ঠাণ্ডা জায়গাগুলোর মাঝে একটি। শীত শেষ হয়ে গেলেও মাইনাস চার,পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এখানে স্বাভাবিক। পারোর মূল আকর্ষণ চেলালা পাস আর টাইগার্স নেস্ট। চেলালা পাস ভুটানের সবচেয়ে উঁচু মটোরেবল রোড, উচ্চতা সাড়ে ১২ হাজার ফিট প্রায়।
পারো ভ্রমণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে নভেম্বর, কারণ এই সময় আকাশ পরিষ্কার ও আবহাওয়া ভালো থাকায় ভুটানের প্রকৃতি অনেক সুন্দর ভাবে পর্যটকদের চোখে ধরা পড়ে। আর তখন পারো ভ্রমণে গেলে ভুটানিদের নানান উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়। আবার মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ভুটান ভ্রমণকারীদের সংখ্যাও কম নয়।

পারোতে দেখার মতো অনেককিছু আছে যা চোখ ও মনকে শান্তি দেয়। ভুটানিদের কাছে পারো একটি পবিত্র শহর। তাই এখানে চলার পথে নানা বৌদ্ধ উপাসানালয় চোখে পড়ে। এছাড়াও পারো শহরের সবখানেই আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের দেখা মিলে। আসলে পুরো শহরটাই দেখার মতো। তবুও কিছু বিশেষ উল্লেখযোগ্য দেখারমত জায়গা গুলো হলো-
রিনপুং জং — রিনপুং শব্দের মানে ‘ রত্নের স্তুপ ‘। এই রিনপুং জং হল পারো শহরের সবচেয়ে বড় দুর্গ। এখন মূলত এটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার জায়গা। এখান থেকে পারো শহর দেখতে খুব সুন্দর লাগে।
টা জং — রিনপুং জং এর পিছনে গড়ে উঠা ‘টা জং’ মূলত একটি জাদুঘর। যদিও একসময় এটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এখানে ভুটানের নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিভিন্ন চিত্রকর্ম রয়েছে।

ন্যাশনাল মিউজিয়াম — ভুটানের এক সময়ের প্রাচীন ডাকটিকিট ও মুদ্রার দেখা মিলবে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। এই মিউজিয়ামটি এক সময় তাজিং দুর্গ ছিল।
ড্রæকগিয়াল জং — ন্যাশনাল মিউজিয়াম থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে তিব্বতের সীমান্তে অবস্থিত ড্রæকগিয়াল জং একটি তাজিং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।
টাইগার্স নেস্ট বা টাইগার্স মনাস্ট্রি –পারো থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে পারো ভ্যালির একটি খাঁড়া পাহাড়ের চূড়ার উপর পারো টাইগার্স নেস্ট মন্দিরটি অবস্থিত। টাইগার্স মনাষ্ট্রিতে হেঁটে যাওয়ার পথটা বেশ সুন্দর। এখানে একটি কফি শপ রয়েছে। স্থানীয় ভুটানিদের কাছে মন্দিরটি তাক্তসাং বা তাকসাং নামেও পরিচিত। এছাড়া টাইগার্স নেস্টে ট্রেকিং করার সুযোগ রয়েছে।

কিচু মনাষ্ট্রি — কিচু মনাষ্ট্রির মূল ঘরটিতে গুরু পদ্মসম্ভবের একটি বিশাল মূর্তি স্থাপিত আছে। এছাড়া এখানে কমলালেবুর বাগান রয়েছে।
পারো চু — চু শব্দের অর্থ নদী। আর পারো চু হচ্ছে পারোর একমাত্র নদী। টলটলে স্বচ্ছ জল এই নদীর বিশেষত্ব, যা দেখলে মনটা শান্ত হয়ে যায়।
আয়রন ব্রিজ — থিম্পুর মহাসড়কের পাশে পারো নদীর উপর অবস্থিত প্রাচীন একটি স্থাপনা এই আয়রন ব্রিজ।
চোমো লহরি — ভুটান ও তিব্বতের বাসিন্দাদের কাছে ‘চোমো লহরি ‘একটি পবিত্র পর্বত।

ভুটানের মধ্যে ‘পারো’ হল থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা। এখানে মেইন রাস্তার পাশেই অনেক ধরনের হোটেল পাওয়া যায়। তবে পাহাড়ের উপরের কিছু হোটেলের দাম একটু বেশি।
আর খাবারের ব্যাপারে আমরা বাঙালিরা সেরার সেরা। খাদ্যরসিক বাঙালী, তাই যেখানেই যাই সবার প্রথমে আমরা ভাল ভাল খাবারের খোঁজে থাকি। তবে ভূটানে বাঙালি খাবারের দাম ভুটানিদের লোকাল খাবারেরে চেয়েও বেশি। তবে যারা মাছ মাংসের চেয়ে সবজি খেতে বেশি পছন্দ করেন তাদের জন্য পারোতে আছে নিরামিষ খাবারের নানা আয়োজন। আসলে ভুটানের পারোর বাসিন্দারা নিরামিষ খাবার বেশি পছন্দ করে আর প্রতিটি নিরামিষ খাবারই বেশ সুস্বাদু।

শপিং প্রেমীদের জন্য পারোতে কেনাকাটার মতো জায়গার অভাব নেই। হ্যান্ডিক্রাফট এম্পোরিয়াম থেকে বিভিন্ন স্যুভেনিয়র, হাতে বোনা কাপড়, কাঠের জিনিষপত্র কিনতে পারেন। এছাড়াও পারো থেকে নানা ধরনের শো-পিস, সিল্ক ও উলের কাপড়, প্রেয়ার হুইল ইত্যাদি কিনতে পারবেন।
ভুটানের মানুষজন বেশ ধর্মপরায়ণ। তারা নিজেদের ধর্ম, রীতিনীতি ও সংস্কৃতির ব্যাপারে বেশ সংবেদনশীল। ভুটানের বাসিন্দারা কোন প্রাণী হত্যা করে না। ভুটানের সব জিনিসেরই দাম কিন্তু অনেক বেশি। পাহাড়ি পথে হাঁটার জন্য স্পোর্টস সু, কড়া রোদ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে সানগ্লাস, সানক্যাপ আর বৃষ্টির জন্য ছাতা বাধ্যতামূলক।

ভুটান পরিষ্কার পরিছন্ন দেশ। ভুটান শতভাগ ধূমপানমুক্ত দেশ। তাই কারো ধূমপানের অভ্যাস থাকলে প্রকাশ্যে করা কখনই উচিৎ নয়।
ভূটান হচ্ছে সেই অল্পসংখ্যক দেশগুলোর একটি যারা তাদের ইতিহাস জুড়ে স্বাধীন। ভূটানকে জয় করা, দখল করা বা বাইরের কারও দ্বারা শাসন করা কখনো সম্ভব হয়নি।

হিমালয়ের কোলে ছোট্ট এই দেশটির জনসংখ্যা একেবারে কম, ৭.৫৪ লক্ষ! রূপকথার মতোই এই দেশ। ছবির মতোই ঝকঝকে সে দেশে রাজার শাসন চলে আজও। তিরতিরে নদীর ধারে রাজপ্রাসাদ। জংলি ফুলের মতো রাস্তার ধারে ধারে ফুটে থাকে সূর্যমুখীর দল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আপেল-পিচ-কমলালেবু গাছের সারি। প্রকৃতি যেন তার সবটা দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছে সেই দেশটাকে। সাধ্যের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের সাধ থাকলে ভুটানই আমার জন্য সেরা গন্তব্য।
পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার জয়গাঁ সন্নিহিত ফুন্টসেলিং আসলে পশ্চিম ভুটানের প্রবেশদ্বার, ভারতের বেশিরভাগ পর্যটক এই রাস্তায় ভুটানে প্রবেশ করে।

স্থলপথে ভুটান গেলে ভারতীয় পর্যটকদের ফুন্টসেলিংয়-এ ভুটানের রয়্যাল গভঃ ইমিগ্রেশন অফিসের বৈধ ভ্রমণের নথিরগুলির ভিত্তিতে প্রবেশের অনুমতি নিতে হবে। আর আকাশপথে ভুটান ভ্রমণে গেলে ভারতীয়দের কেবল তাদের ভ্রমণের নথি এবং প্রবেশের অনুমতি ভুটানের পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখাতে হবে। প্রবেশের অনুমতিটি দিয়ে ভারতীয় পর্যটকরা থিম্পু এবং পারো ভ্রমণ করতে পারবেন আরো একটু পরিস্কার করে বলে দিচ্ছি।
সড়কপথে ভুটান যেতে ফুন্টশেলিং থেকে আপনাকে একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। কিন্তু তার আগে আপনাকে হোটেল বুকিং এর ডকুমেন্ট দেখাতে হবে। তারপর ফর্ম দেবে।

দুকপি পাসপোর্ট ফটো। ভোটার কার্ড অথবা পাসপোর্টের জেরক্স কফি দিতে হবে। অরিজিনাল সঙ্গে রাখতে হবে। ট্যুরিস্ট পারমিটের সময় সীমা সাতদিন।
পুরো প্রক্রিয়াটির জন্যে কোনো টাকা পয়সা লাগবে না।
থিম্পু ও পারোর জন্য পারমিট নিতে হবে আপনাদের। থিম্পু বা পারো ছাড়াও পুনাখা, ওয়াংদি, বুমথাং, মঙ্গার, হা ভ্যালি ঘোরার জন্য থিম্পু অভিবাসন দপ্তর থেকে স্পেশ্যাল এরিয়া পারমিট নিতে হয়। বিমানে ভুটানে গেলে পারো বিমানবন্দর থেকেই পারমিট দেওয়া হয়।
এসব কাজ খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায় পৃথিবীর এই শান্ত সুন্দর দেশে, না তেমন কোনো ঝামেলা নেই, আর এসব ঝটপট সেরে ফেলার পরই শুরু হয় ভুটান সফর।

শান্ত নরম স্পর্শ এই দেশটির পথে প্রান্তরে, আকাশে বাতাসে এবং এই দেশের মানুষের ব্যবহারে। এক স্বর্গীয় অনুভূতি যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত