শারমীন শরীফ : সেদিন ক্লাস শেষে হলে ফিরে, শাওয়ার নিয়ে, খেতে যাবার জন্য রেডি হচ্ছি হঠাত সঞ্চি রুমে এসে হাজির। এসেই বলল, ‘খেয়েছিস, না খেয়ে থাকলে খেতে হবে না। বাসায় চল, ওখানে গিয়ে খাবি। কাপড় নে সাথে, রাতে বাসায় থাকবি।’ আমিও কোন দ্বিরুক্তি না করে ওর কথা মত তৈরি হয়ে নিলাম। আমার শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগে একটা রাতের জামা নিয়ে নিলাম। আমি যে রাতে হলে থাকব না তাঁর জন্য সঞ্চি তৈরি হয়ে এসেছিল কারণ ওর হাতে ওর বাবার সই করা চিঠি ছিল, যেটা রেবু আপার কাছে দাখিল করে রাতে হলের বাইরে থাকবার পারমিশন নিতে হয়েছিল।

আমরা রওনা করলাম মিন্টু রোডের দিকে। যেতে যেতে সঞ্চি কোন কথা বলল না, দু’জনেই একদম চুপ। সঞ্চির বাবা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন, সেই সূত্রে ওরা মিন্টু রোডের সরকারি বিশাল ভবনের একটাতে থাকত। ওদের বাড়িতে অনেক যেতাম আমি তবে, হলে থাকতে শুরু করার পর থেকে বেশি যাওয়া হয়েছে। যেদিন হলের খাবার খেতে ইচ্ছে হত না, সেদিন সঞ্চির বাসায় চলে যেতাম খাওয়ার জন্য,কিন্তু রাতে থাকা হয়নি কোনদিন। সেদিনও বাসায় ঢুকে সোজা রান্না ঘরে গিয়ে রান্নার মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম কি রান্না হয়েছে। মেয়েটা বলল, ‘টক বেগুন, করল্লার চচ্চড়ি, আলু ভাজি আর ডাল’। কেউ খেয়েছে কিনা সে নিয়ে অপেক্ষা করার সময় আমার নেই কারণ ক্ষুধায় আমি চোখে তখন অন্ধকার দেখছি। আমি হাড়ি থেকেই একটা প্লেটে ডাল, ভাত, আলু ভাজি আর চচ্চড়ি নিয়ে এসে টেবিলে বসলাম। সঞ্চি এসে আমার সামনে বসল, আমি বললাম, -খাবি না? সে বলল খেয়েই তবে আমাকে আনতে গিয়েছে। আমি বললাম, – ‘শালি’। সঞ্চি হেসে দিয়ে জানতে চাইল আমি টক বেগুন খাচ্ছি না কেন? আমি তখনও জানতাম না এই টক বেগুন কি জিনিস, তারপরে আমি আবার বেগুন খাই না, গলা কুটকুট করে বলে। আমি সেটা সঞ্চিকে বলতে সে পাত্তাও দিল না, বলল যে, এই বেগুন না খেলে আমার বেঁচে থাকার কোন মানে নাই। তো আমিও ভাবলাম যে বেগুনের এমন কেরামতি সেটা তো একটু চেখে দেখতেই হয়, তাই ওকে বললাম এক চামচ নিয়ে আসতে। ও আমার প্লেট নিয়ে গিয়ে একগাদা বেগুন পাতে তুলে নিয়ে এল। দেখেই মেজাজ খারাপ হল, ওকে একটা বকা দিয়ে একটু মুখে তুললাম চাখবার জন্য। ওমা খেয়ে দেখি এতো বেগুনের আঁচার, কেমন টক, মিষ্টি, কি দারুন খেতে। আমি চেটেপুটে সব শেষ করে ফেললাম। সঞ্চি জানতে চাইল গলা চুলকাচ্ছে কিনা। আসলে কোন কুটকুট করছিল না একদম, আমি উত্তর না দিয়ে হাসলাম।

খেয়ে দেয়ে সোজা বিছানায়। সঞ্চিকে কোথাও দেখলাম না। আমি কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে উঠে বারান্দায় চলে এলাম। মিন্টু রোডের এই সরকারি বাড়ি গুলো কি যে বিশাল, সাবেকি রাজবাড়ি ঢংএর, বিশাল বারান্দা, পাঁচ ধাপ পেরিয়ে বিশাল বাগান। ওদের বাড়ির সব থেকে বড় আকর্ষণ ছিল একটা শিউলি ফুলের গাছ, গেটের কাছে দেয়াল ঘেঁসে বিশাল একটা গাছ। সাদা সাদা ফুলে ভরে থাকত গাছটা। ওদের বাসায় এলেই আমি শিউলি ফুলের মালা গাঁথাতাম। সেদিন ও খালি পায়ে বাগানে একটু হাটাহাটি করে দুই মুঠো ফুল নিয়ে এসে সিঁড়িতে বসলাম। সুই সুতা ছিল না বলে ফুলগুলো কোচরে নিয়ে পা ছড়িয়ে সিঁড়িতে বসে রইলাম। কিছুই ভাবছিলাম না আবার অনেক কিছুই ভাবছিলাম। সঞ্চির টিকিও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ভাবছিলাম গেল কই মেয়েটা। কতক্ষণ বসেছিলাম মনে নেই। হঠাত করে কেউ আমায় ডাকল, ‘এই মেয়ে এদিকে আস’, ঘাড় ফিরে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বারান্দার একদম শেষ মাথায় একটা আরাম কেদারায় সঞ্চির বাবা আধশোয়া হয়ে এদিকে তাকিয়ে আছেন? উনি কখন এসেছেন দেখিনি, আসলে বারান্দাটা এত বড় যে টের পাবার কথাও নয়, আমি ওঁনার দিকে তাকানোতে উনি হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি উঠে ওনার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। উনি জানতে চাইলেন আমি কে? নাম কি? কোথায় থাকি, এইসব। আমিও একে একে সব উত্তর দিলাম। উনি বললেন আমাকে আগে কখনো দেখেননি। আমি বললাম যে, আমি যখন আসি তখন তিনি কোর্টে থাকেন বলে দেখেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাত করে তিনি আমায় বললেন, ‘তুমি খুব নিঃসঙ্গ তাই না’? আমি উত্তর দেব কি? অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম ওনার দিকে। ভাবছিলাম উনি আমাকে দেখনিনি এর আগে, জানলেন কি করে আমার মনের কথা?

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি করে বুঝলেন আমি নিঃসঙ্গ?’ উনি একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘অভিজ্ঞতা’, এক নিঃসঙ্গ স্বত্বা আরেক নিঃসঙ্গ স্বত্ত¡াকে খুব সহজেই চিনে ফেলে, এই যে যেমন ধর, এক চোর আরেক চোরকে সহজেই চিনে ফেলে যেভাবে, সেভাবে’। ওনার বলার ধরণে আমি হেসে ফেললাম। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম ওনার সামনে। উনিও কিছু বলছেন না, আর আমিও নিশ্চুপ। হঠাত বললেন, ‘নিঃসঙ্গ মানুষদের বেঁচে থাকবার জন্য একটা মন্ত্র জানা খুব প্রয়োজন, তুমি জান?’ বললাম জানি না! উনি বললেন, ‘জান, কিন্তু জাননা যে ওটাই মন্ত্র’। বললাম, ‘শিখিয়ে দিন’। উনি বললেন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে”, ‘এর থেকে বড় মন্ত্র আর কিছু নেই। তুমি যদি এই মন্ত্র হৃদয়ে গেঁথে নাও তবে দেখবে, কোথাও আটকাবে না, বেঁচে থাকবার জন্য কাউকে প্রয়োজন হবে না, মনে থাকবে?’ আমি মাথা নাড়লাম, তখন উনি বললেন, ‘ এবার যাও, আমি আমার নিঃসঙ্গতাকে উপভোগ করি’। তাঁর শেখানো মন্ত্র আমি কোনদিন ভুলিনি, হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি যে। সে মন্ত্র আমার অসীম শক্তির আধার।

আমি একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে পুরো বারান্দাটা পেড়িয়ে সঞ্চির রুমে এসে ঢুকলাম। আমার ভেতরে তখন উথাল পাতাল। আমি জানতাম আমি একটা ‘লোনলি সোল’ কিন্ত এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কেউ কখনো দেখিয়ে দেয়নি যেভাবে সঞ্চির বাবা আজ দিলেন। আমি যেন নিজেকে নতুন ভাবে চিনতে পারলাম। নিঃসঙ্গতার যে ভয়টা আমার কুঁড়ে কুঁড়ে খেত সেটা আজ নতুন রূপে ধরা দিল আমার কাছে, প্রথমবারের মত জানলাম যে এই গোত্রে আমি একা নই, আছে, আরো অনেকেই আছে। রুমের মধ্যে ঢুকেই দেখলাম সঞ্চি পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসে সোজা বাইরে তাকিয়ে আছে, যেখান থেকে শিউলি গাছটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওর চোখের দিকে চোখ পড়তেই আমার নতুন জাগ্রত চেতনা আমায় বলল, ‘এই যে আরেকটা নিঃসঙ্গ স্বত্বা বসে আছে আমার সামনে’, আমি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে ফুলগুলো টেবিলে রেখে বললাম, ‘কই ছিলিস তুই’? ও সেটার উত্তর না দিয়ে জানতে চাইল ওর বাবা আমায় কি বলেছে? আমি বললাম জানতে চাইলেন আমি কে? কোথায় থাকি এইসব। আর কিছু বললাম না। এবার সঞ্চি বলল যে ও, ওর বোনের রুমে শুয়ে ছিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমায় ডেকে এনে তারপরে এড়িয়ে চলছিস কেন?’ সঞ্চি বলল, ‘কথা গুছাচ্ছিলাম কি বলব তোকে’। দেখলাম ওর মনের মেঘটা গাঢ় হয়ে জমেছে। তখন বাইরে সন্ধ্যা নামছে। সঞ্চি বলল ‘চা খাবি?’ বললাম, ‘হু’। ও রান্না ঘরে চলে গেল চা আনতে।
চা নিয়ে আমরা বারান্দায় এসে সিড়িতে পা ছড়িয়ে বসলাম। সঞ্চি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানতে চাইল আমার সাথে আতিকের কি সম্পর্ক? আমি বেশ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বন্ধুর’, ও বলল, আর কিছু না? আমি বললাম ‘না’। ও বলল, ‘তাহলে তুই ওর জন্য ব্রাশ, পেস্ট কেন আনলি?’ কি যন্ত্রণা, ও আনতে বলেছিল তাই এনেছি? এবারে আমি চেপে ধরলাম, বললাম, ‘তুই ঠিক করে বলতো এই ব্রাশ, পেস্টের কি ঘটনা?’ সঞ্চি বলল যে, এটা ওদের দু’জনার নিত্য দিনের একটা রুটিন। সঞ্চির ব্যাগে সব সময় আতিকের ব্রাশ-পেস্ট থাকে আর রোজ সকালে ক্লাস শুরুর আগে ওর কাছ থেকে আতিক চেয়ে নেয়, আজ প্রথম আতিক আমার কাছে চাইল। শুনে আমি অবাক হয়ে সঞ্চির মুখের দিয়ে চেয়ে রইলাম, বুকের মধ্যে তখন আমার ড্রাম পেটাচ্ছে।