শারমীন শরীফ : মায়ের এক বান্ধবী মানে আমাদের পশুগলির খালাম্মা আমাদের বাসার বেশ কাছেই থাকতেন। খালাম্মা যে রাস্তায় থাকতেন সেটার নাম ছিল ‘পশু হাসপাতাল গলি’, পরে অবশ্য নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছিল ‘কালুশাহ সড়ক’, যাই হোক খালাম্মাকে আমরা পশু হাসপাতাল গলির খালাম্মা বলেই ডাকতাম। মা প্রায়াই ওই বাসায় যেতেন এবং সংগে করে আমাদের ভাইবোনদের কাউকে নিয়ে যেতেন। আমার যখনকার কথা মনে আছে সেই সময়টায় বাকি সবাই বড় হয়ে যাওয়াতে মায়ের হাতের কাছে ছিলাম শুধু আমি আর তাই মা, খালাম্মার সাথে গল্প করতে যাবে মানেই আমাকে যেতে হবে সাথে। আমরা খালাম্মার বাসায় যাচ্ছি শুনলেই মেজদা দাঁত কেলিয়ে বলত, ‘মনি দাতে ধাঁর দিয়ে যা, খলফা খেতে হবে না’? খলফা মানে হল টোস্ট বিস্কিট। খালাম্মার বাসায় গেলে বিকেলের বাঁধা নাস্তা ছিল চা আর টোস্ট বিস্কিট। ওই একই খাবার হয়ত মেজদাও খেয়েছে, কিন্তু এই খলফা নামটা মেজদা কোত্থেকে আবিস্কার করেছে তা আমি জানি না কিন্তু আমাদের বাড়িতে টোস্ট বিস্কিটের নাম হয়ে গেল খলফা। আমি মায়ের সাথে এই বাসায় যেতে খুশি হয়ে রাজি হতাম তাঁর একটাই কারণ ছিল খালাম্মার অনেকগুলো মেয়ে ছিল এবং ওরা সবাই অপূর্ব রূপসী ছিল। দুলু আপা, নিরু আপা, ওরা আমাকে খুব আদর করত এবং খালাম্মার বাড়ির পেছনে একটা বিশাল টলটলে পুকুর ছিল যার পানি আমাদের পুকুরের থেকে অনেক সুন্দর ছিল। সেই পুকুরে শ্যাওলা ধরা শান বাঁধানো একটা ঘাট ছিল, পুকুরের পাশে একটা মিষ্টি কুলের গাছ। ঘাটটা সব সময় কেমন ছায়ায় ঘেরা থাকত। পুকুরটা কচুরিপানায় ভরা ছিল। যে যার ঘাটের কাছে বাঁশ দিয়ে চৌকোনা করে কচুরিপানা সরিয়ে রাখত। আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল ওই পুকুরটা। আমি ওখানে গেলেই দুলু আপাকে বলতাম আমাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে যেতে। আমরা কিছু কুল পেড়ে কোঁচড় ভরে ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বসতাম আর দুলু আপার কাছে ওর সব বন্ধুদের গল্প শুনতে শুনতে কুল খেতাম। আমার তখন মনে হত সে আমাকে তার সমপর্যায়ের মর্যাদা দিচ্ছে, নিজের বাড়িতে তো কোন পাত্তাই পেতাম না। আমি বড় হয়ে অনেক ভেবেছি যে আমার ভাইগুলো ওদের প্রেমে পরেনি কেন? ওদের বাসায় গেলে বেশ একটা ভাব হত মনে, একটা মায়া মায়া বিকেলে, ঘাটে বসে কুল খেতে খেতে আর দুলু আপার গল্প শুনতে শুনতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যেত, তবে সব সময়ের যে শুধু পকুরপাড়েই বসে থাকতাম তা নয়, আমরা হাটতে হাটতেও গল্প করতাম, মাঝে মাঝে দুলু আপা আইসক্রিমও কিনে দিত। বাসায় ফিরলেই মেজদার প্রশ্ন ছিল, ‘খলফা ত্যানা ত্যান ছিল না টাটকা ছিল’? বড় হয়ে বুঝেছি যে কোন একটা সময় নিশ্চই মেজদাও এই খলফা অত্যাচারে অতিষ্ট ছিল।
আমি মৌমাছি খুব ভয় পাই, সামারে এই একটা জিনিষ খুব বাজে, বাগানে বসলেই ওদের অত্যাচার। ছোটবেলায় একবার মৌমাছির হুলে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। মৌমাছিটা ঘরে ঢুকে এসে আমায় কামড়েছিল। আব্বা মৌমাছিটা দেখে আমার সরে যেতে বললেন, আমিও এদিকে যাচ্ছি সেদিকে যাচ্ছি আর সেটাও আমার পিছু ছাড়ছে না, এর মধ্যে ঘাড়ে দিল হুল ফুটিয়ে। সে যে কি কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না। আমি বিছেও খুব ভয় পাই। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে স্কুলে না যাবার বায়না করতাম। পেটে ব্যাথা একটা কমন বাহানা ছিল। মা এমন মার দিত স্কুলে যেতে না চাইলে, মার খেয়ে কিছুক্ষন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে চোখ মুছে খেলতে চলে যেতাম। আমার মনে আছে যেদিন আর্ট ক্লাস থাকত সেদিনই আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। ছবি আঁকাতে আমি সব সময় ভীষণ ডাব্বা। ম্যাডাম একটা দোয়েল বা টিয়া পাখির ছবি বোর্ডে আটকে দিয়ে বলত দেখে দেখে আঁকতে তারপরে রঙ করতে। আমি পাখি আঁকতে গেলে ব্যাঙ হয়ে যেত আর ব্যাঙ আঁকতে গেলে গুবরে পোকা হয়ে যেত। এত এত চেস্টা করেছি, হয়নি! ম্যাডাম ঘুরে ঘুরে যখন সবার ছবি দেখত ঠিক আমার সামনে এসে একটা কান মলা দিয়ে বলত, ‘তুই দেখেও আঁকতে পারিস না?’…ক্লাসের সবাই হেসে উঠত, যেন ছবি আঁকায় সবাই মহা পন্ডিত; মেজাজটা এমন খারাপ হত যে কি বলব। আর্ট ক্লাসে ম্যাডামের এই এক নিয়মের কোন অন্যথা হত না। ক্লাসের ছেলেগুলো এত পাঁজি ছিল যে আর্ট ক্লাসের আগে বোর্ডে কাকের ঠ্যাং এঁকে নিচে আমার নাম লিখে রাখত। আর ম্যাডামও ওদের কিছু বলত না বরং মুচকি হেসে আমার নিয়ে তামাশা করত। শুরুতে আমি এই ম্যাডামকে খুব পছন্দ করতাম, শ্যমালা করে কি মিষ্টি ছিল দেখতে যে মনে হত কোলে উঠে বসে থাকি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি তাঁকে ভয় পেতে শুরু করলাম।
এমনি এক সকাল বেলায় স্কুলে না যাবার বায়না করে মায়ের মার খেয়ে কান্না কাটি শেষে মনের আনন্দে আমি বাগানে চলে গেলাম। একটা মোটা সোটা আম গাছের কান্ড ধরে আমি বাংলা সিনেমার গান গাইতে গাইতে সিনেমার নায়িকার মত গাছের গুড়ি চারিদিকে ঘুরতে গেলাম আর সাথে সাথে চীৎকার। আমার হাতে কয়েকশো কোটি বিছের বা ছ্যাঙ্গার কাঁটা ফুটে গেল। আমি গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কিলবিল করছে ছ্যাঙ্গা। আমি চেঁচাতে চেঁচাতে মায়ের কাছে। ডান হাতটা কালো হয়ে আছে ছ্যাঙ্গার কাটায়। মা হেসে বললেন, দেখলি তো স্কুলে গেলে এমন হত না। মায়ের হাসি দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল, আমি আরো চেঁচাতে শুরু করলে মা কসে একটা থাপ্পড় দিয়ে চুপ করিয়ে কেমন করে নারকেল গাছের পাতায় শর্ষের তেল মাখিয়ে আস্তে করে হাতের ওপর থেকে টেনে নিলেন আর সব হুলগুলো পাতায় আটকে চলে গেল। কিন্তু পুরো হাত ফুলে গেল আর সেকি ব্যাথা, একদিক থেকে অবশ্য ভালই হয়েছিল; পরেরদিন এমনিতেই স্কুলে যেতে হয়নি। আমি তাই এখনো বাগানে গেলে বসবার আগে ভাল করে চারিদিক দেখে নেই। মাঝে মাঝে যখন এইসব স্মৃতিতে ডুবে যাই তখন মনে হয় সেই মফস্বলের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো, হাডুডু আর ডাংগুলি খেলা মেয়েটা কি তখন জানত যে সে একদিন পৃথিবীর অপরপ্রান্তে এসে ঠেকবে আর প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হবে এক অদ্ভুত জীবন যাত্রার? আমার ডান পায়ের তলায় ঠিক মাঝখানে একটা তিল রয়েছে। সবাই সেটা দেখে বলত আমি বিদেশে চলে যাবো একদিন, আর আমার ভীষণ দুষ্টু মেজদা, সে বলত তিলটা যেহেতু ঠিক মাঝখানে তাই আমার কোথাও যাওয়া হবে না, এই দেশেই এবং বরিশালেই থেকে যাব। মেজদার কথা শুনলে আমার খুব মন খারাপ হত কারণ আমার দিদি তখন এ্যমেরিকায় চলে এসেছে আর আমি ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’ কবিতাটা সবে মাত্র শিখেছি। বিদেশে না গেলে দিদিকে দেখব কেমন করে? কত রাত এই চিন্তা করতে করতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতাম কি করে দিদিকে দেখবো, মা রেগে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলত। বকা খেয়ে গাল ফুলিয়ে আমিও ঘুম।
মেজদা আর আলতাফ ভাই সাবধান হয়ে গেলেন। তাদের বৈকালিক কার্যক্রম শুধু মেয়ে দেখাতে সীমাবদ্ধ রইল আপাতত। মেজদা বারান্দায় বসা থাকলে আমি বারান্দার যাবার অনুমতি পেতাম এবং একটু মুক্তির স্বাদ পেতাম। ওদের সাথে বসে বসে আমিও মেয়ে দেখতাম আর বলতাম কে কোন বাসার,কার কার বয়ফ্রেন্ড আছে আর কার নেই, এইসব।
মেজদা তখন প্রায়ই ‘সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন’, এই গানটা গাইত আমিও গলা মেলাতাম সাথে।
মনে আছে মিঠুন অভিনীত ‘অবিচার’ ছবিটা মুক্তি পেল বিউটি হলে। মা কে বললাম সিনেমাটা দেখতে চাই। একদিন মা সাথে করে নিয়ে চললেন ম্যাটিনি শো দেখতে। রিকশায় যেতে যেতে মায়ের গোয়েন্দা চোখ সমানে ডানে বায়ে জরিপ করে যাচ্ছে, কে কে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আবার সময় সময় আমার দিকেও ঘুরে দেখেছেন এবং আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে পরখ করে নিচ্ছ্নে আমি কি দেখছি, কাকে দেখছি। সেদিন মনে মনে কান ধরেছিলাম যে মায়ের সাথে আর কোথাও যাবো না, আজকেই শেষ। হলে গিয়ে মাকে বললাম যে আমি আমি সাইডে মহিলাদের জায়গায় বসে সিনেমা দেখবো না, ডিসিতে টিকেট কাটতে হবে। মা কাটলেন। আমাদের সিট পড়েছিল মাঝামাঝি একটা জায়গায়। মা, মেয়েতে বসে আছি কিন্তু আমার মা অস্থির কারণ আমার পাশে এসে কে বসবে সেই চিন্তায়। হল ভরতে শুরু করল। আমাদের ডানে বায়ে দুদিকেই পুরুষ। মায়ের একটা ক্ষীণ একটা আশা হয়ত ছিল যে কেউ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ছবি দেখতে আসবে এবং সে আমার পাশে বসবে। সেটা যখন হল না মা আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে এলেন তারপরে সোজা বাসায়, নির্বিকার জানিয়ে দিলেন সিনেমা দেখা লাগবে না। সেদিন আমার মন এবং মেজাজ দু’টোই তুঙ্গে ছিল। এরপরে একদিন মেজদাকে গিয়ে ধরলাম সিনেমা দেখব বলে। বিউটি হলের মালিক সম্পর্কে আমার খালু হতেন। মেজদা গিয়ে খালুকে বলে বক্সরুম ঠিক করে ফেলল তারপরে নির্দিষ্ট দিনে আমি মেজদা এবং আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা আরো দলবল নিয়ে আমরা প্রায় ৮জন একসাথে হৈ হৈ করে সিনেমা দেখে, কোক, চানাচুর খেয়ে, ‘ছেড়োনা ছেড়োনা হাত’ গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরলাম। এই সিনামার ঘোর কাটতে অনেকদিন লেগেছে। মনে প্রেম, সাথে ক্যাসেটে যত রোমান্টিক আর ছ্যাঁকামাইসিনের গান, কিন্তু প্রেম করা তো দুরের কথা বাসায় ‘প’ উচ্চারণ করলেই মায়ের কান খাড়া। সিনেমা দেখা প্রসঙ্গে ছোটবেলার আরেকটা গল্প মনে এল। (চলবে)