Home কলাম নানান রঙের দিনগুলি-২৪

নানান রঙের দিনগুলি-২৪

শারমীন শরীফ : ২য় বর্ষ ফাইনালের পরে বরিশাল গেলাম। মেজদা এসে নিয়ে গেল। প্ল্যান ছিল কয়েকদিন বরিশালে থেকে গ্রামের বাড়িতে মা আব্বার কাছে চলে যাব। কিন্তু বরিশালে গিয়েই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। অনেক জ্বর, কিছুতেই নামে না আর সেই সাথে পিঠে ভীষণ ব্যাথা, উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। মেজদা খুব ভয় পেয়ে গিয়ে আব্বাকে খবর দিল। আব্বা পরের দিনই বরিশালে এসে হাজির। এসেই তাঁর কাজ হল সারাদিন, রাত আমার মাথার কাছে বসে মাথায় পানি ঢালা আর বসে বসে আমার চুল শুকানো। আমার মাথায় এত চুল ছিল যে চিরুনি ভেঙ্গে যেত মাথা আঁচড়াতে গেলে। মেজদা একটা কাঁচি এনে মধ্যে মধ্যে চুল কেটে দেয়াতে আব্বা হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন। তাঁর খুব মন খারাপ হল আমার চুল কেটে দেয়াতে। শুরু হল ডাক্তারের পরে ডাক্তার দেখান, এই টেস্ট, সেই টেস্ট, এক্স-রে ইত্যাদি। অবশেষে ধরা পড়ল যে আমার বোন টিবি হয়েছে, শিরদাঁড়ার তিনটি হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। আব্বা হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করল। ডাক্তার বলল যে ওষুধ আর ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করলে একদম ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাস শুরু হল খাদ্য অত্যাচার। সকাল, দুপুর, রাত চলল খাওয়া আর খাওয়া। আমি দুধ খেতে কখন ভালবাসি না কিন্তু এবারে কোন গাইগুই চলল না। দুধ আর ডিমের বন্যা বয়ে যেতে শুরু করল। আমার বেচারা ভাবী সারাক্ষণ পায়ের উপড়ে থাকত আমার খাবার যোগান দেবার জন্য। সব দোষ গিয়ে পড়ল হলের উপরে। আব্বা নিশ্চিত যে হলের খাবার ভাল না বলে আমি ঠিক মত খাই না। আসলে হলের খাবারের কোন দোষ ছিল না, দোষ ছিল আমার। ক্যাম্পাসে সারাদিন এত চা খেতাম যে অন্য খাবারের রুচি থাকত না। আব্বা ঘোষণা দিলেন যে আর ঢাকা গিয়ে কাজ নেই, বি এম কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে। এবারে শুরু হল আমার কান্নাকাটি। বি এম কলেজে পড়ব মানে কি?

আব্বাকে কথা দিলাম যে সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়ে আমি বি এ পরীক্ষা দেব এবং তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে তাঁর কাছে ফিরে আসব। তিনটা মাস আমাকে বরিশালে থাকতে হয়েছিল। বাইরে কোথাও যেতাম না। ঘরে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখা, আব্বার সাথে গল্প করা আর রাজ্যের বই পড়া। মেজদাকে বইয়ের নাম লিখে দিতাম আর মেজদা সেগুলো এনে দিত। এমন অবস্থা হল যে আমি আমার বন্ধুদের নাম পর্যন্ত ভুলে যেতে শুরু করলাম। পলিটিক্যাল সাইন্সের এক বড় ভাই যিনি কিনা অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন এবং মাস্টার্সেও তাই হবেন নিশ্চিত, তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যত জ্বল জ্বল করছে। তিনি আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন এবং বরিশালে আসার সময়ে লঞ্চে তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতা সহ পুরো পরিবারের সামনে পড়লাম আমি। তিনি ভীষণ অবাক এবং খুশি হলেন আমাকে দেখে এবং তাঁর মাকে ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তখনই আমি বুঝেছিলাম তাঁর ভবিষ্যত উজ্জ্বল হলেও আমার ভবিষ্যত ভীষণ রকম অন্ধকার। তিনি খুবই একজন ভাল মানুষ ছিলেন কিন্তু তাঁর স্ত্রী হবার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ওনার বাবা মেজদার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার সাড়ে সতেরো গোষ্ঠীর খবর নিয়েছিলেন। আমি মেজদাকে বকা দিয়েছিলাম এত খবর দেবার জন্য। মেজদা বেচারার মত মুখ করে বলল, ‘আমি কি করব, মিথ্যা বলব কেন। ছেলে তো ভাল,’…আমি শুধু বললাম, ‘কচু’। তাঁরা আব্বার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।
আব্বা ওনাদের বলেছিলেন মেয়ের সাথে কথা বলে যানাবেন। এইবারে আব্বা আমাকে চেপে ধরলেন এই বিয়েতে রাজি হবার জন্য। আমি শুধু আব্বাকে বললাম, ‘তোমার সাথে আর কথাই বলব না এই নিয়ে আর কিছু বললে।’

আব্বা মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলেন। প্রতি দুই সপ্তায় আমার এক্স-রে করা হত আর আব্বা ডাক্তারের কাছে জানতে চাইতেন আমার উন্নিতির কথা। প্রায় তিন মাস পরে ডাক্তার আব্বাকে প্রথম এবং শেষ এক্স-রের ছবি দেখালেন পাশাপাশি রেখে এবং আব্বা নিজ চোখে দেখতে পেলেন যে আমার হাড়ে আর কোন ক্ষয় নেই। ভরে গিয়েছে পুরোটা।

আমি ঢাকায় ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম আর শুরু হল আব্বার অশান্তি। ফিরে গিয়ে কি খাব? কেমন করে খাব এই সব নিয়ে টেনশন। আমি আব্বাকে বললাম যে আমদের রুমের বারান্দায় মেয়েরা ছোট্ট একটা রান্না ঘরের ব্যাবস্থা করে নিয়েছে, আমি সকাল বিকাল সেখানে ডিম সেদ্ধ করে খাব সাথে ভাল ভাল খাবার খাব এবং আর চা খাব না। আব্বা মেনে নিয়ে চলে গেলেন গ্রামের বাড়িতে আর আমি চলে গেলাম ঢাকায়। ফিরে গিয়ে জানলাম সেলিম অসুস্থ এবং ওর বোন টিবি হয়েছে। ওর ঘাড়ে দুইটা হাড্ডিতে ক্ষয়। আমি সেলিমের কাছে আমার অবস্থা বলতে ও বিশ্বাস করল না প্রথম পরে মেনে নিয়ে হাসতে শুরু করল। আমি বললাম, ‘তোর চিরতার পানি এর জন্য দায়ী’। সেলিম একদম নিজের যত্ন নিত না। সময় সময় আমি আর মুনির জামিল স্যারের কাছে নালিশ করতাম। স্যার স্লিম কে ডেকে বলতেন ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করতে, না হলে ক্লাসের কোন কাজে ওকে ডাকবেন না এবং দু’একবার ওকে বাদ দেয়াতে সেলিম ভরকে গিয়ে ঠিক মত খাওয়া শুরু করল। তখন আবার মিলি ওর প্রেমে পাগল এবং দু’জনকে প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যেত চারুকলার ডোবার গাছ তলায়। মিলি দ্বায়িত্ব নিল সেলিমের দেখভাল করার, আমরা তখন সেলিমকে আর খুঁজে পেতাম না। আতিক আর সঞ্চির মধ্যে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হল। ওদের কোন পছন্দে মিলত না যেমন, আমরা রাস্তায় হাটতে হাটতে রাস্তার বসে ধারে যে কোন চায়ের দোকানের চা খেয়ে নিতাম কিন্তু সঞ্চি কিছুতেই সেখানে চা খাবে না। পপি আমাদের সাথে তখন অনেক আড্ডা দিত কিন্তু ও বেশির ভাগ সময় কাটাত কবিতা আবৃত্তির সংগঠনে। আমরা তখন জানতাম না কিন্তু পরে জেনেছিলাম জাহিদ ভাই ছিলেন মূল কারণ। ও আমাকে প্রায়ই কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। ও একবার আমাকে শুনিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি। আমি জীবনেও ভুলবা না আমার সেই অনুভূতি। ওর আবৃত্তি শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছিল সেদিন। এরপরে জীবনে আমি যতবার এই কবিতাটি পড়েছি বা শুনেছি আমার পপির কথা মনে হয়েছে। ওর মত করে আর কেউ পারেনি কবিতাটি পড়তে। পপি প্রায়ই সঞ্চিকে বোঝানোর চেস্টা করত, কিন্তু সঞ্চি রেগে চলে যেত। আমরা হাল ছেড়ে দিলাম আর আতিকও ক্লাসে আসা কমিয়ে দিল। ওকে অর হলে বা বাসায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি ঢাকায় এসেই সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম আব্বাকে খুশি করার জন্য। মাঝে মাঝে কলেজে যেতাম আর গন্ডা খানেক ছেলের সাথে আড্ডা দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসতাম। ওখানে কি পড়াচ্ছে বা কি বই পড়াচ্ছে আমি কিচ্ছু জানতাম না। মাস কয়েক গিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম এনং চিঠি লিখে আব্বাকে জানিয়ে দিলাম যে বি এ পরীক্ষা বা কলেজ আমাকে দিয়ে হবে না।

তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ার। একদিন হঠাত আতিক এসে উদয় হল দুপুরের দিকে। এসে বলল- খাওয়া, ক্ষুধা পেয়েছে। আমরা ৪জন মিলে ডাসে গেলাম তেহারি খেতে। খাওয়া শেষ হলে আমাকে বলল, ‘শেষ ক্লাসটা করিস না।’ মুনির, সেলিম ক্লাসে চলে গেলে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি করবি এখন’, আতিক বলল, ‘চল গাজিপুর যাই চা খেতে’। বললাম, ‘চল’। আমরা শুধু শুধু ক্ষণিকা বাসে চড়ে চলে গেলাম ক্ষণিকার লাস্ট স্টপ গাজিপুরে। মামুদের সাথে বসে মজা করে সর ভাসা চা আর আনারকলি বিস্কিট খেয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে বাস খালি থাকায় আমরা একদম সামনের সিটে একসাথে বসে মামুকে বললাম আমার প্রিয় ক্যাসেটা চালাতে। আমার পছন্দের গানের সাথে আমি গুনগুন করছি আর আতিক পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। হঠাত সে আমার একটা হাত ধরল। আমি কিছুই বললাম না। গাজিপুর থেকে ক্যাম্প্যাস পুরোটা সময় আতিক আমার হাত ধরে বসে থাকল কিন্তু একটা কথাও বলল না। আমরা ডাসের সামনে নেমে গেলে ও হেটে হেটে আমাকে হলের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ক্লাস করিস না কেন?’ বলেছিল, ভাললাগে না। গেটের কাছে এসে অদ্ভুত ভাবে বলল, ‘ভাল থাকিস’ বলে চলে গেল। এরপরে আমরা কেউ আর ওকে খুঁজে পাইনি। ওর বাসায় গিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে সে পুনায় চলে গিয়েছে ফিল্ম নিয়ে পড়তে। কেউ ওর ঠিকানা জানত না। আমার কেমন শূণ্য লাগত সবকিছু। এরপরে আমার আতিকের সাথে আবার দেখা হয়েছিল ১৪ বছর পরে। ওর পুত্র সাধু তখন কয়েক বছরের আর আমার পুত্রের তখন ১১ মাস বয়স। আমি ঢাকায় এসেছি জেনে সে অস্থির হয়ে গেল দেখা করবার জন্য। ওর বাসায় গেলাম, নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিল সেদিন। খুব যত্ন করে মগজ ভুনা করেছিল, কিন্তু আমি মগজ খাই না তাই আসিফ সেদিন মজা করে আমাদের দু’জনারটাই খেয়েছিল। আমাদের এসব গল্প আসিফ জানত বলে ওরা দু’জন আমাকে আর, আমার মেজাজ নিয়ে অনেক মজা করতে শুরু করল আর আমি একটু দূরে বসে অবাক হয়ে ওদের দেখছিলাম আর ভাবছিলাম জীবনটা আসলেই আজব।

Exit mobile version