Home কলাম নানান রঙের দিনগুলি-৩

নানান রঙের দিনগুলি-৩

শারমীন শরীফ : চিঠি আসে চিঠি যায় কিন্তু কথা আর কাজে মেলে না, তাই সে একদিন স্কুলে যাবার পথে সরাসরি আমার সামনে এসে দাড়াল। আমাদের কলকল গেল থেমে। আমরা বান্ধবীরা সবাই হতবাক। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি তার সাথে দেখা করতে চাই না কেন? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম দেখা করতে হবে কেন? সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল যে সে অনেক চিঠিতে আমার সাথে দেখা করার কথা জানিয়েছে এবং আমি সে প্রসংগ এরিয়ে গিয়েছি এবং উত্তর দেইনি। আমি তাকে জানালাম যে আমি এসব জানি না, পথে থেকে সরতে বললাম, উনি সরে গেলেন। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। নিঃশব্দে সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি এসে অনেক ভাবলাম এই নিয়ে। বুঝলাম চিঠি নিয়ে মজা করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যাচ্ছি। এরমধ্যে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রুনু এসে আমার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলল আমাকে ভেবে চিন্তে এর উত্তর বলতে। আমি বাসায় এসে বিকেল বেলা ছাদে উঠে বসলাম চিঠি পড়তে। এবারে চিঠি হাতে আনন্দ হল না বরং কেমন ভয় লাগল। মনে হচ্ছিল কি লেখা আছে কে জানে। চিঠির খেলা খেলতে গিয়ে এটা ভাবিনি যে এর একটা ফলাফল আছে, মনে হচ্ছিল যে এভাবেই চলবে যতদিন থেমে না যায়। কিন্তু সেদিন তার পথ আটকানো দেখে বুঝলাম যে ব্যাপারটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে এখন। ভয়ে ভয়ে চিঠি খুললাম। দেখলাম অনেক অনুযোগ আছে আমাকে নিয়ে। সে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছে কিছু আমার কাছ থেকে সাড়া পায়নি। আসলে ব্যাপারটা একসময় এমন হয়েছিল যে আমি অনেক চিঠি পড়তাম না, রুনু পড়ে ওই উত্তর লিখে দিত। তাতে কি লেখা থাকত তাও আমি জানতাম না। সেদিন ওই চিঠি পড়ে আমি রুনু কে বললাম আর কোন উত্তর না লিখতে। আমার চিঠিটা ইংলিশ ডিকশোনারির ভাজে রেখে দিয়েছিলাম। কেউ ডিকশনারি ধরেও দেখে না। পরেরদিন আব্বার কোন প্রয়োজনে আব্বা সেটা নিয়েছিলেন এবং ডিকশনারি খুলতেই আব্বার পায়ের কাছে ঝপাস করে সেটা পড়ল। আব্বা সেটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন এবং মাথামুন্ড না বুঝতে পেরে মাকে ডেকে চিঠিটা দেখালেন। মাতো চিঠি দেখেই চিল্লাপাল্লা শুরু করলেন, গোয়েন্দা মা বললেন তিনি আগেই বুঝেছিলেন যে বাথরুমের ওই চিঠি আমার ছিল। যখন এসব ঘটছে তখনো আমি এর কিছুই জানি না। আমি তখন ছাদে বসে মজা করে আমড়া খাচ্ছিলাম। আমড়া খাওয়া বেরিয়েছিল তার কিছুক্ষণ পরে।

আব্বা হয়ত মাকে নিষেধ করেছিলেন কিছু বলতে কারণ মা কোন কিছু ধীরস্থির করে সামলাতে পারতেন না, পুরো এ্যকশনে চলে যেতেন ধামধুম। আব্বা বুঝেছিলেন যে বিষয়টা হয়ত আমার কাছে খুব সেন্সেটিভ হবে। রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষে আব্বা এসে আমার পড়ার টেবিলের পাশে বসলেন। জানতে চাইলেন পড়াশুনা কেমন হচ্ছে? এস এস সি পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে? আমি বললাম ভাল হচ্ছে আব্বা। তিনি বললেন ‘বেশ’। এরপরে আব্বা চিঠিটা বের করলেন, সেটা দেখেই আমার মুখ শুকিয়ে গেল, চট করে যথাস্থানে তাকিয়ে দেখি ডিকশনারিটা সেখানে নেই। ব্যাস হয়ে গেল আমার। আমি চুপ। আব্বা জানতে চাইলেন চিঠিটা আমার কিনা? আমি মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বললাম। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন ছেলেটা কে, আমি যতটুকু জানি বললাম। আসলে তার সম্বন্ধে আমি তেমন কিছুই জানতাম না। আব্বা জানতে চাইলেন সে কি পড়াশুনা করে, আমি বললাম জানি না! শুনে আব্বা হেসে দিলেন। বললেন তুমি তো এর সম্পর্কে দেখি কিছুই জান না। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আব্বা জানতে চাইলেন কতদিন ধরে চিঠি আদান প্রদান হচ্ছে? বললাম ৫/৬ মাস। আব্বা বললেন ‘মাত্র’? আমি সায় দিলাম। আব্বা জানতে চাইলেন এইযে চিঠি লিখছি আমি এর কি পরিনতি চাইছি? আমি বললাম কোন পরিনতি তো চাইনি, শুধু মজা করার জন্য এই চিঠি লেখা ছিল। আব্বা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে জানতে চাইলেন যে আমি মজা করছিলাম সেটা তিনি বুঝেছেন কিন্তু সেই ছেলে এটাকে কি ভাবে দেখছে বা কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছে আমি তা জানি কিনা? আমি বললাম যে আমি জানি না। আব্বা বললেন যে আমি ভীষন অন্যায় করেছি ছেলেটির প্রতি। চিঠিতে বোঝা যাচ্ছে যে সে বিষয়টি খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে। আব্বা আরো জানতে চাইলেন যে ছেলেটির প্রতি আমার কোন দূর্বলতা রয়েছে কিনা, আমি একটু চুপ থেকে ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে তারপরে বললাম যে আমার কোন দুর্বলতা নেই। আব্বা আমাকে আরো নিশ্চিত করার জন্য বললেন যে, ‘যদি পছন্দ করে থাক তাহলে তাকে জানিয়ে দাও যে এখন যোগাযোগ বন্ধ থাকুক, সে যেন মনযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাড়ায় তারপরে বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখা যাবে’। আমি আব্বাকে জানালাম যে আমার এমন কোন ইচ্ছে নেই। আমার ক্ষণিকের জন্য মনে হল যে আব্বা যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আব্বা তখন সেদিনকার দৈনিক ইত্তেফাকের একটা কলাম আমাকে পড়তে বললেন। সেখানে একটা লাইনের নীচে দাগ দেয়া ছিল, ‘অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢোকে প্রেম তখন জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়,’- আমি চুপ করে বসে থাকলাম এটা পরে। আব্বা তখন আমাকে বললেন যে কাউকে পছন্দ করাতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু সেটা সময়োপযোগী হতে হবে এবং মানানসই হতে হবে।

আব্বা অনেক কিছু বলেছিলেন সেদিন, শুধু আমার এই ঘটনাটা নিয়ে নয় বরং তিনি হয়ত একটা সুযোগ পেয়েছিলেন সেদিন আমাকে আলোকিত করার, ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করার। অনেক কিছু বুঝিয়েছিলেন সেদিন। আব্বা সাথে এও প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে আমি যদি কাউকে পছন্দ করি কোন ডিসিশন নেবার আগে যেন সবার আগে তাঁকে বলি। আমিও দিব্যি কেটে বললাম যে বলব। আব্বা অবশেষে বললেন যে, যে সমস্যা আমি শুরু করেছি সেটা আমাকেই শেষ করতে হবে। আমাকে ওই ছেলেকে গিয়ে সরি বলতে হবে সাথে বুঝিয়ে বলতে হবে যে কেন আমি আর কোন যোগাযোগ তার সাথে রাখব না। আমি বললাম ঠিক আছে।

মা পুরোটা সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা শব্দও করেননি। এতক্ষণে আমার মাথায় একটা চুলও থাকার কথা ছিল না। আব্বা উঠে চলে যাবার সময় মাকে শুধু বললেন, ‘ওকে কিচ্ছু বল না,”।

সেদিন রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি, প্রেম হবে না সেই জন্য নয় বরং আমি কি করে তাকে গিয়ে এই কথা বলব সেই চিন্তায়।

কয়েকদিন পরে আমি দেখলাম সে হেটে বন্ধুর বাড়ির দিকে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পুকুরপার ধরে হেটে আমার বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে গেলাম। ওর সাথে একথা সেকথার পরে বললাম- ‘ভাই কই?’ বান্ধবী বলল ‘মনির ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, কেন?’ আমি বললাম- ‘আমি মনির ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাই, তুই ভাইকে ডেকে নিয়ে আয় ওই রুম থেকে।’ সে তাই করল। ভাই রুম থেকে বেরিয়ে আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে চলে গেল। আমি ধীর পায়ে রুমের মধ্যে ঢুকলাম। আমার বুকের মধ্যের ধকধকানি যেন ১ মাইল দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিল। মনির ভাইও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালে আমি বললাম, ‘একটু কথা ছিল আপনার সাথে,’ উনি বললেন-বল, আমি বললাম, ‘আমি আপনাকে সরি বলতে এসেছি’, উনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কেন? আমি বললাম, ‘এতদিন আপনার সাথে দুষ্টুমি করেছি বলে, আমি চিঠি লেখার পুরোটা নিয়ে একদম সিরিয়াস ছিলাম না, আপনি লিখতেন আর মজা করে আমরা তার উত্তর দিতাম, কোন প্রেম থেকে নয়। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন, আমি চাই না আপনি আর কোন চিঠি পাঠান আমার কাছে’, দেখলাম ক্ষণিকের জন্য ওনার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। আর কিছু না বলে আমি উল্টে দৌড়। এক দৌড়ে বাসায়।

সেই রাতে আমি সারারাত কেঁদেছিলাম আর আমার মা আমার পাশে শুয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। ওনার মুখটা ভেবে আমার খুব মায়া লেগেছিল সেদিন, আপরাধ বোধ থেকে নিজের উপরে রাগে হয়ত এত কেঁদেছিলাম। আমার মা মিলিটারি মা সেদিন কিচ্ছু বলেননি, একেবারে নীরব ছিলেন। একটা সময়ে এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘মা, জীবনে বিয়ে করিস না কোনদিন, এই ছেলেতো নয়ই, কাউকেই বিয়ে করিস না, ভাল থাকবি’। আমার মায়ের সেই বাক্য অনুধাবণ করতে অনেকটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। (চলবে)

Exit mobile version