শারমীন শরীফ : প্রীতি আর আমার বন্ধুত্ব খুব জমে উঠল কিন্তু মজার ব্যাপার ছিল যে কলেজে গিয়ে আমরা দুজন দুদিকে চলে যেতাম কারণ আমাদের বন্ধু সার্কেল ভিন্ন ছিল। কলেজ শেষে আমরা আবার গেটের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এক হয়ে বাড়ির পথ ধরতাম। প্রথম যেদিন প্রীতি অসুস্ততার জন্য কলেজে গেল না সেদিন আমাকে একা যেতে হয়েছিল। একটু নার্ভাস লাগছিল কিন্তু বাসে উঠে বসার সাথে সাথে সেটা কেটে গিয়েছিল। সবাই যখন বাসে উঠে জানলার ধারে সিট নিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে আমি তখন এমন একটা জায়গায় বসতাম যেখান থেকে মানুষ দেখা যায়, দেখতে দেখতে ভাবতাম, এদের সবার গল্প যদি আমি জানতে পারতাম। আজমপুর প্রথম স্টপ ছিল বলে সিট পেতে কোনদিন সমস্যা হয়নি কিন্তু ফেরার পথে ফার্মগেট থেকে বেশ খানিকটা পথ দাঁড়িয়ে আসতে হত, তারপরে বসার জায়গা পেতাম। সেদিনও আমি একা কারণ প্রীতি কলেজে আসেনি। ফার্মগেটে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে ১০ টাকার নোট দিলাম কিন্তু তার কাছে ভাংতি নেই। এই ভাংতি করতে গিয়ে দৌড়েও উত্তরার বাসটা ধরতে পারলাম না এবং ভীষণ মেজাজ খারাপ হল। প্রায় ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরে উত্তরা রুটের দোতলা বি আর টি সি বাস এলো, আমি খুশি হয়ে দৌড়ে দোতলায় উঠে জানলার ধারে একটা সিট নিয়ে বসলাম। উত্তরা রুটে বি আর টি সি বাসের সংখ্যা কম ছিল বলে অনেক সময়ের ব্যাবধানে এই বাসগুলো চলত। যাই হোক আমি বাস মিস করে খুব রেগে থাকলেও এবারে খুশি হয়ে গেলাম। কিন্তু সমস্যা ছিল যে, এই বাস শুধু এয়ারপোর্টের গোল চক্কর পর্যন্ত যেত তাই সেখানে নেমে হয় আরেকটা বাস অথবা রিকশা নিয়ে বাসায় যেতে হত। এয়ারপোর্ট থেকে আজমপুর খুবই কাছে তাই এই নিয়ে কোন বিকার হল না।
সেদিন আমাদের বি আর টি সি গোলচক্করের একটু দূরে এসে জ্যামে পড়ল। ধীরে ধীরে বাস আগাচ্ছে আর আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে এই ভেবে যে আজকে দিনটাই খারাপ। তখন জ্যাম বলে কিছু ছিল না। দোতলায় বসে দেখতে পেলাম গোলচক্করের কাছে অনেক মানুষের ভিড়। আমি নিচতলায় নেমে বাসের কন্ডাক্টর মামুর কাছে জানতে চাইলাম কি হয়েছে, মামু জানাল যে উত্তরা রুটের একটা বাস একসিডেন্ট করেছে, উল্টোদিক থেকে একটা বাস গোলচক্করের ভুল দিকে এসে পড়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে এবং দু’টো বাসেরই সামনের অংশ ভেঙ্গে ভর্তা হয়ে গিয়েছে। মহিলাদের বসার জায়গায় যারা বসেছিল তারা সবাই স্পট ডেড। আমরা তখন ঘটনার খুব কাছে এসে পড়েছি। এক্সিডেন্ট দেখবার জন্য সবাই হুড়মুড় করে বাসের দোতলায় উঠে গেলাম। সবাই যখন ঘটনা দেখার জন্য ব্যাস্ত আমি তখন যেন আমার সেই ১৭ বছরের স্বল্প জীবনের স্লাইড শো দেখতে পাচ্ছিলাম কারণ দুটো বাসের একটা ছিল সেই বাসটা যেটা আমি মিস করেছিলাম। ১০ টাকা ভাংত্রি জন্য আমি এখনো বেঁচে আছি না হলে এতক্ষণে আমি ওপারের দরজায় কড়া নাড়তাম। সেই তখন থেকে আমার বিশ্বাস, ‘আমাদের যখন যেখানে থাকবার কথা আমরা ঠিক সেখানেই আছি, ভাল থাকব না খারাপ থাকব সেটা পুরোটাই আমাদের ইচ্ছের উপরে নির্ভর করে কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমাদের আয়ত্তে¡র বাইরে বা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই সেটা বুঝে গেলাম’… সেই থেকে আমি আমার স্থান এবং অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ এবং আপসোস করা ছেড়ে দিলাম এবং চেস্টা করতাম নিজের এবং আশেপাশের সবার অবস্থানটাকে শান্তিময় করে তুলতে। হয়ত সবসময় সেটা সম্ভব হত না বা এখনো হয় না। আমাদের ঘিরে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে আমাদের অজান্তেই।
অন্যদের ভাল রাখতে গেলে নিজের ভাল লাগাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়, সেটা করার মত বয়স, বুদ্ধি বা শক্তি কোনটাই আমার ছিল না তখন কিন্তু আমার ভেতরে গভীর একটা মনের সৃষ্টি হল, আমি যে কোন ঘটনার অনেকগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম, নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। বাইরে থেকে দেখা গেল না কিন্তু এই এক্সিডেন্ট আমার জীবনে নিরবে একটি বড় রেখাপাত করে গেল। আমি এমনিতেই কথা কম বলতাম এরপরে আরো চুপচাপ হয়ে গেলাম। মেজদির আরেকটা ছেলে হল, একটা পতুলের মত বাচ্চা আমার সময়টা অনেক ভরে রাখত, কলেজ থেকে ফিরে ওকে নিয়ে অনেক ব্যাস্ত হয়ে যেতাম।
কলেজে আমাদের এক বান্ধবী ছিল লিজা নামে। ভীষণ স্মার্ট একটা মেয়ে, পোশাকে, চলনে, কথনে, সাজগোজে, সবদিকে মহা স্মার্ট একটা মেয়ে। ওকে দেখে আমি ভাবতাম এত স্মার্ট কখনোই হওয়া হবে না। সেই লিজা সেকেন্ড ইয়ারে উঠে পালিয়ে গুন্ডা ধরণের একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলল। আমরা জানতাম লিজা প্রেম করে কিন্তু এভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলবে সেটা বুঝিনি। বাড়িতে সে কিছুই জানাল না। এই খবর শুধু দু’পক্ষের বন্ধুমহলে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন সিদ্ধান্ত হল এবং সময়ে যে যার বাড়িতে জানাবে। লিজা ছিল ভীষণ স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা একটা মেয়ে আর ওর বর ‘ডাবলু’ (ওই নামেই ডাকত সবাই) ছিল ঠিক তার উল্টো। আমরা মানে আমি, রুন, তুলতুল আর সীম এটা নিয়ে প্রায়ই আলাপ করতাম আর ভাবতাম যখন বাড়িতে সবাই জানবে তখন কি হবে লিজার অবস্থা। যাই হোক অত গভীরে যাবার মত বয়স তখন ছিল না তাই বিয়ের ১ সপ্তাহ পরে লিজা যখন কলেজে এল আমরা বান্ধবীরা ওকে মৌমাছির মত ছেঁকে ধরেছিলাম গল্প শোনার জন্য।
লিজা জানাল যে সে বাড়িতে বলেছে বন্ধুদের সাথে কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছে, লিজা বিয়ে করে সত্যি সত্যি কক্সবাজার গিয়েছিল তবে সেটা শুধু ডাবলু আর ওর বন্ধুদের সাথে। কলেজের সবুজ মাঠে লিজা তখন গল্পের মধ্যমনি ‘রাজকন্যা’ আর আমরা ওর চারিদিকে গোল হয়ে বসে রূপকথার গল্প শুনছি। লিজার গল্পগুলো নিঃসন্দেহে একেক জনের মনে একেকরকম রেখাপাত করেছিল, কারণ এই ঘটনার পরেই আরো কিছু বান্ধবি হুট করে বিয়ে করে ফেলল এবং আমার বান্ধবী রুনও সিদ্ধান্ত নিল সেও বিয়ে করে ফেলবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। রুনের চালচলন ছিল ছেলেদের মত তাই ও যখন প্রেম, বিয়ের কথা বলত আমি ঠিক যেন ওকে মেলাতে পারতাম না। আমরা ওকে বাঁধা দিলাম এবং বললাম কিছু করার আগে বাড়িতে জানাতে। রুন বাড়িতে এই ঘোষণা দেবার পরে তুলকালাম কান্ড শুরু হল। রুনের বাবা জানাল যে সু-ভাই যদি আগারগাও তালতলার ত্রিসিমানায় আসে তাহলে তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে। রুনকে বাড়িতে আটকে দিলেন চাচা আর দুদিন কলেজ মিস করাতে আমরা ওকে খুঁজতে গিয়ে এই কাহিনী আবিষ্কার করলাম। আমরা সু-ভাইকে যথারীতি কলেজের গেটে পেলাম এবং এই কথা তাকে সবিস্তারে জানিয়ে বললাম যে উনি যেন আগারগাও না যান কিছুদিন এবং রুনের সাথে যোগাযোগ না করেন। সু-ভাই মানলেন না এবং রুনের সাথে দেখা করতে গিয়ে এলাকার ছেলেদের হাতে বিপুল পিটুনি খেলেন। ঘটনা জটিল হয়ে গেল। সু-ভাইকে মার দেবার জন্য রুন ক্ষেপে গেল। এক সপ্তাহ পরে চাচা রুন কে আবার কলেজে আসতে দিলেন এবং আমাদেরও না জানিয়ে রুন লুকিয়ে গিয়ে সু-ভাইকে বিয়ে করে ফেলল।
আমাদের মধ্যা সীম ছিল সবথেকে গো-বেচারা। সবকিছুতেই তার ভয়। একা একা রিকিশায় উঠতেও তার ভয়। রুনের এসব লোমহর্ষক কাহিনী শুনে ভয়ে সে একদিন অজ্ঞান হয়ে গেল কলেজে। তুলতুল আর আমি এই দুজনকে সামাল দিতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি যখন, তখন আমাদের বান্ধবীমহলে লাভ-রোমান্সের মহামারি চলছে। আমাদের ৪ জনের মধ্যে আমি ছিলাম বরিশ্যাইল্যা আলেকান্দার বীরবিক্রম। কিছুই ভয় পেতাম না, বান্ধবী মহলে মহা সাহসী এক বালিকা, যে কোন সমস্যা সমাধানে আমি কিন্তু বাসায় গেলেই বিড়াল। মুখ বন্ধ করে একদম ‘স্পিকটি নট’। বাড়িতে আমার মুক্তি ছিল বইয়ের জগতে। উত্তরাতে ৪ নং সেক্টরে ‘ভিডিও কানেকশন’ নামে দারুণ একটি দোকান হল, ওরা ১০ টাকায় ভিডিও রেন্টে দিত। ওখানের মেম্বার হয়ে গেলাম। প্রায়ই সন্ধ্যায় ওখান থেকে সিনেমা এনে দেখতাম। মেজ দুলাভাই খানিকটা আতেল টাইপের মানুষ, উনি ভাল ভাল ইংলিশ সিনেমা আনতেন, সেই থেকে আমার মধ্যে ভাল ছবি দেখার একটা রুচি তৈরি হয়েছিল। (চলবে)