Home কলাম নানান রঙের দিনগুলি-১২

নানান রঙের দিনগুলি-১২

শারমীন শরীফ : আমার ঢাকার জীবন শুরু হল। কিছুদিন ঘুরেফিরে খেয়েদেয়ে কেটে গেল। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে আমার বড় এবং মেজ বোনের আমার প্রতি ভরসা নেই। মনির ভাইয়ের কাহিনী ওদের উপরে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছিল, আমি ওদের কথায় আচরণে টের পেতাম সেটা। প্রেম না করেই আজব এক দোষে দোষী হয়ে গেলাম। এর মধ্যে এস এস সির রেজাল্ট এল, ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি, আর পনেরো নাম্বার হলেই প্রথম বিভাগ হত কিন্ত আবার ইংলিশে লেটার পেয়েছি (সব কৃতিত্ব ছিল ইংরেজী শিক্ষক, হেড স্যারের), কিন্তু হয়নি। বোনদের নিরাশা দেখলাম, ঠোট উলটে বলতে শুনলাম যে এই রেজাল্ট দিয়ে কোথাও ভর্তি হওয়া যাবে না। বুঝে গেলাম যে আমি একটা টোটাল ডিসএপয়েন্টমেন্ট।

যাই হোক ওঁরা আব্বাকে কিছু বলতে সাহস পেল না এবং আব্বাও এসবের ধার না ধেরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি এর থেকে ভাল রেজাল্ট আশা করেছিলাম কিনা, আমি বললাম ‘না’। আব্বা বড় আপাকে জিজ্ঞেস করলেন কোন কলেজে আমাকে ভর্তি করা যায়, অগত্যার গতি ইডেন কলেজ। কলেজটা ছিল আপার বাসার ঠিক সামনে কিন্তু আমি থাকতাম মেজদির বাসায়। আপার তিন মেয়ে নিয়ে আপার নিজেই অস্থির আর তা ছাড়া আপার বাসায় বরিশালের ডাক্তার, মোক্তারের মেহমান লেগেই থাকত। মেজদির বাসা নির্ঝঞ্ঝাট, একটা ছেলে আর বোন জামাই। দুজনেই ডাক্তার তাই ওরা বাসায়ই থাকে না বেশির ভাগ সময়। আমি সকালে বোনের ছেলেকে স্কুলে (ইউ ল্যাব) দিয়ে কলেজে চলে যেতাম আর ফেরার পথে ওকে স্কুল থেকে তুলে বাসায় ফিরতাম। মেজদির বাসা তখন গ্রীন রোডে।

কলেজে প্রথমদিন, মন অনেক খারাপ। পুরনো কোন বান্ধবীরা নেই, একা অসহায় লাগছিল। উচ্ছ¡াসে ভর্তি, কথায় কথায় খিলখিল করে হাসে এমন একটি মেয়ে আমার পাশে বসল। ওর সাথে কথা বলে এত ভাল লাগল যে আমি আর রুন সাথে সাথে বন্ধু হয়ে গেলাম। ক্লাসের ফাঁকে পরিচয় হল, সীম আর তুলতুলের সাথে। আমরা চারজন কি করে যেন চার রত্ন হয়ে গেলাম। ব্যাস মন খারাপের দিন শেষ। নতুন বন্ধুদের নিয়ে শুরু হল নতুন জীবন। পুরোনো বন্ধুদের জন্য মন খারাপ ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করল। থেকে থেকে রতুর জন্য, নার্গিসের জন্য মন খারাপ করত কিন্তু সেও হারিয়ে যেতে শুরু করল।

রুন খুব ভাল ব্যাডমিন্টন খেলত। আমিও ভাল খেলতাম, আমরা দুজন ডুয়েট চ্যাম্পিয়নশিপে নাম লিখিয়ে ফেললাম। খুব ধুমসে আমাদের প্র্যাক্টিস শুরু হল। ক্লাসের ফাঁকে পুরোটা সময় যেত ব্যাডমিন্টনের পেছনে। সিম আর তুলতুল এই সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের উত্সাহ দিত আর নতুন বন্ধু বানাতে ব্যাস্ত থাকত, ওরা আজিমপুরের পুরনো বাসিন্দা বলে এমনিতেই ওদের অনেক পরিচিত মুখ ছিল কলেজে। আরো কিছু নতুন বান্ধবী জুটল আমাদের দলে। নিতু আর লাভলি নামে আমার দু’টো নতুন বন্ধু হল কিন্তু ওঁরা রুনদের বন্ধু হল না কোন এক কারণে। তাই ওদের সাথে আড্ডা দেবার জন্য আমি মাঝে মাঝে দল ছাড়া হয়ে যেতাম।
ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য আমাকে নতুন ভাল দেখে একটা ব্যাট কিনতে হয়েছিল। রুন আর আমি নিউমার্কেটে গিয়ে কিনেছিলাম। বলাকা সিনেমা হলের উল্টোদিকে নিউমার্কেটে ঢোকার যে গেটটা ছিল সেটার ঠিক মুখেই ডানদিকে কর্ণারে একটা কফির দোকান হল কফি কর্নার নাম দিয়ে, আমি আর রুন সেখানের কফি খেয়ে ফিদা। মনে আছে বড় একটা মগে কফি দিত উপরে ফেনায় ভরা থাকত। কাপ প্রতি দাম ছিল ১০ টাকা। শুধু কফি খাবার জন্যই যেতাম মাঝে মাঝে আর অকারণে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে আমি বইএর দোকানগুলোর প্রেমে পড়লাম। বইয়ের নেশা আমার ধমনীতে। কখনো খালি হাতে ফিরতাম না, কফি খেয়ে একটা বই কিনে তবে বাড়ি ফিরতাম।

যাই হোক ব্যাডমিন্টন প্র্যাক্টিসের জন্য রোজ সেটা হাতে করে নিয়ে কলেজে যেতাম, কিন্তু সেটা আমার মেজদির মনপুত নয়। সে আমাকে সাফ জানিয়ে দিল যে এটা আমার ঢং, আমি ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এটা করছি, অতএব এটা করা যাবে না। বড় আপা মেজদিকে সমর্থন করলেন। আমি মেনে নিলাম। সেদিন ক্লাস শেষে আমি আমার ব্যাটটা রুনকে দিয়ে বাসার সমস্যা বুঝিয়ে বললাম, ও দায়িত্ব নিল সেটা আনা, নেয়া করার। কলেজ বার্ষিকী ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা দু’জন রানার্সআপ হলাম কিন্তু সে আনন্দ আমি বাসায় শেয়ার করলাম না কারণ বোনদের কারো এই নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। আমরা বান্ধবীরা সবাই মিলে অনেক হৈ চৈ করে চটপটি, ফুচকা খেলাম। সিমের বাসা চায়না বিল্ডিংএর পাশে ছিল। ওর আম্মা, আব্বা আমাদের দারুণ ভালবাসতেন। ওর বাসায় গিয়ে আলুকাবলি খেয়ে আবার আনন্দ উদযাপন করলাম।

আমি চিঠি লিখে আব্বাকে জানালাম রানার্সআপের কথা, আব্বা আর মা ততদিনে বরিশালের বাড়ি মেজদা আর ছোটদার জিম্মায় রেখে গ্রামের বাড়িতে পাকাপোক্ত ভাবে চলে গিয়েছেন তাই আব্বার সাথে ফোনের যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আব্বা উত্তর দিলেন যে তিনি খুব খুশি হয়েছেন এবং তিনি জানতেন না যে আমি এত ভাল খেলি যে রানার্সআপ হতে পারি। আব্বার উত্তর পেয়ে আনন্দে আমার মন ভরে গেল।

ক্লাস শেষে একদিন রুন আর আমি গেটের বাইরে এলে রুন আমাকে সু-ভাইয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল যে সে ওর বয়ফ্রেন্ড। আমি তখনো মনে প্রাণে বরিশাইল্যা খ্যাত তাই শুনেই হি হি করে হাসতে শুরু করলাম। রুনও হাসে আমিও হাসি। এই হাসাহাসির মধ্যেই আমাদের বিদায় পর্ব হল এবং আমি রিকশা নিয়ে আমার পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম যে আমার ছাগলমার্কা হাসিতে ওরা না যেন কি ভাবল! পরেরদিন কলেজে এসে রুন বলল, সু-ভাই বলেছে যে আমি নাকি রুনের পারফেক্ট বান্ধবি কারণ আমি ওর মত হিহি করি খালি। শুনে আমার মনের পাষাণভার নেমে গিয়েছিল। যাইহোক এরপর থেকে আমাদের ঘোরাঘুরিতে সু-ভাই যোগ হলেন, যেটা আমাদের জন্য ভাল হল কারণ সে আমাদের গার্জিয়ানের ভুমিকা নিয়ে নিল। বলে রাখা ভাল যে সু-ভাই রুনের থেকে প্রায় ১০/১২ বছরের বড় ছিলেন।

আরো ভাল হয়েছিল যে তিনি সাথে থাকলে চটপটি আর কফি তার পকেট থেকেই খসত। (চলবে)

Exit mobile version