শারমীন শরীফ : নিঃসঙ্গতা অনুভবের কি কোন নির্দিষ্ট বয়স আছে বা কোন সময় পরিসীমা আছে? আমার মনে হয় নেই। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই নিঃসঙ্গ, কেউ সেটা উপলব্ধি করে কেউ করে না। কেউ একাকীত্ব কে ঘৃণা করে আর কিছু মানুষ একাকীত্বের সময়টুকু কে অন্তরাত্মা দিয়ে উপভোগ করে, তবে এই দলের মানুষ খুব কম। এরা জানে নিজের সাথে সময় কাটানোর থেকে নির্ভেজাল আর কিছু হয় না। আমি এটা শিখে গিয়েছিলাম খুব অল্প বয়সে। আমার মাঝে একটা নিভৃত স্বত্তা আছে এবং সে সময় সময় নিভৃতচারী হতে চেয়েছে এবং এখনো চায় আবার সেই আমি মানুষের সঙ্গ পেতেও খুব ভালোবাসি। অনেক মানুষের মাঝে থেকেও আমি জানি কি করে একা হয়ে যেতে হয়। তবে প্রকৃতি আমার উপরে পরম প্রতিশোধ নিয়েছে। আমাকে নিঃসঙ্গতার বাগান বানিয়ে দিয়েছে, এখন চাইলেও আর সেখান থেকে বেরোতে পারি না। তাই পরম যত্নে নিজের বাগানকে সাজিয়ে নিয়েছি।
এইচএসসি শেষ হবার পরে আমি কোথায় পড়ব এই নিয়ে আবার শুরু হল হাঙ্গামা। বোনদের ইচ্ছে অনুযায়ী আমি ইডেন কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হলাম। ইডেন কলেজে আমার দম আটকে আসত। রুন, সীম, তুলতুল আমরা একদিন কলেজে দেখা করলাম, ওরাও চান্স না নিয়ে ইডেন কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়েছে। সবাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করতে যাচ্ছে সেদিন। ওরা জোর করে আমাকে দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাল। ভর্তি পরীক্ষার দিন আমরা আবার কলেজে একসাথ হয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম। মাথামুন্ডু কি পরীক্ষা দিলাম জানি না। মনের মাধুরী মিশিয়ে যাচ্ছে তাই লিখে বের হয়ে এলাম। অন্য বান্ধবীরা যখন পরীক্ষায় কি লিখেছে তাই নিয়ে অনেক চিন্তিত আমি তখন দু’পয়সা দিয়েও পাত্তা দিচ্ছিনা ব্যাপারটা কারণ আমি জানি যে চান্স পাব না আর পেলেও বোনরা পড়তে দেবে না।
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েই সেজদির দেবরের সাথে দেখা, পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। সে জানতে চাইল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি কিনা? বললাম দিয়েছি। বলল রোল নাম্বার দিয়ে যেতে, সে খোঁজ রাখবে। এই প্রথম বিষয়টা নিয়ে লজ্জা পেলাম। ভাবলাম আনিস ভাই যখন জানবেন যে আমি চান্স পাইনি তখন আমাকে গাধা ভাববেন নিশ্চয়ই। এড়িয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু হল না, পাশ থেকে রুন গটগট করে আমার নাম্বার দিয়ে দিল। ওখান থেকে সরে গিয়ে রুনকে ঝাড়লাম আচ্ছা মত।
যাই হোক, পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখব একটু। আমরা অপরাজেয় বাংলার সামনে থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। যতই দেখছিলাম ততই আমি মনে প্রাণে ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। এই প্রথম মনের কোণায় আকুলি বিকুলি শুরু হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার। তুলনা করছিলাম ইডেন কলেজের প্রাচীরবদ্ধ প্রাঙ্গণের সাথে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের অমিতের, কেতকী আর লাবণ্য। একটি হল ঘড়ায় তোলা জল আর অন্যটি হল দিঘি। এই প্রথম ভর্তি পরীক্ষাকে সিরিয়াসলি না নেবার জন্য নিজের উপরে রাগ হল ভীষণ। আমি আমার মন জানি তাই এও জানি যে ঘড়ায় তোলা জলে আমার পোষাবে না আমার দিঘি চাই। বিমর্ষতার চরমে পৌঁছে গেলাম।
রেজাল্ট হবার আগে বা ইডেনে ক্লাস শুরুর আগে মেজদা এল বরিশালে বেড়াতে নেবার জন্য। বরিশালে গিয়ে মনে হল আমি যেন মুক্ত বিহঙ্গ। বান্ধবীদের কাউকে তেমন খুঁজে পেলাম না। প্ল্যান ছিল বরিশালে কয়েকদিন থেকে আব্বা, মার কাছে চলে যাব। প্রথম দিন বিকেলে মেজদা ভাবীর সাথে বেড়াতে বের হলাম। যাবার পথে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে আমার চোখ তাকে খুঁজল কিন্তু সে কোথাও নেই। কোন এক অবসরে রুনুর কাছে জানতে চাইলাম মনির ভাই কেমন আছেন? রুনু জানালো যে তাকে তেমন আর দেখা যায়ন না কোথাও। মনে হয় ভাল আছে। খুব ইচ্ছে করছিল একবার তাকে দেখতে। গ্রামের বাড়িতে যাবার আগের দিন মেজদার সাথে বেড়িয়েছি কয়েকটা জিনিষ কিনব বলে, বাংলা বাজারের কাছে রিকশা মোর ঘুরতেই দেখলাম সে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো, আমিও চোখ সরাইনি। কয়েক পলক মাত্র কিন্তু এই কয়েক পলকেই কত স্মৃতি চোখের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। সে যাত্রায় আর তাকে দেখিনি। পরের দিন গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম।
আমাদের গ্রামের বাড়িটি ছবির মত করে সাজানো। বাড়ির পেছন দিকে পায়ে হাঁটার উচু রাস্তা তারপরে ধানক্ষেত এবং নদী। বাড়ির সামনে এবং পেছনে পুকুর। বাড়ির সামনের দিকে সরু পাকা রাস্তা, সেখানে রিকশা থেকে নেমে সরু পথ ভেতড় বাড়িতে যাবার জন্য আর দু’পাশে নারকেল, সুপারি গাছের সাড়ি। পাকা রাস্তার ওপারে শুরু ধানক্ষেতের যার কোন শেষ নেই। বাড়ির সীমানায় ঢোকার পথে একটা বিশাল বটগাছ, যার বয়স ২০০ বছরেরও বেশি, এই গাছের জ্বীন বিষয়ক অনেক গল্প রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে গেলে আমি প্রজাপতি হয়ে যেতাম। আমার বাবারা চার ভাই এবং দু’বোনের ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে আমরা মোট চুয়াল্লিশ জন ভাই-বোন এবং আমি সবার ছোট। চাচাতো ভাইবোনদের অনেক আদরের ছিলাম। তাই গ্রামের বাড়িতে গেলে উড়ে বেড়াতাম এবাড়ি ওবাড়ি। হঠাৎ করে আব্বা আমাকে দেখতে না পেলে বাবুলকে বলত আমাকে খুঁজে আনবার জন্য আর বাবুলও সেই আমার ছোটবেলার মত ‘ও ফুফু, ও ফুফু’ বলে চীৎকার করতে করতে পেছনের রাস্তা দিয়ে হাঁটত আর আমিও কোন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ওকে চমকে দিয়ে বলতাম, ‘কী রে চেচাচ্চিস কেন’, বাবুল বলত, ‘দাদু বোলায়, তত্তরি লন’। হায়রে আমার শিশুকাল আর ফুরোয় না। ওই সব মুহুর্তে আমি যেন ঝট করে ছেলেবেলায় চলে যেতাম, চোখের কোনাটা তখন জ্বালা করত কেন যেন! বাড়ি ফিরে গেলেই আব্বা বলতেন, ‘কই থাকিস মনা? দেখি না কেন তোকে’? আমি বলতাম ‘এই তো আমি আব্বা’, বলে গলা ধরে ঝুলে পড়তাম। আব্বা হেসে বলতেন, ‘আমার কি আগের মত শক্তি আছে? তুই লম্বা হয়েছিস না? তুইও পড়বি আমিও পড়ব।’
হঠাৎ শুরু হল আমার পান খাওয়ার কাহিনী। মায়ের পানের বাটা থেকে আচ্ছা করে চুন, সুপাড়ি জর্দা দিয়ে পান খেয়ে শুধু পানের পিক ফেলতাম আর মা চিল্লাতো কারণ পানের পিকে চারিদিক লাল, মা সারাক্ষণের জন্য লোক লাগিয়ে রাখল আমার পানের পিক মুছবার জন্য। গ্রামে গেলে আমার দুই চাচাতো ভাইয়ের বাড়ি আর এক বোনের বাড়ি আমার সব থেকে প্রিয় ছিল। বাদশা দাদা, নজ্রæল দাদু আর সেতারা বুবুর বাড়ি। বাদশা দাদার অপূর্ব রুপসী মেয়ে কলি ফুফুর চেলা ছিলাম আমি, ফুফু যাই বলত আমার কাছে তাই ধ্রæব সত্য ছিল। নজ্রæল দাদুর তিন ছেলে মেয়ে, স্বাধীন, সুমু আর ঝুমু। স্বাধীন আমার থেকে একটু ছোট ছিল, আমার আর ওর মধ্যে অবিরত ঝগড়া হত সুলেখা কালি আর মার্বেল নিয়ে, আমার মা আর ভাবী হিমসিম খেত আমাদের ঝগড়া মেটাতে, সুমু ছোট ছিল বলে পাত্তা পেত না আর ঝুমু তো একেবারেই গ্যাদা ছিল। সেতারা বুবুর বড় মেয়ে আমার আদরের নাসিমা খালা ডাকসাইটে সুন্দরী আমাকে ভীষণ আদর করত, গ্রামের রাস্তা থেকে কাঁদা মাখা আমাকে ধরে এনে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে গোসল করিয়ে তারপরে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিত আর নাসিমা খালার ছোট বোন রুনা আমার থেকে একটু ছোট, রুনা ছিল আমার সব শয়তানির সঙ্গী। আমি আর রুনা কত যে দুষ্টুমি করেছি একসাথে তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমার ছেলেবেলার সব মধুর স্মৃতির জন্য আমি এই মানুষগুলোর কাছে চীরকৃতজ্ঞ।
মা-আব্বার গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়াটায় আমি যতটা খুশি হিয়েছিলাম আর ঠিক ততটাই অখুশি ছিলেন আমার মা। ওই এরিয়াতে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি যায়নি। স্বন্ধ্যার ঠিক আগখানে রেখার মা শুরু করত হ্যারিকেনের কাঁচ পরিষ্কার করা। ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে সারি দিয়ে সাজিয়ে রাখত। স্বন্ধ্যা লেগে এলেই হ্যারিকেন জ্বেলে ঘরে ঘরে দিয়ে দিত। ছোট বেলায় এই আঁধারে ভয় পেতাম কিন্তু বড় বেলায় এই হ্যারিকেনের আলোয় কেমন ঘোর লেগে যেত আমার, গ্রামে স্বন্ধ্যা লাগতেই চারিদিকে কেমন সুনসান নিরবতা সেই সাথে হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় গায়ে কেমন কাঁটা দিত। সব কিছু কেমন রহস্যময় লাগত আমার কাছে, কিসের এক ভাললাগায় ভরে উঠত মন। ঘরের দেয়ালে নিজের ছায়া দেখেও আনন্দ পেতাম। আমার রুম ছিল দোতলায়, বৃষ্টির রাতে টিনের ছাঁদে যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ত তখন আমি কাঠের বারান্দায় গিয়ে ঘন্টা ধরে আসন পেতে ঝিম ধরে বসে থাকতাম আর আষাঢ?ের বৃষ্টি দেখতাম। টিনের ছাঁদে বৃষ্টির একটা আলাদা আমেজ রয়েছে। আর চাঁদনী রাতে বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা, আহা! মায়ের ক্ষেত্রে এর ঠিক উল্টো। স্বন্ধ্যা হলেই মায়ের মেজাজ খারাপ হত কারণ আলো নেই, টিভি নেই। (চলবে)