শারমীন শরীফ : এই যাত্রায় মুনির আর সেলিম কে খুঁজে পেলাম না। আতিক বলল সে জানে না সেলিমের খবর কিন্তু মুনিরের নাম্বার দিল। আমি মুনিরকে কল করলাম। সে বিয়ে করেছে এবং ভাল আছে জানলাম। সেলিমের কথা জানতে চাইলে বলল সেলিম কোন একটা কলেজে পড়ায়, একটা মেয়ে হয়ে মারা গিয়েছে সদ্য এবং সে মানসিক ভাবে খুবিই বিপর্যস্ত। কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না। মুনিরকে বললাম দেখা করতে আসতে, বলল আসবে কিন্তু আর এল না দেখা করতে। ভীষণ মন খারাপ হল। দেশ ছাড়ার পরে সন্তান নিয়ে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ গিয়েছি, শ্বশুর বাড়ি অনেক ব্যস্ত করে রাখল তাই বন্ধুদের মিস করার তেমন সময় পাইনি। তাঁর মধ্যেও তুলি, রুনা, সীমা, পলি, সিরাজ, ডেইজি, মামুন আর আতিক আমাকে সময় দিয়েছে, দাওয়াত করে খাইয়েছে। সঞ্চিতা কোথায় কেউ জানে না, পপি ইউকে-তে। মামুনের বাসায় দাওয়াতের দিন সে অনেকগুলো ছবি তুলেছিল। যাবার আগের দিন সে আবার কষ্ট করে এসেছিল ছবির সিডিটা দিতে।

আমি তখন সবে মাত্র ভর্তি হয়েছি ইউনিভার্সিটিতে, ক্লাসের সবাই তখন বন্ধু। নির্দিষ্ট কোন সার্কেল তখনও গড়ে ওঠেনি। একদিন সকালে অপরাজেয় বাংলার সামনে বসে আমাদের ডিপার্টমেন্টের অন্তত ২০জন বসে আড্ডা দিচ্ছি। সবার সাথে তেমন ভাল করে পরিচয়ও গড়ে ওঠেনি। আমাদের চা-দাতা সূর্য (তখনও সূর্য, সূর্য হয়ে ওঠেনি) এসে আমার হাতে একটা চিরক‚ট দিল। আমি খুলে দেখলাম একটা কবিতা। আমি কবিতাটা পড়ে সূর্যর কাছে জানতে চাইলাম কে দিয়েছে? সূর্য আঙ্গুল তুলে যাকে দেখাল সে আমার আরেক ক্লাসমেট। আমি যখন সেই ছেলেটির দিকে তাকালাম দেখলাম সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো, শ্যামলা, লম্বা, একমাথা চুলের নীচ থেকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। আমি জানি যে সে জানতে চাচ্ছিল আমার অনুভূতি। কবিতাটা হাতে নিয়ে আমি কয়েক মুহূর্ত ভেবেছিলাম কি করব। পলকে একরাশ আতংক এসে ভর করেছিল আমার মধ্যে বাসায় বোনদের ধাতানির কথা ভেবে।

আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়াটাই একটা ইতিহাস। আমার সব বোনেরা চেয়েছিল আমি ইডেনে পড়ি কন্তু খবর পেয়ে আব্বা এসে হাজির এবং তিনি ঘোষণা দিলেন যে আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। বোনেরা আব্বাকে বোঝাল যে সেটা খুব একটা খারাপ জায়গা। তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে আব্বাকে ভার্সিটি ট্যুরে নিয়ে গেল। ভার্সিটির সব চিপাচাপায় আব্বাকে নিয়ে গিয়ে দেখাল যে সেখানে বসে ছেলে-মেয়েরা কি ভাবে প্রেম করে এবং কোন পড়াশুনা করে না, আরো বলল যে আমিও এগুলো করব এবং এসবে তাঁরা নজর রাখতে পারবে না। আব্বা কিছুই নাকি বলেননি পুরোটা সময়ে, গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষন করেছিলেন সব (মেজদা সে দলে ছিল বিধায় আমি শুনতে পেরেছি পরে)। ট্যুর শেষে উত্তরায় মেজদির বাসায় মিটিং বসেছিল।

আব্বা আমাকে বললেন অন্য রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে, সময় হলে আমাকে ডাকবেন। আব্বা বড় বোনকে সেদিন সরি বলেছিলেন তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার জন্য এবং বড় দুলাভাইকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন যে বিয়ের পরেও আপাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে এম, এ পাশ করানোর জন্য। মেজদি কে জিজ্ঞেস করেছিলান সে সেই ৮০র দশকে আব্বা বিনা দ্বিধায় মেজদিকে বরিশাল মেডিকেল কলেজে পড়তে দিয়েছিলেন কিনা? মেজদি মৌন ভাবে সম্মতি জানাল। তারপরে আব্বা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এখন বল, মেডিকেল কলেজ কো-এডুকেশন ছিল কিনা?’ মেজদি আবার হ্যাঁ বলল। তখন আব্বা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি প্রেম করে বিয়ে করেছ কিনা?’ মেজদি মাথা নিচু করে আবার হ্যাঁ বলল। আব্বা তখন বলেছিলেন, ‘তাহলে তোমাদের ছোট বোনের প্রতি তোমাদের এমন বিরূপ আচরণ কেন? মনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই পড়বে। প্রেম যদি করে তো করবে, কি আর করা?’ আমাকে ডেকে আব্বা বললেন, ‘তুমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই পড়বে, সময় এসে গেলে ভর্তি হয়ে যেও, ইডেনে আর গিয়ে কাজ নেই।’ আমি খুশিতে আব্বার গলা ধরে ঝুলে পড়েছিলাম। আব্বা হেসে বলেছিলেন, ‘মনা পড়ে যাব তো!’

আমার বোনেরা কেন যেন কিছুতেই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। কেন, কি জন্য তা আমি আজো জানিনা। তবে আব্বা আমাকে বলেছিলেন, ‘মামনি, ঝোপে-ঝাড়ে বসে প্রেম কোর না, প্রেম করলে সবাইকে জানিয়েই প্রেম কোর আর সবার আগে আমাকে জানিও।’ আমি নিরবে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম। সেদিন সকালে ওই কবিতাটি পেয়ে আমার এইসব কথা মনে পড়েছিল এবং ভয় পেয়েছিলাম। আমি কবিতাটি সূর্যর হাতে ফেরত পাথীয়েছিলাম, সে সেটা হাতে নিতে হেটে চলে গিয়েছিল এবং কষ্ট পেয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই সে সাবজেক্ট বদল করে অন্য ডিপার্টমেন্টে চলে গিয়েছিল। আমি তার নামটা লিখালাম না কারণ আমার বন্ধুরা এই বিষয়টা জানে না, সব থেকে মজার কথা হল, ওর সাথে ধীরে ধীরে একটা নির্মল বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পরে, যে সম্পর্কটা ক্ষীণ হলেও এখনো আছে। আমরা কোনদিন এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করিনি কিন্তু আমার মনে হয় ওর কবিতাটি যে আমি ফেরত দিয়েছিলাম সেটার জন্য আমাকে কোনদিন মাফ করেনি সে (তুই যদি এই লেখাটি পড়িস, তাহলে জানলি যে আমি দুঃখিত, মাফ করে দিস দোস্ত)।

আমার ইউ এসের ভিসা হয়ে যাবার এবং টিকেট করফার্ম হয়ে যাবার পরে আমি একদিন আমি রেজিস্টার বিল্ডিংএ গেলাম আমার সার্টিফিকেটস তোলার জন্য। কাজ শেষ করে আমি ক্যম্পাসে মুনিরকে খুঁজে বের করলাম এবং ওকে বললাম যে চলে যাচ্ছি। শুনে মুনির কিছুতেই বিশ্বাস করে না, পরে ঝিম মেরে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল যে আমি ব্যাস্ত না হলে আজকে ওর সাথে ঘুরতে পারব কিনা, বললাম পারব। মুনির তখন অলরেডি ওর প্রগ্রেসভ প্রিন্টার্স (নীলক্ষেত) নিয়ে অনেক ব্যাস্ত। সেদিন সারাদিন কাজ নিয়ে এখানে সেখানে অনেক দৌড়াদৌড়ি করল এবং আমিও সারাদিন ওর সাথে টো টো করলাম, রিকশায় বসে আমাদের দুনিয়ার যত কথা, যার কোন মাথা-মুন্ডু নেই। দুপুরের কিছু পরে আমরা ডাসে খেলাম তারপরে বললাম বিদায়! সেই বিদায় অনেক কষ্টের ছিল, সেই মুহূর্তে আমরা জানতাম না আবার কবে দেখা হবে। মুনির ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল আমি যখন ক্ষণিকায় উঠে গেলাম। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেছিলাম ওর রক্তশূণ্য-ফ্যাকেসে মুখ।

জীবনে চলার পথে আমি হারিয়েছি অনেক কিছু আবার পেয়েছিও অনেক কিছু। ১৯৯৪ এর এপ্রিল ৯ আমার জীবনের সব থেকে ব্যাথাময় দিন। আব্বা ঢাকা এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য, ১০/১৫ দিনের মত ছিলেন ভাইয়ার বাসায়। যাবার দিন আব্বা আঝোরে কাঁদলেন। আমাকে ফেলে যাবার সময় আব্বা সব সময়ই কাঁদেন কিন্তু এবার যেন অন্যরকম আকুতি আব্বার। কিছুতেই আমাকে ছেড়ে রিকশায় উঠতে চাচ্ছিলেন না। বার বার বলছিলেন, মনি মনা, মামনি, আর কিছু না। শুধু নাম ধরে ডাকছিলেন আমার। রিকশায় উঠে ঝুকে তাকালেন আমার দিকে। আমার বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিল শুধু। মনে মনে বলছিলাম, ‘আর কটা দিন আব্বা, আর তোমাকে একা থাকতে হবে না, মাস্টার্স পরীক্ষাটা দিয়েই আমি আসছি তোমার কাছে, আর যাবো না’। বিধাতা মনে হয় মুচকি হেসেছিলেন সেদিন। ২ মাস বাদে খবর এল আব্বার চিকেন পক্স হয়েছে এবং শরীর খুব খারাপ। আব্বা বরিশালে মেজদার কাছে। আমি যাবো বলে লঞ্চ ঘাটে গেলাম, সেদিন কি ভীষণ ঝড়। এতগুলো লঞ্চ দাঁড়িয়ে ছিল ঘাটে কিন্তু কোন একটা লঞ্চে একটা বা আধাটা কেবিনও খালি ছিল না। সব লঞ্চ ছেড়ে গেল একে একে, আমি একটাতেও জায়গা পেলাম না। ফিরে গেলাম বাসায়। ভাবলাম পরদিন সকালেই কেবিন বুক করব। সকাল ৯টায় খবর এল আব্বা আর নেই। আমাকে একা ফেলে সে চলে গিয়েছে সব কিছুর উর্ধ্বে। এবারে আমি সত্যি সত্যি একা হয়ে গেলাম। পাহাড়ের মত যে মানুষটা আমাকে আগলে রাখত সে নেই! আমার শুধু মনে পড়তে লাগল রিকশা থেকে বাড়ানো পান্ডুর সেই মুখটা।