Home কলাম নানান রঙের দিনগুলি-১৩

নানান রঙের দিনগুলি-১৩

শারমীন শরীফ : আমি ধীরে ধীরে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যেতে লাগলাম। আব্বার জন্য খুব মন কেমন করত, মাঝে মাঝে মনে হত সব ফেলে আব্বার কাছে চলে যাই কিন্তু তখন নতুন জায়গা, নতুন জীবন, নতুন বন্ধুদের মায়াজালে জড়িয়ে গিয়েছি। আর ফিরে যেতামই বা কোথায়। আব্বা নিজেই তো আর বরিশালে নেই। মেজদা ভাবিকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যেত কিছুদিন, সেটাই ছিল আমার একমাত্র আনন্দ। বড় আপার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি কারণ আমার জন্মের আগেই বড় আপার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমার যখন দেড় বছর বয়স তখন আপার বড় মেয়ে ভুমিষ্ঠ হয়। আপা আমাকে কাছেই পায়নি। আব্বা বলত আপা বরিশালে বেড়াতে এসে মা কে মা বলে ডাকলে আমি খুব অবাক হয়ে আপাকে জিজ্ঞেস করতাম যে সে আমার মা কে মা ডাকছে কেন? আপার সাথে এই দূরত্ব কাটিয়ে ওঠা এই জীবনে সম্ভব হয়নি, সারা জীবন দূরের কেউ হয়ে রয়ে গেলেন, আমার ভাই বোনদের মধ্যে একমাত্র আপাকেই আমি আপনি বলে সম্বোধন করি কিন্তু মেজদি আমাকে অনেকটা সময় পেয়েছে, অনেক আদরের অনেক কাছের মেজদি।

মেজদির যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স সাত কি আট। মেজদির শ্বশুড় বাড়ি ফরিদপুরে, ওকে যেদিন তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেদিন কি কারণে মা আমাকে ওর সঙ্গে গছিয়ে দিল। কি একটা রীতি ছিল তখন যে নতুন বৌএর সাথে কাউকে যেতে হবে। আমরা গাড়িতে করে গিয়ে পৌঁছুলাম ফরিদপুরের ভাংগা গ্রামে, বর্ষাকাল তখন। চারিদিকে পানি, কাঁদা আর কাঁদা। একটা জায়গার পরে গাড়ি আর যাবে না। মেজদির জন্য পালকি এল। মেজদি পালকিতে ওঠার পরে দুলাভাই সুড়সুড় করে পালকিতে উঠে গেলেন আর আমি জুতা হাতে নিয়ে বাকি লোকজনদের সাথে কাঁদা মাড়িয়ে হেঁটে ওদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছুলাম। বাড়ি গিয়ে সবাই বৌ বরনের জন্য ব্যাস্ত হয়ে গেল, আমার কথা কারো মনে রইলো না। একসময় সবাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গিয়েছে আর এদিকে আমি উঠানে সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে এক হাতে ফ্রক আর অন্য হাতে জুতা, পায়ে কাঁদা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছি। একটু ধাতস্ব হবার পরে মেজদির খেয়াল হয়েছিল যে আমাকে দেখছে না, সে দুলাভাইয়ের কানে কানে বলল আমার কথা, তখন আমার খোঁজ শুরু হয়েছিল।

দুলাভাইয়ের ছোট বোন রুবি আপা এসে আমাকে আবিস্কার করল। তখন আমাকে পুকুর ঘাটে নিয়ে ঘসে ঘসে কাঁদা ছাড়িয়ে পা ধুইয়ে ঘরে নিয়ে গেল। সেদিন রাতে আমাকে রুবি আপার সাথে ঘুমাতে দেয়া হয়েছিল, আমি সারারাত ঘুমাইনি আর রুবি আপাকেও ঘুমাতে দেইনি, কিছুক্ষণ পর পর মেজদির কাছে যাব বলে কেঁদেছিলাম। ওটা আমার জীবনের একটা জঘন্য রাত ছিল। পরের দিন সবাই আমাকে এত আদর করেছিল যে আমি পূর্বদিনের কর্দমাক্ত কাহিনী ভুলে গিয়েছিলাম। পরে মেজদি আমার কানে কানে বলেছিল এই ঘটনা আমি যেন আব্বাকে না বলি কিন্তু আমার সারাজীবনের অভ্যাস যেটা বারণ সেটা আরো বেশি করে করতে হবে অতএব পরেরদিন সবাই যখন বৌভাত খেতে এল আমি দৌড়ে গিয়ে আব্বার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং কোলে উঠে প্রথমেই কানে কানে পুরো কাহিনী চিত্র সহকারে বর্ণনা করেছিলাম। এই নিয়ে পরে মেজদির অনেক বকা খেয়েছি কিন্তু বড় হয়ে দুলাভাইকে আমাকে রেখে পালকিতে উঠে যাবার জন্য অনেক পচিয়েছি।

মেজদির বিয়ের আগেই দিদি এ্যমেরিকাতে চলে গিয়েছিল ওর বরের কাছে। বোনদের মধ্যে সবথেকে বেশি সময় আমি কাটিয়েছি মেজদির সাথে আর তাই ওর সাথে আমার একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ওর বিয়ের পরে ওদের দুজনারই হলি ফ্যামিলি হসপিটালে চাকরি হয়ে যায় এবং ওরা হলি ফ্যামিলির কোয়ার্টারে উঠে যায়। আমার ছেলে বেলার অনেকটা সময় কেটেছে ওই কোয়ার্টারে। বিয়ের ২ বছরের মাথায় ওরা দুজন চাকরি নিয়ে ইরানে চলে যায়। মেজদি ইরান থেকে ফিরে এসে গ্রিনরোডে বাসা নিল এবং দুজনেই পিজি হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে যোগদান করল আর তখনই আমার ঢাকায় আবির্ভাব। জানিনা কখন কিভাবে মেজদির সাথে আমার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। ছেলেবেলার সেই সুরে যেন আর বাজত না। আমি দেখলাম আমার বোনরা আমার বন্ধুর চেয়ে শাষনকর্তার ভূমিকায় বেশী অবতীর্ণ হল। মা, আব্বা কাছে নেই, বোনরাই আমার সবকিছু তখন। যখন এদেরকে আমার বন্ধুর মত করে প্রয়োজন ছিল তখন তারা শাষণ করতে করতে আমাকে অনেক দুরে ঠেলে দিল। আমি সবার মাঝে থেকেও নিঃসংগ হয়ে গেলাম। কি এক কষ্ট বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াতাম। এক সময় আমার ধারণা হল যে আমি খুব খারাপ একজন মানুষ।

মেজদির বাসার উল্টো দিকে একটা ফিরিঙ্গি পরিবার থাকত। স্বামি, স্ত্রী আর ২টা বাচ্চা। লোকটা প্রায় সারাদিন ধরেই বারান্দায় বসে মদ গিলত আর বৌয়ের সাথে চীৎকার করে ঝগড়া করত। আমি ভীষণ কৌতুহল ছিল ওদের নিয়ে তাই আমি প্রায়ই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ওই বাসার দিকে। মেজদি এটাকে ব্যাখ্যা করল যে আমি ওই লোকের সাথে প্রেম করছি। অনেক বকাবকি করল একদিন, বলল আর যেন বারান্দায় না যাই। একদিন স্বন্ধ্যা বেলা আমি আমার পাথর আর হরতকি নিয়ে বসেছি যে ঘসে মুখে লাগাব। মেজদি তার ঘর থেকে বেড়িয়েই সেটা দেখতে পেয়ে পাথর আর হরতকি আমার হাত থেকে নিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল। সেদিন আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল তখনি বরিশাল চলে যাই। ওইদিনের পরে আর কখন রুপচর্চা করিনি। একেকবার মনে হত আব্বাকে সব বলে দেই বলতে পারিনি কারণ আব্বার অনেক অনেক ভরসা ছিল মেজদির উপরে, আব্বার বুকটা ভেঙ্গে যেত।

এর কিছুদিন পরে মেজদি উত্তরা ৭ নং সেক্টরে বাসা নিয়ে চলে গেল। আজমপুর বাস স্ট্যান্ডের ঠিক পাশেই একটা পাচতলা বিল্ডিংএর পাঁচ তলায় হল আমাদের নতুন আস্তানা আর একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ওরা হাসপাতাল বানালো। ঠিক উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে থাকত নায়ক জাফর ইকবাল ও তার পরিবার। ওদের বাড়ির ছাদে একটা সুইমিংপুল ছিল। কাজ ছাড়া দিনের অধীকাংশ সময়ে জাফর ইকবাল সুইমিং পুলের পাশে বসে গিটার বাজিয়ে গান করত, মাঝে মাঝে বউ বাচ্চারা পুলে ঝাপাঝাপি করত। সেটা একটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় দৃশ্য ছিল দেখার জন্য কিন্তু আমি ভুলেও ওদিকে তাকাতাম না মেজদির ভয়ে। মনে হত কবে আবার বলবে আমি জাফর ইকবালের সাথে প্রেম করছি, সেটা অবশ্য খারাপ কিছু হত না। কলেজের সময়টুকু আনন্দে আমার মন ভরে থাকত বাসায় ফেরার সময় এলেই একটা আতংক এসে ভর করত মনে। মেজদির সাথে আমার ভয়ের সম্পর্ক তৈরি হিয়ে গেল।
আমার নতুন সমস্যা তৈরি হল যে আমি উত্তরা থেকে আজিমপুর অতদূরে কলেজ করতে যাব কি করে। আব্বা চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন। একবার বলে ফেললেন বরিশাল চলে যাবার জন্য কিন্তু মেজদি সমস্যার সমাধান করে দিল। ওদের বিজনেস পার্টনারের শ্যালিকা প্রীতিও ইডেন কলেজে পড়ত এবং পাবলিক বাসে করে একা একা আসা যাওয়া করত। ওর সঙ্গে আমাকে জুটিয়ে দিল। খুব অল্প সময়ে আমি আর প্রিতী খুব বন্ধু হয়ে গেলাম। আমরা হেটে একসাথে আজমপুর বাস স্টপে গিয়ে বাসে উঠতাম সেখান থেকে ফার্মগেট তারপরে রিকশা করে কলেজে। আব্বার মনপুত হলনা বিষয়টা কিন্তু মেজদি আব্বাকে বুঝালো যে ব্যাপারটা খুবই নিরাপদ। তখন অবশ্য নিরাপদই ছিল। বাসে উঠে আমারা লেডিস সিটে গিয়ে বসতাম, পাবলিক বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা হল আমার, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম কত রং বেরঙের মানুষ উঠে নামে। কোথায় এদের গন্তুব্য, সবারই নিশ্চয়ই একটা গল্প আছে। এতটা দূরত্ব আমি খুব এনজয় করতে শুরু করলাম, মানুষ দেখা আমার নেশায় পরিণত হল। (চলবে)

Exit mobile version