শারমীন শরীফ : গতকাল সকালে ছেলেকে স্কুলে নামানোর জন্য বের হতেই গায়ে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস টানতেই যেন এক ঝটকায় ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে গেলাম। প্রতিবার শীতের আগে এরকম একটা অনুভূতি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সাধারণত আমি বাসায় এসে কোনমতে এক কাপ চা নিয়ে আমার অনলাইন ক্লাসে ঢুকে যাই, সকাল বেলায় সময় যেন ঘোড়ার মত দৌড়য়। কিন্তু গতকাল নিয়মের ব্যতিক্রম হল। ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় এসে গাড়ি পার্ক করে আমি হাটতে চলে গেলাম মনে মনে ভাবলাম, স্কুলে একদিন দেরি করলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। একটি দু’টো করে পাতায় রং ধরছে, নতুন ঋতুকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য শুরু হয়েছে প্রকৃতির সাজ। ঠাণ্ডায় একটু কুঁকড়ে যেতেই শালটা ভাল করে টেনে গায়ে জড়িয়ে পাতায় মুচমুচে শব্দ তুলে হাঁটতে হাঁটতে স্মৃতিতে সম্পূর্ণ ডুবে গেলাম।
আমি উত্তরায় থাকতাম বলে ক্ষণিকা বাসে আসা যাওয়া করতাম। ৭ নাম্বার সেক্টরে বোনের বাসার ঠিক সামনেই বড় রাস্তায় একটা বট গাছের নীচে এসে বাসটা থামত। তখন শীতের সকালে কেমন একটা কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকত উত্তরা। আমি বাসা থেকে বেড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে বট গাছের নীচে দাঁড়াতাম বাসে ওঠার জন্য। পপি (শাহনাজ পপি) আর আতিক উঠত খিলক্ষেত থেকে, ছায়া উঠত গুলশান ১ নং থেকে, পলি (ইশরাত জাহান) আর তারিক মাহমুদ উঠত নাখাল পাড়া থেকে। দল ধীরে ধীরে ভারী হত। আমরা মসজিদের কাছে লাইব্রেরীর পেছনে, নজরুলের মাজারের সামনে সবাই বাস থেকে নেমে যেতাম। মনে আছে শীতের সকালে ওখান থেকে হাটতে হাটতে ক্লাসে ঢোকার আগে সূর্যর কাছ থেকে আমার অন্তত ২ কাপ চা খাওয়া হয়ে যেত। আবার প্রথম ক্লাস করব কি করব না সেটাও নির্ভর করত কোন শিক্ষকের ক্লাস প্রথম। ভীষ্মদেব স্যার, রফিকউল্লাহ স্যার, হুমায়ুন আজাদ স্যার বা আকরম স্যারের ক্লাস প্রথমে থাকলে ফাঁকি দেবার কথা ভুলেও মাথায় আনতাম না। তবে এটা সত্য কথা যে আমি, মুনির, আতিক আর সঞ্চি আমরা ভীষণ রকম ক্লাস ফাঁকি দিতাম।
একবার হল কি, বাস থেকে নেমে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে গিয়ে আমি পরীক্ষার কথা ভুলে গেলাম। ভীষ্মদেব স্যারের টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ‘মেঘনাদ বদ কাব্য’ নিয়ে। পরের দিন সকালে ক্লাসে যেতেই স্যার জানতে চাইলেন আমি কোথায় ছিলাম? পরীক্ষা কেন দেইনি? স্যার বললেন যে তিনি জানেন এই ক্লাসের পরে আমাদের একটা গ্যাপ আছে অতএব যারা গতকাল পরীক্ষা মিস করেছে তারা ক্লাস শেষে থেকে যাবে এবং পরীক্ষা দেবে, দেখা গেল ক্লাস শেষে আমরা ৫/৬ জন ফাঁকিবাজ রয়ে গিয়েছি। মনে আছে লিন্তু আর স্বপ্না ছিল সে দলে বাকিদের কথা মনে নেই। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল কারণ গ্যাপ আছে বলেই আমি রিংকুকে আসতে বলেছি। রিংকুরর সাথে আজিমপুরে পরিচয়। আজিমপুরের সব পিচ্চি-পাচ্চাদের মামা সে। আমার সাথে আমার বোনের মেয়েদের মাধ্যমে পরিচয় হল রিংকুর এবং সে একটা ভীষণ চালাকি করল, আমি তাঁকে মামা ডাকতে শুরু করার আগেই আমাকে সে প্রেম নিবেদন করে বসল। আমি হ্যাঁ বা না বলার আগেই সে ইউনিভার্সিটিতে এসে আমার সব বন্ধুদের বন্ধু হয়ে গেল। খুব ভাব নিয়ে একটা হোন্ডা বাইক চালাত সে। আমি তাঁর প্রেমে, না তাঁর বাইকের প্রেমে পড়লাম আল্লাই জানেন কারণ, কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমি তাঁর বাইকের পেছনে বসে ভোঁ করে চলে যেতাম ঘুরতে।
তো সেদিনও কথা ছিল রিংকু আসবে আড্ডা দিতে আর এখন স্যার বলছে পরীক্ষা না দিয়ে বেরতে দেবে না ক্লাস থেকে। কি বিপদ! আমি পলি আর তারেক কে বললাম রিংকুকে বলতে সে যেন অপেক্ষা করে, আমি ঝটকায় পরীক্ষা দিয়ে চলে আসব, যেন কি ভীষণ মহা পণ্ডিত আমি। পরীক্ষা শুরু হল, আমি বিশ মিনিটে আগডুম বাগডুম লিখে স্যারের কাছে খাতা জমা দিতে গেলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে স্যার আমাদের বলেছিলেন, “নায়কোচিত চরিত্র – রাম না রাবণ?” এই নিয়ে লিখতে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বদ কাব্যে’ আমার কাছে রাবণকেই সব সময় নায়ক মনে হত আর রামকে মনে হত ভীতু, কাপুরুষ। আমি নির্দ্বিধায় আমার মতামত দেড় পৃষ্ঠায় লিখে খাতা জমা দিয়ে দিলাম। স্যার আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন “শেষ”? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালাম। স্যার বললেন- “একটু দাঁড়ান, যাবেন না” বলে খাতা পড়তে শুরু করলেন। আমার তখন কান লাল হয়ে যাচ্ছে কারণ মনে হচ্ছিল, সবার সামনে স্যার খাতা আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লিখতে বলবেন। আমি অধীর হয়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, দেখলাম পড়তে পড়তে স্যারের মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠল। চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সারাক্ষণ এত অস্থির না থেকে শান্ত হয়ে একটু পড়াশোনা করলেই ফার্স্টক্লাসটা জুটে যেত, এখন যান”, আমি মনে মনে ভাবলাম ফার্স্ট ক্লাসের লাইনে অলরেডি ৪ জন সিটি বাজাচ্ছে, আর ভিড় বাড়িয়ে কাজ নেই; আমি স্যারের সামনে থেকে নিমিষে উধাও।
ইউনিভার্সিটিতে আমি দু’টা গ্রæপে সমানে আড্ডা দিতাম। একটা ছিল; পলি, তারেক, রুনা,ইকবাল, বাবলু, আরিফ, ছায়াদের সাথে আর অন্যটা ছিল আতিকদের সাথে। একদম বিপরীত ধর্মী আড্ডা হত দু’গ্রুপে। পলিদের সাথে মিলে যত রকম দুষ্টুমি করা যায় করতাম। কথা নেই বার্তা নেই একদিন আমরা হামলা করলাম তারেককে, বললাম ওদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে যাব। ব্যাস পরেরদিন আমরা ৮জন মিলে টাঙ্গাইল চলে গেলাম। তারেকের মা আর বাবা যে আমাদের কি যত্ন করলেন সে বললে শেষ হবে না, আমরা দু’রাত ছিলাম ওদের বাড়ি। বিরাট একটা খাটে আমি, রুনা, পলি আর তারেকের মা শুয়েছিলাম। কত্ত যে গল্প করেছিলাম আর গল্প শুনেছিলাম খালাম্মার কাছ থেকে তার ইয়ত্তা নেই। খালাম্মার সাথে বসে বসে পিঠা বানিয়েছিলাম সারা সকাল, বিকেলে সবাই মিলে হেটে চলে গিয়েছিলাম লৌহজং নদী দেখতে। পরেরদিন সকালে উঠে হাটতে যাব বলে ছেলেদের ডাকতে যাচ্ছি পলি বলল, ‘শর্মী যাস না! আমি বললাম কেন? কত্ত ঘুমাবে ওরা, বলেই দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে গিয়ে এক বিকট চীৎকার দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। আমার অবস্থা দেখে পলি আর রুনা হেসে মাটিতে গড়াগড়ি” ছাগলগুলোর লুঙ্গি মাথায় উঠে ছিল।
সেলিম, আতিকদের সাথে হত সিনেমা, বই, নাটক, কবিতার আড্ডা। পাঠক সমাবেশের বিজুর বাসায় প্রায়ই বসত আমাদের সিনেমার আড্ডা। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়ের ছবি জোগাড় করে রাখত বিজু। মনে আছে একদিন ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা দেখছিলাম, সেখানে “আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়া” রবীন্দ্র সংগীতটির একটি দৃশ্যায়ন ছিল। আতিক ভি সি আর রিওয়াইন্ড করে কয়েকবার দেখেছিল গানটি। দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “একদিন এরকম সিনেমা বানাবো বুঝলি? আর তুই হবি নায়িকা”, আমার বন্ধু তাঁর কথা রেখেছে সে সিনেমা বানিয়েছে কিন্তু আমার আর নায়িকা হওয়া হয়নি। আমি যখন দেশ ছাড়ি আতিক তখনও পুনায়।
আতিক আর সঞ্চির মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। ওঁরা পছন্দ করত একজন আরেকজনকে আবার ভীষণ ঝগড়াও করত দুইজন। ওদের ঝগড়ার মধ্যে সে বিষয়টা আমাদের সব থেকে আনন্দ দিত সেটা হল, ‘আতিক বলত সঞ্চির প্রাপ্য ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবার আর সঞ্চি বলত ওটা আতিকের প্রাপ্য, আর আমরা বলতাম তোরা মর গিয়ে।’ আতিক বেশিরভাগ সময়ই হলে থাকত, বাসায় যেত খুব কম। একদিন হঠাৎ করে আতিক এসে আমায় বলল যে ওর একটা টুথব্রাশ চাই এবং সাথে পেস্ট। এমন আজব আবদার দেখে আমি একটু অবাক হলেও পরেরদিন ওর জন্য টুথপেস্ট আর ব্রাশ নিয়ে এলাম। আমরা সকালের ক্লাসের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে বকবক করছি এবং, যথারীতি ক্লাস শুরুর ৫ মিনিট আগে উড়াধুরা আতিক এসে আমাকে বলল, ‘কই আমার জিনিস দে’’, আমি ব্যাগ থেকে বের করে ওগুলো ওর হাতে দিতেই আতিক সেসব নিয়ে বাথরুমে দৌড়। হঠাৎ দেখলাম সঞ্চির মুখটা কাল হয়ে গেল। ও ক্লাসে না ঢুকে হনহন করে চলে গেল। আমাদের ডাকে ফিরেও তাকালো না। আমার মনটা খচখচ করতে থাকল।