শারমীন শরীফ : ইউনিভার্সিটিতে আমার একটা বান্ধবী ছিল, লিপি। খুব চুপচাপ ধরণের একটা মেয়ে। কথা কম বলত কিন্তু খুব বুদ্ধিদীপ্ত এবং রূপসী ছিল, যাকে বলে ‘বিউটি উইথ ব্রেইন’। অসাধারণ ভাল ছাত্রি ছিল সে, আমরা জানতাম ও ফার্স্ট ক্লাস পাবে। সিরাজ সালেকীন, লিপি কাদের, সঞ্চিতা আর নুরুল আলম আতিক এই চারজনের মধ্যে অদৃশ্য এক যুদ্ধ ছিল এই নিয়ে যে কে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে। লিপি রোকেয়া হলে থাকত। দুপুরের দিকে আমার ক্লাস শেষ হলে আমি ওর রুমে চলে যেতাম প্রায়শঃই। হলে খেয়ে নিয়ে ওর রুমে গিয়ে শুয়ে থাকতাম, অপেক্ষা কখন ৬টা বাজবে আর আমি ঢাকা পদাতিকের রিহার্সালে যাবো। জামিল আহমেদ স্যার তখন আমাদের বিষাদ-সিন্ধু ২ এর রিহার্সাল করাচ্ছেন।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম বাংলা বিভাগে। সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট বেঁছে নিলাম পল সাইন্স আর নাট্যকলা। নাট্যকলা বিভাগ সেই বছরেই প্রথম সাবসিডিয়ারি বিভাগ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মপ্রকাশ করল আর আমরাই হলাম তার প্রথম ব্যাচ। ন্যাট্যকলা বিভাগে যেয়ে জামিল আহমেদ স্যারের সাথে পরচিত হবার পরে আমাদের কাছে এই বিভাগই প্রধান হয়ে উঠল আর বাংলা হয়ে গেল সাবসিডিয়ারি। আমাদের ধ্যান-জ্ঞ্যান সব এখানেই ঘুরপাক খেত। নাট্যকলা বিভাগের মাধ্যমে আমার পরিচয় হল ঢাকা পদাতিকের সাথে। ঢাকা পদাতিকের বিষাদসিন্ধুর শোয়ের যে কোন প্রয়োজনে স্যার আমাদের ডাকতেন, যেমন ওদের প্রপস টানা থেকে আরো বিভিন্ন কাজ। বিষাদসিন্ধুর প্রথম শো আমরা দেখেছিলাম নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রি হিসেবে বিনা টিকিটে। মিজান ভাই (বিষাদসিন্ধুর স্টেজ ম্যানেজার ছিলেন তখন) আমাদের বললেন আমরা একদম পিছনে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পারব। ব্যাস আমি, সেলিম, মুনির, আতিক, শিমু, শরীফ, শিহাব আমরা কজন নির্দিধায় দাঁড়িয়ে গেলাম সেখানে। সেদিন নাটক দেখে বেড়িয়ে আমরা শুধু একটা কথাই আলোচনে করছিলাম; কি দেখলাম? কি ভেলকিবাজি বাজি দেখলাম। চোখের পলক ফেলতে পারিনি সেদিন। এরপরে আমরা আরো করেকবার তেমনি পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম এবং যতবার দেখেছি ততবার আশ্চর্য হয়েছি এই ভেবে যে কি করে স্যার এই ছোট্ট জায়গাটাকে কারবালার ময়দান বানিয়ে ফেললেন।
ওদের প্রয়োজনে আমরা যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি তেমনি আমাদের প্রয়োজনেও স্যার ঢাকা পদাতিকের সাহায্য চাইতে ভুলতেন না। কখন কোন সময়ে যেন ন্যাট্যকলা বিভাগ হয়ে উঠল আমাদের প্রিয় পরিবার আর স্যার আমাদের কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের ধ্যাণ-জ্ঞ্যান। একসময় স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন যে মঞ্চনাট্য জগতের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেবেন। যেই কথা সেই কাজ। স্যার আমাদের বললেন নাটক সৃষ্টি করতে। একদিন স্যার আমাদের বললেন রুমের একপাশে লাইন করে দাড়াতে, তারপরে বললেন চোখ বন্ধ করে নিজের মধ্য থেকে বেড়িয়ে অন্য একটা চরিত্রে ঢুকে যেতে। মেঝেতে একটা মোটা মাদুর পেতে নিতাম আমরা ক্লাসের সময় আর বেঞ্চগুলো সরে যেত পাশে, স্যার বললেন যে মাদুরটা হল আমাদের মঞ্চ। আমাদের কাজ হল চোখ খুলেই আমরা ওই মাদুর-বৃত্তে ঢুকে যাব অন্য একটি চরিত্র হয়ে। যা ইচ্ছে হয় তেমনি অভিনয় করব। সবাইকে একসাথে ঢুকতে হবে এমন কোন কথা নেই। যে যার সময় মত এন্ট্রি নিতে পাররে এবং এক চরিত্র অন্য চরিত্রের সাথ ইন্টারেক্ট করতে হবে এবং এভাবেই সৃষ্টি হবে গল্প। আমরা ঠিক সেভাবেই এক ঘন্টার একটা গল্প তৈরি করেছিলাম। দুষ্টুমি আর হাসাহাসি করতে করতে একটা নাটক তৈরি হয়ে গেল যেটা কিনা আমরা সবাই মিলে লিখেছিলাম আর অভিনয় করেছিলাম।
ঢাকা পদাতিক থেকে আমাদের সাহায্য করতে এল রিন্টু আর স্বপন। রিন্টু অভিনয় করল আমাদের সাথে আর স্বপন সাহায্য করল প্রপস বানাতে। এভাবে আমাদের পরিচয় হল ঢাকা পদাতিকের সাথে। আমাদের নাটক মঞ্চায়নের ঠিক এক সপ্তাহ আগে আমার মা চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আমি বরিশালে চলে গেলাম। মাকে দাফন করে ঠিক আমাদের মঞ্চায়নের দিন সকাল ১১টায় আমি মহিলা সমিতিতে এসে হাজির। সবাই অনেক ব্যাস্ত গোছানোতে। আমাকে দেখে সবাই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ যেন নিঃশ্বাসও নিচ্ছে না এমন অবস্থা। স্যার হঠাত সবার এমন পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে এদক ওদিক তাকাতেই আমাকে দেখতে পেলেন। আমি নিঃশব্দে স্যারের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে স্যারকে বললাম যে আমি আমার পার্ট করতে চাই। স্যার নিশ্চুপ সাথে সবাই বাক্যহারা। একসময় স্যার হাক দিয়ে বললেন, ‘সেলিম, সবাইকে ডাকুন। আর একটা run-through হবে’। একডাকে সবাই মঞ্চের উপরে। শুরু হল আমাদের ফাইনাল মহড়া। চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম স্যার দরজার আড়ালে তীক্ষ্ণ চোখে আমার কাজ দেখছেন, আমি নির্ভুল মহড়া দিলাম। মহড়া শেষ হলে দরজার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে বললেন, ‘সব ঠিক আছে, শর্মী নিজেই ওর ভূমিকায় কাজ করবে’। বলে চলে গেলেন। সাথে সাথে মুনির, সেলিম, শিমু, হাসি, শরীফ, শিহাব সবাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কয়েক মুহূর্ত মাত্র তারপরে সাথে সাথে আমরা নিঃশব্দে যে যার কাজে ফিরে গেলাম।
প্রায় দেড়শ/দুশ মানুষের সামনে আমরা সেদিন আমাদের প্রথম অভিনয় করলাম। নাটক শেষ, সবাই চলে গিয়েছে রয়ে গিয়েছি শুধু আমরা। আমি মঞ্চের মাঝখানে বসে পড়লাম, আর বাকিরা সবাই এসে গোল হয়ে আমার চারিদিকে বসে আমাকে জড়িয়ে থাকল। যখন আমি হাউমাউ করে কাঁদছি, ওরাও তখন কাঁদছিল আমার সাথে। স্যার এসে পাশে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে চুপচাপ দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। আমার কষ্ট সেদিন আমার বন্ধুরা সবাই ভাগ করে নিয়েছিল। কিছু কিছু স্মৃতি অমলিন হয়ে থেকে যায়, এটাও তেমন একটি স্মৃতি। আমাদের নাটক শেষে একদিন স্বপন এসে আমাকে জানাল যে মিজান ভাই আমাকে ডেকেছেন। আমি গেলাম। মিজান ভাই আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ঢাকা পদাতিকে যোগ দেবার জন্য। আমি একদিন সময় চেয়ে নিলাম। বন্ধুদের বলতে ওঁরা আমাকে ভীষণ ভাবে উত্সাহ দিল। সেলিম, মুনির আর আতিক ওঁরা তিনজন আমার আরেক স্বত্তা, আমার প্রাণ। ওদের সাথে ঝগড়ার যেমন কোন শেষ ছিল না তেমনি ওদের জন্য আমার ভালবাসারও কোন অন্তু ছিল না। অদ্ভুত একটা চতুর্ভূজ প্রেম আমাদের ঘিরে রাখত। কেউ কখন সীমা লঙ্ঘন করিনি বলেই আমরা এখনো টিকে আছি একসাথে। এই তিনটা মানুষের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই। আমার সুখে, দুঃখে ওঁরা আমাকে আগলে রেখেছে প্রতিটা মুহূর্ত, এখনো রাখে। কত বকা দেই অকারণে কিন্তু ওঁরা সেটা গায়েই মাখে না। ওঁরা বলল স্যারের সাথে কথা বলতে। আমি স্যারের কাছে গিয়ে বলতেই স্যার আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘নিজের যোগ্যতায় কাজ করবেন, আমার কাছ থেকে কোন আলাদা সুবিধা পাবেন না এবং আমাকে ভাঙিয়ে খাবেন না দয়া করে’। আমি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বেড়িয়ে এলাম।