শারমীন শরীফ : হসপিটালে আমরা মনে হয় ৭ দিন ছিলাম, মোটামুটি একটা সংসার বসে গিয়েছিল সেখানে আমাদের তিন জনের। আব্বা আসতেন একবেলা প্রতিদিন নিয়ম করে। সেলাই ছুটে যাবার জন্য এবং দ্বিতীয়বার সেলাই দিতে হয়েছিল বলে কাটা জায়গা শুকাতে বেশি সময় লেগেছিল। তৃতীয় দিনে ডাক্তার আমাকে হাটতে অনুমতি দিলে মেজদা আমাকে ধরে ধরে হসপিটালে করিডোরে হাটাতে শুরু করল। চার দিনের দিন আমি নিজেই হাটতে শুরু করলাম। জুনিয়র ডাক্তার তাঁর কাজের অবসরে আমার দিকে ওনার একটা দ্বায়িত্বপূর্ণ দৃষ্টি রেখে চললেন এবং আমাদের সাথে হাটাহাটিও শুরু করলেন, রুমে এলে আর কিছুতেই যেতে চাইতেন না। দুষ্টু মেজদা ডাক্তারকে বলল, ‘আপনি তো মিঞাঁ এমনিতেই পাটকাঠি আমাদের সাথে এত হাটাহাটি করলে আপনাকে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, বিয়েশাদির আগেই সব হেরিয়ে(হারিয়ে) ফেললে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে?’ আমি হেসে ফেলতেই লজ্জায় ডাক্তার সাহেব ক্যাপাচিনো থেকে ডার্ক রোষ্ট হয়ে গেলেন। আমি ছোটবেলায় যতটা দুষ্টু ছিলাম একটু বড় হবার সাথে সাথে বেশ লাজুক এবং শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম (এমনি এমনি হইনি, মায়ের ঝাড় খেতে খেতে হয়েছিলাম)। নব্য ডাক্তার মশাই এলে আমি মন খুলে মোটেই কথা বলতাম না। তিনি এসে মেজদা, ভাবীর সাথে বক বক করতেন, থেকে থেকে আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দিতেন আর এদিকে আমি সযতেœ আমার দৃষ্টি বাঁচিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম যেন পৃথিবীতে দেয়ালটাই সব কিছু। আমি বাড়ি ফেরার কিছু দিন পরে তিনি আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে আব্বা না করে দিয়েছিলেন।

পঞ্চম দিনে বিকেলে আমি ধীরে ধীরে হাটছিলাম একা একা, ৫ তলায় লম্বা করিডোর ধরে হেটে হেটে একদম শেষ মাথায় এসে আমি ভয়ে পাথরের মত জমে গেলাম কারণ আমার সামনে ঠিক দশ হাত দূরে মনির ভাই দাঁড়িয়ে। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে, পলক ফেলছে না একদম। আমার পা আঠায় আঁটকে গিয়েছিল অথবা আমি মনে হয় শকে চলে গিয়েছিলাম। একটু কাছে এসে সে জানতে চাইল আমি কেমন আছি, বললাম, এখন ভ্লা। জানতে চাইল, আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি কথাটা সত্যি কিনা, আমি বললাম, সত্যি। জানতে চাইল, কবে? আমি বললাম, তারিখ ঠিক হয়নি এখনো, শেষে বলল, ‘তুমি রাজি হলে?’ আমি তার উত্তর দেইনি। আরো হয়ত কয়েক মিনিট চুপ করে দু’জনে দাড়িয়ে, কোন শব্দ নেই কোথাও আমার বুকের ধুকপুক ছাড়া আর সেটা মনে হয় মনে হয় সারা বিশ্ববাসী শুনতে পেয়েছিল সেদিন। এক সময় আমি ঘুরে হাটতে শুরু করলাম। হঠাৎ মনে হল শরীরে কোন শক্তি নেই, দেয়াল ধরে হেটে হেটে একেবারে আমার রুমের সামনে গিয়ে থেমে ফিরে তাকালাম, দেখি তখনো সে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। বুকের মধ্যে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে গলায় কাছে উঠে এল, এই মনে হয় প্রথম আমি সত্যিকারের প্রেমে পড়লাম যেটা শুরু না হতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি সোজা বাথরুমে গিয়ে বমি করে ফেললাম। ভাবি দৌড়ে এসে আমার পেটের কাঁটা জায়গাটা চেপে ধরল। বমি শেষ করে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘ভাল হচ্ছি না কেন, আর কতদিন লাগবে ভাল হতে?’ ওরা ভাবল আমি আমার অসুস্থতা নিয়ে মন খারাপ করছি।

মেজদা ভড়কে গিয়ে সোজা ডাক্তারদের স্টেশনে গিয়ে দেখে ভাইয়ার বন্ধু জিয়া ভাই ডিউটিতে। তাকে ডেকে নিয়ে এল। জিয়া ভাই এসে সব চেক করে দেখলেন প্রেসারটা একটু কম। খাবারের চার্ট তৈরি করে দিয়ে জানতে চাইলেন আমি ব্যাথায় কাঁদছি কিনা। আমি বললাম, ‘বাসায় যেতে চাই জিয়া ভাই,’ -জিয়া ভাই আশ্বস্ত করলেন যে আর ২/১ দিনের মধ্যেই আমি চলে যেতে পারব। সারা সন্ধ্যা আমি গুম মেরে রইলাম।

সপ্তম দিন সকালবেলা আমাকে খারিজ করে দিল হসপিটাল থেকে। আমি আব্বার সাথে বাসায় চলে এলাম আর মেজদা ভাবিকে পৌঁছে দিতে গেলে আব্বা বলেছিলেন, ‘আবু আজ আর বাসায় আসতে হবে না, ওবাড়িতেই থেক নাহয়।’ মেজদা মাথা নেড়ে চলে গেল বটে কিন্তু রাত্র বেলা ঠিক ঠিক বাসায় এসে হাজির। আমি হসপিটালের সংসার মিস করতে শুরু করলাম। ৭টা দিন হাসি, আনন্দ আর আড্ডায় কেটে গিয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে আমাদের রুমে জমজমাট আড্ডা বসত। বাসায় ফিরে আবার জেলখানা মনে হতে শুরু করল আর সেই সাথে সব সময় একটা কষ্ট আমাকে তাড়া করে ফিরছিল। মনির ভাইয়ের সাথে সেদিনের দেখা, অভিমানে ভরা তার চোখ দুটি সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দিয়েছিল আমাকে। ভাবলাম যত তাড়াতাড়ি পালানো যায় বরিশাল থেকে ততই ভাল। সাব্যস্ত হল আমার শরীর সারলেই আমি চলে যাব। মেজদি ফোন করে আব্বাকে বলতে থাকল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে পাঠিয়ে দেবার জন্য আরো বলল যে বাড়িতে দু’জন ডাক্তার, কোন সমস্যা হবে না। শুরু হল আবার গোছগাছ। আমার নিজের তো কাপড় ছাড়া আর কিছু নেবার নেই তবে ভাই-বোনদের বাসার জন্য বস্তা বস্তা কালিজিরা চাল, বস্তা ভরে নারকেল আর হাড়ি হাড়ি গুড়, গাছের দারুচিনি, আমড়া, সফেদা, নারকেলের বরফি, নাড়ু, নারকেলের মোয়া, পিঠা এগুলো রেডি করতে সময় লাগছিলো।

নার্গিসদের বাসায় গেলাম বিদায় নেবার জন্য। গিয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদলাম কতক্ষণ। বিদায়ের শেষ দিনগুলোতে ব্যাথায় যেন আমার পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছিল। আমি জানতাম যে বরিশালের সাথে এই যে আলগা হয়ে গেল সব সম্পর্ক, আর কোনদিন এখানে পাকাপোক্ত ভাবে ফিরে আসা হবে না। কত মানুষের সাথে হয়তো কোনদিন আর দেখাও হবে না। বুঝলাম ছেলেবেলার সাথে বিদায়ের ঘন্টা বেজে গিয়েছে রয়ে যাবে কিছু স্মৃতি। বান্ধবীদের সাথে বিশেষ করে রত্নার সাথে দেখা করে বিদায় নিতে পারলাম না বলে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আব্বার মুখে কোন হাসি নেই, মায়ের মুখে কোন বিকার নেই।

মায়ের সাথে আমার কখনো আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। মায়ের আদর পেয়েছি আবার পাইনি। সন্তান বলে মা আমাকে ফেলে দিতে পারেনি কিন্তু মাখা মাখা আদরও কখন পাইনি মায়ের কাছ থেকে। তখন বুঝিনি কিন্তু নিজে মা হয়ে বুঝেছিলাম যে নয়জন সন্তানের জন্ম দিয়ে এবং সাত জনকে পেলেপুষে বড় করে আমার মায়ের ভালবাসা, আহ্লাদ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল, শক্তি ছিল না আর সেই সাথে অনেক রোগেও ধরেছিল। কিন্তু তাই বলে মায়া কম ছিল না কারো জন্য। আমার মা অসাধারণ দৃঢ় চরিত্রের একজন মানুষ ছিলেন। আব্বা সারা জীবন ট্রান্সফারের চাকুরি করেছেন তাই আমাদের হ্যাপা তাঁকে সামলাতে হয়নি কিন্তু মায়ের তো মুক্তি মেলেনি আমাদের থেকে, দিনরাত আমরা জ্বালিয়েছি মাকে, শুধু আমরা নই চাচাত, মামাত, খালাত ভাইবোনেরাও পড়েছে আমাদের বাসায় থেকে । শুধু আমার মায়ের দৃঢ়তার কারণে, অসম্ভব মনের জোরের এবং সাহসের কারণে আমার ভাইবোনেররা ডাক্তার, সচিব, বিজনেস ম্যান হয়ে বেড়িয়েছে, নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। মায়ের আহ্লাদের ঘাটতি আব্বা পুষিয়ে দিয়েছিলেন। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ছাপিয়ে ছিল আব্বার ভালোবাসা। যাবার কয়েকদিন আগে আব্বা আমাকে নিয়ে বসলেন, বললেন অনেক কথা। আমাকে কাছে রাখতে না পারার অক্ষমতার কথা বললেন। বললেন, ‘ মামনি, তুমি হলে আমার শেষ বয়সের আদরের পুতুল। তোমাকে আমার কাছ থেকে স্বামীর সংসারে বিদায় দিতে না পারার কষ্ট আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না, তোমার সংসার-সন্তান দেখার ভাগ্য হয়ত আমার হবে না কিন্তু আমি সব সময় তোমার সাথে আছি এবং থাকব, এখন বোনদের কাছে চলে যাওয়াতেই তোমার মংগল। এই ছোট পরিসরে না থেকে তুমি বড় জায়গায় যাও আর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। একটা কথা মনে রাখবে শুধু, কোন ভাবেই ভাইবোনদের থেকে কম শিক্ষিত থাকবে না যেন ওরা কখনো বলতে না পারে যে তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা ওদের থেকে কম। বিদেশে থাকে এমন কোন ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না, আমি চাই না তুমি আমায় ফেলে দূরে যাও। আর কাউকে যদি পছন্দ হয় তো সবার আগে আমাকে জানাবে।’ আমি চোখের পানি মুছতে মুছে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আমি বিশ্বাস করি আব্বা কথা রেখেছেন, আমার ভেতরে যে এক অসীম শক্তি এবং সাহস সে আমি প্রতিদিন আমার মা, বাবার কাছ থেকেই পাই। তাঁদের ভালবাসার এবং আশীর্বাদের ছায়া সব সময় আমার মাথার উপরে আছে।

যাবার দিন যত ঘনিয়ে এল আমার বুকটা তত ভারী হয়ে যেতে শুরু করল। আমার দুরন্ত ছেলেবেলাকে পেছনে ফেলে চলে যেতে মন চাইছিল না, আমার শহর আমার ভালবাসা বরিশাল কিন্তু মায়ের জেলখানা থেকেও মুক্তি চাইছিলাম। হ্যাঁ, তখন তাই মনে হত কিন্তু অনেক বছর পরে মনে হয়েছিল জেলখানাটা আরো লম্বা হলে ভাল হত। অতঃপর সেই দিন এল। সব ঘুছিয়ে নিলাম, সন্ধ্যা ৬টায় লঞ্চ ছাড়বে তাই ৪টায় বাসা থেকে বেরোব। ছোট্ট একটা গোল পাথরের মধ্যে রোজ রাতে হরতকি ঘষে আমি মুখে লাগাতাম। আব্বাই এনে দিয়েছিলেন, কোথায় শুনেছিলেন হরতকি লাগালে মুখে ব্রণ হয়না। আমি শেষ বারের মত স্যুটকেস খুলে দেখে নিচ্ছি সব নিলাম কিনা তখন আব্বা পাথরটা এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘মনা এটা তো নিলি না,!’ আব্বার হাতে পাথরটা আর এক পোটলা হরতকি, আব্বার হাতটা থরথর করে কাঁপছে। (চলবে)