অনলাইন ডেস্ক : নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুল। গত ২৪ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পেশ করা ছয় পৃষ্ঠার একটি অভিযোগে পাপুলের নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী তুলে ধরা হয়েছে।
দুদক পাপুল ও তার পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে মানব পাচার, ব্যাংক জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে গত মার্চের প্রথম দিকে। ওই সময় তাদের বিরুদ্ধে ১৭৪ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগ জমা পড়ে। আবার গত ২৪ জুন তাদের নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করে আরও একটি অভিযোগ জমা দেওয়া হয় কমিশনে। দুদকে পেশ করা অভিযোগে বলা হয়, শিগগিরই পাপুল ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ ক্রোক বা অবরুদ্ধ করতে হবে। না হলে এসব সম্পদ বিক্রি বা স্থানান্তরের আশঙ্কা রয়েছে। বলা হয়, পাপুল তার নিজের নামের বদলে স্ত্রী, শ্যালিকা ও অন্যদের নামে অর্থ-সম্পদ জমিয়েছেন।
নিজের নামে যা আছে : এমপি পাপুলের নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকার শেয়ার ও ১০ কোটি টাকার সঞ্চয়ী আমানত, সোনালী ব্যাংকের ওয়েজ আর্নার শাখা থেকে ১০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার বন্ড কেনা রয়েছে।
স্ত্রী সোলিনা ইসলাম : এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে স্ত্রী সোলিনা ইসলামের নামে ৪০ কোটি টাকার শেয়ার, একই ব্যাংকে ৪০ কোটি টাকার সঞ্চয়ী আমানত, সোনালী ব্যাংকের ওয়েজ আর্নার শাখা থেকে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার বন্ড কেনা হয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় স্ত্রীর নামে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ছয়তলা বাড়ি। গুলশান-২ এর ৯৫ নম্বর রোডের সিইএন ডি/২ ভবনের আট তলায় স্ত্রীর নামে ২৯ কোটি টাকায় ৯ হাজার বর্গফুটের একটি আলিশান ফ্ল্যাট কিনেছেন পাপুল। আট কোটি টাকা খরচ করে ফ্ল্যাটটির ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কাজ করানো হয়েছে। ঢাকার গুলশান-১ এর পোস্ট অফিসের পেছনে ১৬/এ নম্বর রোডের ১/বি ভবনে স্ত্রীর নামে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। স্ত্রীর নামে আটটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি রাজধানীর উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে।
মেয়ে ওয়াফা ইসলাম : বড় মেয়ে ওয়াফা ইসলামের নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত, সোনালী ব্যাংকের ওয়েজ আর্নার শাখা থেকে ৪০ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার বন্ড কিনেছেন পাপুল। একটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন ওয়াফার নামে গুলশান-১ এর পোস্ট অফিসের পেছনে ১৬/এ নম্বর রোডের ১/বি ভবনে।
শ্যালিকা জেসমিন প্রধান : শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের নামে এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকে রয়েছে ১০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত। তা ছাড়াও জেসমিনের নামে দেশের ১৮টি ব্যাংকে হিসাব খুলে শত শত কোটি টাকা জমা রেখেছেন তিনি। জেসমিন প্রধানের নামে জেডব্লিউডি লীলাবতী নামে একাটি কোম্পানি খুলে সেটির ব্যাংক হিসাবে শত শত কোটি টাকা জমা রেখেছেন। পাপুল বিভিন্ন সময়ে প্রভাব খাটিয়ে নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণও নিয়েছেন।
শ্যালিকা ইয়াসমিন প্রধান : আরেক শ্যালিকা ইয়াসমিন প্রধানের নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে রয়েছে চার কোটি টাকার আমানত।
স্ত্রী ও শ্যালিকার নামে গাড়ি : প্রভাব খাটিয়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্ত্রী ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের নামে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন পাপুল। এর মধ্যে একটি ফর্স হাই জিপ, অন্যটি টয়োটা করোলা।
বড় ভাই মনজুরুল ইসলাম : পাপুলের বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার মনজুরুল ইসলাম সোনালী ব্যাংকের ওয়েজ আর্নার শাখা থেকে ১৭ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার বন্ড কিনেছেন। এর পেছনেও পাপুলের হাত রয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে বেনামে সম্পদ : মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক রায়পুর পৌরসভা শাখায় ওই পৌরসভার সাবেক মেয়র রফিকুল হায়দার বাবুলের ব্যাংক হিসাবে ও তার তত্ত্বাবধানে মাছের আড়তে পাপুল আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
কুমিল্লার মেঘনায় সম্পত্তি : পাপুল নিজের ও স্ত্রীর নামে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় ৯১ কোটি টাকার জমি কিনেছেন। মেঘনায় রয়েছে তার অবৈধ বালু মহালের ব্যবসা।
কক্সবাজার সিলেটে সম্পত্তি : কক্সবাজারের কালাতলী মোড়-সংলগ্ন স্থানে পাপুল ও তার স্ত্রীর নামে ৩৮ শতাংশের বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে। নিজের নামে সিলেট উপশহরে একটি সিএনজি স্টেশন রয়েছে। ওই সিএনজি স্টেশনের ৪০ কাঠা জমি রয়েছে পাপুলের নামে।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে পাথর সরবরাহে কেলেঙ্কারি :রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে পাথর সরবরাহের জন্য ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে নেওয়া এক হাজার দুইশ’ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে বেআইনিভাবে নিজের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের কাউন্টার ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়েছিলেন পাপুল। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে আড়াল করে ওই কাউন্টার ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়া হয়েছিল। এভাবেই এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে কাউন্টার ব্যাংক গ্যারান্টির এক হাজার দুইশ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
কুয়েতে জব্দ সম্পদ : কুয়েতের বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে পাপুলের নামে জমা থাকা ১৩৮ কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। দুদকে পেশ করা অভিযোগে আরও বলা হয়, পাপুল কুয়েতে মানব পাচার করে প্রায় এক হাজার চারশ’ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছেন। হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ আনা ও বিভিন্ন দেশে পাচারের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে ও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে ২০১৬ সালে ২৮০ কোটি টাকা দেশে আনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে।
মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গত ৬ জুন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম পাপুলকে গ্রেপ্তার করেছে কুয়েত ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সিআইডি। গোয়েন্দাদের রিমান্ডে পাপুলের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।