শারমীন শরীফ : সেদিনটা যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। আবছা আবছা মনে আছে। খবরটা পেয়েই বড় আপার বাসায় ছুটেছিলাম। এপ্রিল ৯, ১৯৯৪, সেদিন কোন কারণে হরতাল ছিল। আমি অনেক কষ্টে একটা রিকিশা যোগার করলাম আজিমপুরে যাবার জন্য। আধা রাস্তা যেতেই কয়েকটা ছেলে বুয়েটের সামনে পথ রোধ করে দাঁড়াল, রিকশাওয়ালাকে একটা চড় দিয়ে আমাকে ধমকে বলল রিকশা থেকে নামতে, এর পরে সব কিছু কেমন ঘোলাটে, আমি ছেলেটার শার্টের কলার ধরে কাছে টেনে একটা ধাক্কা দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমার বাবা মরে গিয়েছে আর তুই আমাকে হরতাল দেখাচ্ছিস? রিকশার সামনে থেকে সর না হলে মেরে ফেলব’, আমি মনে হয় পাগলের মত চীৎকার করছিলাম। অন্য দুই, তিনটা ছেলে ওই ছেলেটাকে টেনে সরিয়ে নিল রিকশার সামনে থেকে। আমাকে বলল যান, কি একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল যে সামনে আবার যদি কেউ আটকায় তো ওই কাগজটা দেখাতে। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিলাম ওদের মুখের দিকে, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না ওরা কি বলছে। একটা ছেলের হাতের ইশারায় রিকশাওয়ালা ঝড়ের গতিতে টান দিল রিকশায়।
আপার বাসায় পৌঁছে, দরজা দিয়ে ঢুকেই যখন শুনলাম আপা কাঁদছে তখন বুঝলাম আসলে সত্যি সত্যি আব্বা আর নেই। আমি মনে হয় কয়েক পা এগিয়েছিলাম, এরপরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন জ্ঞান এল দেখি আমি আমার ভাগ্নিদের বিছানায় শুয়ে আছি। ভাই-বোনরা প্রায় সবাই তখন আপার বাসায়। আমি উঠে বসে থাকলাম চুপচাপ। সবাই আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে একটা এম্বুলেন্সে করে সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমরা বরিশালে যাবো, তাহলে পথে কেউ আর আটকাবে না। মেজদি হাসপাতালে ফোন করে এম্বুলেন্স যোগার করে ফেলল। আমরা দুপুর ১টার দিকে বরিশালে রওনা হলাম। সারা পথে আমি কোন শব্দও করিনি। রাত ৯টায় এম্বুলেন্স আমাদের বরিশালের বাসার সামনে থেমেছিল। এম্বুলেন্সের দরজা খোলার সাথে সাথে আমি তীরের মত ছিটকে বেরিয়েছিলাম এম্বুলেন্স থেকে। এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি, উঠানে একটা কাঠের বাক্সে আমার বাবা শুয়ে আছে, সারা শরীর চা-পাতায় ঢাকা আর মুখটা কি যে মলিন, কত যেন কষ্ট হয়েছিল। আমি আব্বার কাছে পৌঁছে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে একটা চীৎকার দিয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
সেদিন রাতে কি ভীষণ ঝড়, কি বাতাস। সিদ্ধান্ত হল গ্রামের বাড়িতে মায়ের পাশে আব্বাকে দাফন করা হবে। বরিশাল থেকে আরো ৪ ঘন্টা দূরে যেতে হবে আমাদের। একটা ট্রলার ঠিক করা হয়েছিল। আমরা রাত ১টায় আব্বাকে নিয়ে সেই ট্রলারে উঠলাম। খোলা ট্রলার, প্রচন্ড বাতাস, উত্তাল নদী। সে কি বিশাল বিশাল ঢেউ। বোনদের সাথে তাঁদের বাচ্চারা ছিল। আমি জানিনা কেন সবাই বোকার মত সেদিন রাতে ওই ট্রলারে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঢেউয়ে ট্রলার উল্টে গেলে সেদিন আরো ২০জন মানুষের জীবন শেষ হয়ে যেত। ওই মুহূর্তে আমার মাথায় কিছুই ছিল না, আমার মনে আছে আমি আব্বার বাক্সের মাথার কাছে বসে শক্ত করে বাক্সটা জড়িয়ে ধরে ছিলাম। আমার মনে শুধু একটা কথাই আসছিল তখন যে, যদি ট্রলার ডুবে যায় তাহলে আব্বাকে নিয়ে বাক্সটা নদীর অনেক নীচে চলে যাবে, আমি আর দেখতে পাব না আব্বাকে। আমার মনে হচ্ছিল আমি শক্ত করে বাক্সটা ধরে রাখলে বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যখন গ্রামের সীমানায় ঢুকেছিলাম তখন ফজরের আজান হচ্ছিল মসজিদে। আমাদের বাড়ির ঘাটে ভেড়ানো হয়েছিল ট্রলারটা। সবাই মিলে কাধে করে আব্বাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। আমরা সবাই পেছন পেছন হেটে গেলাম। আমার মনে আছে আমি সোজা কবর স্থানে মায়ের কাছে গেলাম। কবরস্থানের দেয়ালের উপরে বসে আমি মাকে বলেছিলাম, ‘মা, তুমি চলে যাবার পরে গত একটা বছর আব্বা ভীষণ কষ্টে ছিল, আজকে আব্বাকে তোমার কাছে রেখে যাব। এবার তোমরা দু’জন মিলে খুব ভাল থেকো।’ দেখলাম মায়ের পাশে আব্বার কবর খুঁড়ে তৈরি হয়ে আছে, আমার বাবার নতুন ঠিকানা, যেখান থেকে শত ডাকলেও তাঁকে আর পাবো না, সে আর বলবে না, ‘ডাকিস কেন মনা?’
আমি ধীর পায়ে হেটে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। বাড়িতে ঢুকে মনে হল ঠিক এক বছর আগেও এমনি হয়েছিল। আমরা সবাই এসেছিলাম মাকে দাফন করতে, সেদিন আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখার জন্য আব্বা ছিলেন আর আজ তাঁকেই বিদায় জানাতে এসেছি। ভাইয়েরা আব্বাকে গোসল দিচ্ছে আর বোনেরা সবাই দোয়া পড়ছে। আমাকে দেখে আমার চাচাতো বোনেরা বলল, ‘ওই তো মনি। কই ছিলি তুই? যা ওজু করে আয় তাড়াতাড়ি, কবরে নামানোর আগে দোয়া খতম করতে হবে।’ আমাকে ধরে পুকুরপাড়ে নিয়ে আমেনা খালা (আমাদের বাড়ির সেই রাঁধুনি খালা) ওজু করিয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে এনে বোনদের পাশে বসিয়ে দিল। আমি কি দোয়া পড়েছি বা আদৌ কিছু পড়েছি কিনা মনে নেই। কখন এসে ভেতর বাড়িতে কে একজন খবর দিল যে আমার বাবা যাবার জন্য প্রস্তুত। আমি স্প্রিংএর মত লাফিয়ে উঠে ছুটেছিলাম আব্বার কাছে। সবাই আব্বাকে কাধে তুলে যখন নিয়ে যাচ্ছে কবর স্থানে, গত চব্বিশ ঘন্টায় এই প্রথম আমি চীৎকার করে কেঁদে বলেছিলাম, ‘নিও না আমার আব্বাকে, আব্বাকে ছাড়া আমি থাকব কি করে? মরে যাব আমি, প্লিজ নিও না আমার আব্বাকে।’ আমাদের বংশের সব থেকে বড় মেয়ে, আমাদের সব থেকে বড় বোন, আনোয়ারা বুয়া, আমার বড় চাচার বড় মেয়ে, যিনি কিনা আমার আব্বার থেকেও বড় ছিলেন, তিনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি শুধু ফোঁপাচ্ছিলাম আর বলছিলাম, ‘বুয়া আব্বা চলে গেল, আমি থাকব কি করে?’ সবার অনুরোধে আব্বার মুখটা শেষবারের মত দেখতে দিয়েছিল, আমি আব্বার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছিলাম, ‘তুমি ভাল থেক আব্বা।’
আব্বাকে দাফন করার পরে আমার তিন চাচা সবাইকে কবরস্থান থেকে একটু সরে যেতে বললেন। আমার তিন চাচা, তিন ভাই হাত ধরে আব্বার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আব্বাকে বলেছিল, ‘হেমায়েত তুমি আমাদের মধ্যে সবার ছোট, বাপজান আমাদের বলেছিলেন তোমাকে দেখে রাখতে আর আজকে আমাদের সবার আগে তুমি চলে গেলে। ভালই হল, তোমাকে বিদায় দিয়ে এরপর আমরা একে একে আসছি।’ একটু দূরে আমি মাটিতে বসে ছিলাম। চাচারা সরে যেতেই আমি দৌড়ে গিয়ে আব্বার কবরে শুয়ে পড়লাম। ছোট ভাই, দাদা আর মেজদা এসে আমাকে টেনে তুলে বলেছিল মেয়েদের কবর স্থানে ঢুকতে নেই। আমাকে কাধে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল দাদা। যে বাড়ি আমার এত প্রিয় ছিল, এত আপন ছিল, এই প্রথম বারের মত মনে হল, এই বাড়িতে আমি আর কেউ নই। এই পৃথিবীতে আমি আর কেউ নই, মৃত্যুর থেকে সত্যি আর কিছু নেই।
মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।
আজকের আগে যেই জীবনের ভিড় জমেছিলো
তা’রা ম’রে গেছে;
প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে
অন্ধকারে হারায়েছে;
তবু তা’রা আজকের আলোর ভিতরে
সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে। (জীবনানন্দ দাশ)
এর কয়েক বছর পরে আমার সেজচাচা বিদায় নিয়েছিলেন, এরপরে গিয়েছিলেন আমার মেজচাচা। সবাইকে বিদায় দিয়ে ১০৬ বছর বয়সে সবার শেষে গিয়েছিলেন আমার বড় চাচা, যিনি ছিলেন আমার আব্বার কাছে তাঁর বাবার মত। মায়ায় ভরা ছিল আমার সব চাচাদের হৃদয়। আব্বা চলে যাবার পরে আমার পৃথিবী শূণ্য হয়ে গিয়েছিল, সেই শূণ্যতা কোনদিন পূরণ হয়নি। আব্বা, সেই সবুজ বোতলের তারা হয়ে গেলেন আর আমি এখনো মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কোনটা তুমি আব্বা?’ একদিন আমিও হারিয়ে যাব, জানিনা না আমার ছেলে তারাদের ভীরে আমাকে খুঁজবে কিনা। জানি খুঁজবে না কারণ ওরা তো আর আমাদের মত বোকা নয় বা সেন্টিমেন্টের ডিপোও নয়। আমি চাই না আমার সন্তান আমার মত কষ্ট পাক, চাই সে পাথরের মতই শক্ত হোক, কোন দুঃখ যেন তাকে স্পর্শ না করে।