শারমীন শরীফ : আমাদের ছেলে বেলাটা কি সহজ সরল ছিল। তখন রবিবার ছুটির দিন ছিল আর এই একটা দিনই আমরা ছুটি পেতাম, ছয় দিন স্কুল করতাম। অন্যান্য দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে কি কষ্ট হত কিন্তু ছুটির দিনটিতে খুব ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে যেত, তারপরে আরো কিছুক্ষন শুয়ে শুয়ে কত জল্পনা কল্পনা চলত আজ কি কি করবো। কোনমতে আলুভাজি, ডিম আর রুটি খেয়ে চলে যেতাম খেলতে। পাড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে ঘুরে কত খেলা, ডাংগুলি, সাতচাড়া, লাটিম ঘোড়ানো, কানামাছি, গাছে ওঠা, বোউচি, ঘুড়ি ওড়ানো আরো কত্ত খেলা চলতে থাকত। আমাদের মা-বাবাদের কোন চিন্তা ছিল না আমরা কোথায় বা কার বাড়ি। মনে আছে দুপুর বেলা বাড়ির কাজের ছেলেটি ‘ছোট্ট আপা’ বলে ডাকতে ডাকতে গলি দিয়ে হাটত কারণ সে জানতনা আমি কোথায় বা কোন বাড়িতে? ওর মনে একটা সহজ হিসেব ছিল যে ওর তারস্বরে চীৎকার আমার কানে পৌছবে এবং আমি সাড়া দেব আর হতও ঠিক তাই; ওর ডাক শুনে কোন এক বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে আমি বলতাম ‘ডাকছিস কেন’, ছেলেটি হেসে আমাকে সময় মনে করিয়ে দিয়ে বলত কয়টা বাজে আমার খেয়াল আছে কিনা, মা ডাকছে, দেরী হলে মার দেবে। তখন তো আর হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুড়তাম না আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোথাও কোন ঘড়ি লাগান ছিল না যে কয়টা বাজে আমি জানব আর কয়টা বাজে তা নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা ব্যাথাও ছিল না কিন্তু মার খাবার ভয় ছিল তাই কোন দ্বিরুক্তি না করে অনিচ্ছা স্বত্তেও বাড়ির দিকে রওয়ানা হতাম, তখন হয়ত ছিলাম খেলার মাঝপথে। একবার পেছন ফিরে করুন চোখে তাকিয়ে দেখতাম আমাকে ছাড়াও কত উচ্ছ¡াসে এগিয়ে চলছে খেলা। যাই হোক বাড়ি ফিরলে একচোট বকুনি যে না ডাকলে কেন নিজে থেকে বাড়ি আসি না? আমি মায়ের এ কথাটার মানে কিছুতেই বুঝতাম না যে না ডাকলে খেলা ফেলে শুধু শুধু আমি আসব কেন! কারনটা কি? কিন্তু কিছু বলার সাহস একেবারেই ছিল না। দুপুরবেলা গোসল করতে হবে তাই দৌড়ে এক ঝাঁপে বাড়ির পেছনে পকুরে। চলতে থাকত ম্যারাথন ডুব সাতার, চীৎ সাতার, ভেলায় চড়া তখন খেলার গ্রæপের অনেকেই আবার জুটে যেত পুকুরে। ব্যাস আবার সময় থেমে যেত, থেকে যেত শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আমার মায়ের অদ্ভুত একটা সময়জ্ঞান ছিল, সব বন্ধুরা মাত্র এসে জুটেছে পুকুরে এবং ঠিক পাল্লা দিয়ে যখন শুরু হত সাতার অথবা ডুব দিয়ে কে পুকুরের তলা থেকে মাটি তুলে আনতে পারবে ঠিক তক্ষুনি শুরু হত আমার মায়ের চীৎকার এখনো উঠছি না কেন পুকুর থেকে, এখন না উঠলে আস্ত থাকব না, আবার সেই মারের ভয়, ব্যাস আনন্দ শেষ।
দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই যখন ভাতঘুমে ব্যাস্ত তখন পা টিপে টিপে আবার ভেগে যেতাম খেলতে যা চলিতে থাকতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং না ডাকা পর্যন্ত বাড়ি ফেরার নামও করতাম না। অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও হয়ত বাড়ি ফেরার বদলে কিছু একটা করার পায়তাড়া কষতাম!
একটা সময় এল সাদা-কাল টিভি তখন রোববারের দিনগুলো শুরু হত স্পাইডার ম্যান, থান্ডার ক্যাটস দিয়ে আর দুপুর শুরু হত নতুন কুঁড়ি দিয়ে। খেলায় তখন একটু ভাটা পরেছিল কিন্তু পড়ে সেটা পুষিয়ে নিতাম। যখন একটু বড় হয়ে গিয়েছি আমরা, সেই আগের মত পাড়া বেড়ানো আর ডাংগুলি খেলা যেন আর টানে না আমাদের। বরং তখন স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়াতে যেন বেশি আনন্দ ছিল। তিন গোয়েন্দা, ক্যাপ্টেন নিমোর এডভেঞ্চার, আন্দেজের বন্দি, নাইজারের বাকে এমন আরো কত শ্বাসরুদ্ধকর গল্প। এক লহমায় দুপুরটা কেটে যেত, বিকেল বেলায় একটু ছাদে বেড়ানো, গাছ থেকে আমড়া বা পেয়ারা পেড়ে খাওয়া, ৫টায় শুরু হত টেলিভিশন, সন্ধ্যা হয়ে গেলেই সব রেখে পড়তে বসা। আরো যখন ছোট ছিলাম আব্বা অংক করাতে বসলে শুরু হত আরেক কাহিনী। শুরুতেই মনে হত যে আজ আমি অংক পারব না আর হতও ঠিক তাই। মনে আছে শতকরার অংককে আমি ঘৃণা করতাম, আরো ছিল বানরের তেল মাখা বাঁশ বেয়ে ওঠা নামার একটা অংক আর চৌবাচ্চা ভরার একটা অংক। আব্বা যখন জান দিয়ে দিচ্ছে আমাকে অংক বোঝানোর জন্য তখন আমি গভীর মনযোগ দিয়ে ভাবছি একটা বানর কেন তেল মাখা বাঁশ বেয়ে ওঠা নামা করছে আর বাঁশে তেলটা মাখালোই বা কে। যখন কিছুতেই বুঝছি না অংক তখন আব্বা শলাকার কাঠি এনে বোঝাতে শুরু করতেন। কোন কোন দিন এমন হত যে কিছুতেই অংক মাথায় ঢুকছে না আর আব্বাও মাথায় গজাল মেরে অংক ঢোকাবেনই। আব্বা সেদিন ৮টার বাংলা সংবাদও শুনতে যেতেন না। খবর শেষে শুরু হয়েছে এ সপ্তাহের নাটক অথবা ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তখন স্বয়ং বিধাতারও সাধ্য ছিল না আমার মাথায় অংক ঢোকায় কিন্তু আব্বা নাছোড়বান্দা কিছুতেই ছাড়বেন না, তখন তো আমার মাথায় নাম্বার নেই শুধু ঘুড়ছে নাটক, নাটক শেষ হয়ে গেল।
এক পর্যায়ে মায়ের হস্তক্ষেপে মুক্তি পেতাম। মা ঠিক আমার জন্য দরবার করতেন না, এসে আব্বাকে বলতেন খেয়ে নেবার জন্য কারন কাজের মেয়েটা বাড়ি যাবে। অগত্যা আব্বা ভাত খেতে যেতেন আর বলে যেতেন ফিরে এসে আবার অংক নিয়ে বসবেন। আমি লক্ষি মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে সায় দিতাম আর আব্বা চোখের আড়াল হওয়া মাত্র আমি পগারপার। ওই রাত্রে আর তাঁর চোখের সামনে পড়তাম না।
আরো একটু বড় হলাম যখন, যখন প্রেমে পড়ার বয়স তখন মা হলেন শত্রু আর আব্বা হলেন বন্ধু। যাই করতে চাই মা এক কথায় ‘না’! এর পরে আর কোন কথা নেই। তখন আব্বার কাছে গিয়ে অনুমতি চাইতাম। আব্বা অতশত বুঝতেন না বলতেন ‘যাও’, ব্যাস মাকে ঘন্টা দেখিয়ে আমি গায়েব। এমন প্রায়শই হত। মা দেখলেন বিপদ, আমি কথা শুনছি না এরপরে কোন একটা সময় মা এবং আব্বার মধ্যে এই নিয়ে সুন্দর একটা বোঝাপড়া হল ব্যাস আমার কা্রগিড়ি, মাস্তানি শেষ। তখন আব্বার কাছে অনুমতি চাইলে আব্বা ইচ্ছা করে খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলে, একদম ভোলাভালা সুরে বলতেন, ‘তোমার মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নাও’, প্রথমেতো আমি একটা বড় ধাক্কা খেলাম ভাবলাম, এ আবার কি? এরকমও হয় নাকি? মা তখন ডাবল শত্রু হয়ে গেলেন।
জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম বান্ধবীর বড় ভাইয়ের। আমাদের থেকে কয়েক বছরের বড়। দেখতে খুব ভাল ছিলেন বড় ভাই। ব্যাপারটা এমন দাড়াল যে আমি তার চোখে নয় বরং তিনি আমার চোখে পড়ে গেলেন! কারণে অকারণে তখন ওদের বাড়িতে যেতে শুরু করলাম। আমাদের দু’বাড়িতে অবাধ যাওয়া আসা ছিল বলে কেউ বাঁধা দিত না। বড় ভাইয়ের চোখের সামনে দিয়ে ঘুড়তাম কিন্তু তিনি কখনো এক মিনিটের জন্যও মনোযোগ দিয়ে আমার দিকে তাকাননি। কখনো হয়তবা এমন হয়েছে যে আমার ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তখন আমার বান্ধবী ও তার ভাই দু’জন মিলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসেছে, আমার বুক তখন দুরু দুরু, কিন্তু কিসের কি সে আমার দিকে তাকিয়েও দেখত না। খুব অভিমান হত। একবার হল কি, স্কুলে পিকনিক, প্ল্যান হল সবাই আলু পটল এইসব বাড়ি থেকে নিয়ে যাব, স্কুলে গিয়ে রান্না হবে। সবাই সালোয়ার, কামিজ পড়ে যাব কিন্তু সাথে শাড়ি নিয়ে যাব এবং বিকেলে সবাই শাড়ি পরব। আমার বান্ধবি বলল যে সব নিয়ে ওদের বাড়িতে চলে যেতে ওখান থেকে আমরা একসাথে যাব। পিকনিকের দিন সকালবেলা আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। (ক্রমাগত)