Home কলাম নানান রঙের দিনগুলি-১০

নানান রঙের দিনগুলি-১০

শারমীন শরীফ : আমি আব্বার হাতটা ধরে আব্বাকে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। আব্বার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নায় কিন্তু কোন শব্দ নেই। আমি আব্বার পাশে বসে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম কেউ কোন কথা বললাম না। মেয়েরা বিয়ের পরে বিদায় নেবার সময় এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়, আমি বুঝলাম এই আমার বিদায়। আমি এতক্ষণ শক্ত হয়ে বসে থাকলেও এই ভাবনা মাথায় আসার সাথে সাথে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না শুনে আব্বা শক্ত হলেন। মেজদা এসে জানাল যে রিকশা এসে গিয়েছে, আমাদের যেতে হবে, দেরী হয়ে যাচ্ছে। আব্বা আমার চোখ মুছিয়ে হাত ধরে টেনে তুললেন। মা এসে পাশে দাঁড়াল, আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মা, অনেক জ্বালিয়েছি তোমাকে, মাফ করে দিও।’ মা একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, বললেন, ‘মনা ভাল থাকিস।’ তারপরে আলগা করে দিলেন। আমি গিয়ে রিকশায় উঠলাম। রিকশা চলতে শুরু করলে আব্বাও রিকসার সাথে হাঁটতে শুরু করলেন। মেজদা মানা করলেও আব্বা শুনলেন না, রিকশার গতি বেড়ে গেলে আব্বা দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি পেছনে ফিরে তাকালাম, দেখলাম মা আর আব্বা পাথরের মত দাঁড়িয়ে, মা চোখ মুছছেন। গলির মোড়ে বাঁক নিতেই মা, আব্বা চোখের আড়ালে হারিয়ে গেলেন। মনির ভাই যেখানটায় দাঁড়িয়ে থাকতেন আমি স্কুলে যাবার সময় সেখানে এসে পৌঁছতেই আমার দু’চোখ তাঁকে খুঁজল কিন্তু সে নেই কোথাও। বুকটা ব্যাথায় ভরে উঠল। আমি চোখ মুছতে মুছতে মুছতে আমার চিরচেনা গলি, রাস্তা, মোরের দোকান, গাছপালা সবাইকে বিদায় জানালাম নিরবে। বাংলাবাজারের পথ ধরে আমাদের রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে আর আমি যেন ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকলাম আকাশে-বাতাসে; নিজের অস্তিত্বের একটু কণা একটু চিহ্ন রেখে যাবার সেকি প্রয়াস।

স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশ আগে আমাদের এই বাড়ি বানিয়েছিলেন আব্বা। আমার আব্বা তাঁর ভাইবোনদের সকলের ছোট ছিলেন। আব্বার বয়স যখন ২ তখন আমার দাদিজান মারা যান, আমার বড় ফুপুর কোলে চড়ে আব্বা তাঁর মায়ের দাফন দেখেছেন। আব্বা তাঁর ভাইবোনদের কোলে কোলে বড় হয়েছিলেন। সাংসারিক প্রয়োজনে আমার দাদাজান আবার বিয়ে করেছিলেন কিন্তু সেই ঘরে তাঁর কোন সন্তানাদি হয়নি। আব্বাকে আমার নতুন দাদিজান ভালই বাসতেন। আব্বা দাদিজানকে বড় আম্মা বলে ডাকতেন।

তিনি এসেছেন আমাদের বাসায় এবং আব্বা নিজের মায়ের মতই তাঁকে যতœ করেছেন। আমার বাকি চাচা এবং ফুপুদের সাথে বড় দাদিজানের কোন সম্পর্ক ছিল না। দাদাজানের বিয়ের সময় ওঁরা সবাই পূর্ণবয়স্ক ছিলেন বলে হয়ত তাঁদের এত বিবমিষা ছিল দাদিজানের প্রতি। কিন্তু দাদিজানের মৃত্যু পর্যন্ত আব্বা তাঁর সন্তানের মত দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দাদিজানের দেখভাল করেছেন। পিরোজপুর থানার মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালি গ্রামে আমাদের আদিনিবাস।

দাদাজান সেখানে তাঁর তালুকদারি আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর বসতবাড়ির ভিটা আমার বাবাকে দিয়ে যান এবং অন্য চাচাদেরও সমপরিমাপের বসতবাড়ি দিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর সময় তিনি আমার চাচাদের বলেছিলেন, ‘হেমায়েতকে দেখে রেখো, ও যেহেতু শহরে থেকেছে সারাজীবন জমিজমার খবর সে কিছু জানে না, তোমরা ওর জমিজমা দেখে রাখবে এবং সময় এলে পাই পাই হিসেব বুঝিয়ে দেবে ওকে।’ চাচারা কথা রেখেছিলেন, আব্বাকে কোনদিন ভাবতে হয়নি জমিজমা নিয়ে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বছরের চাল, গুড়, নারকেল সব আমাদের বরিশাল শহরের বাড়িতে পৌঁছে যেত। আমার ভাইবোনরা যখন একটু বড় তখন আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন যে বাচ্চাদেরকে নিয়ে আর এ জেলা থেকে ও জেলায় আর ঘুরবেন না। ওদের পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে বলে আব্বা আমার সেজ চাচাকে বললেন যে তিনি আমার মাকে বাচ্চাদের নিয়ে বরিশাল শহরে থিতু করে দিতে চান। সেজ চাচা নিজে জমি দেখে বরিশালের বাড়ি নির্মাণ শুরু করলেন। প্রায় ২ বিঘা জমির উপরে আমাদের বরিশালের বাড়িটি তৈরি হল।

পেছনে বিশাল পুকুর আর তাঁর পরে বিশাল বাঁশঝাড়, সামনে বাগানের জন্য অনেকটা জায়গা রেখে ঠিক মাঝামাঝি তৈরি হয়েছিল আমাদের বিশাল বাড়িটি। ডিজাইন ছিল আব্বার। সহজ হিসেবের ডিজাইন। যেহেতু আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম আব্বা ‘এল’ সেইপের রুম, রুম, রুম করে বিশাল এক ডিজাইন করে দিলেন। বাড়ি উঠে গেলে মা আমার ভাইবোনদের নিয়ে সেখানে থিতু হয়েছিলেন। মা সেখানে নিজের হাতে গাছ লাগিয়ে সেই বাড়িটাকে করে তুলেছিলেন নন্দনকানন। হেন কোন গাছ ছিল না যা আমাদের বাড়িতে ছিল না। এমনকি একটা কমলা গাছও ছিল, যদিও কোনদিন কমলা ধরেনি সে গাছে কিন্তু বেড়ে উঠেছিল লকলক করে।

আমার মায়ের হাতে যেন প্রকৃতির ভালোবাসা মাখানো ছিল। বাড়ির সামনে বাগানটায় ছিল সব রকমের ফুলের গাছ, দেয়ালের একদিক ঘেঁসে সারি সারি বেলিফুলের গাছ আর অন্যদিকের দেয়াল ঘেঁসে ছিল সারি সারি রঙ্গন ফুলের গাছ, কর্ণারে গেটের কাছে ছিল কামিনি ফুলের গাছ আর মাঝখানে ছিল একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ আর তার চারধার ঘিরে ছিল নানা ফুলের গাছ আর গেটের অন্য পাশে ছিল একটা হাসনাহেনার বিশাল ঝাড়, ওই ফুলের সুবাসে সন্ধ্যাবেলা ভেসে যেত চারিদিক কিন্তু সাপের ভয়ে আমরা ওর ধারকাছেও যেতাম না। আমার মা বাড়িটাকে বলতেন স্কুল ঘর, ডিজাইনটা মোটেই পছন্দ ছিল না তাঁর।
এই বাড়িতেই জন্ম আমার। এই বাড়িটির পাজরে পাজরে আমার স্মৃতি, আমার ভালোবাসা মাখানো, বাড়িটি যেন ছিল আমার অভয়ারণ্য, সে আমার সব গল্প জানত। এর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে আমার শৈশব আমার আস্তিত্ব। আব্বা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমি ঢাকা চলে যাবার পরে ওঁরাও গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন, আব্বার ইচ্ছা জীবনের বাকি সময়টা তিনি তাঁর ভাইদের কাছে কাছে থাকবেন। মা মোটেই রাজি ছিলেন না এই সিদ্ধান্তে কিন্তু কিছু করার ছিল না। মা তখন ভাবলেন যে যেতে যখন হবেই তখন প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়াই ভাল। মা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ৩/৪ মাস থাকলেন, পুরনো বসত বাড়ি ভেঙ্গে ফেলে সেই ভিটায় তৈরি করলেন নতুন বাড়ি, নিজের পছন্দ মত। আব্বা সেখানে মতামত দেবার কোন সুযোগই পেলেন না বা দেবার চেস্টাও করলেন না। এই গল্পে আবার ফিরে আসব।
আমরা লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেখলাম ভাবিও এসে গিয়েছে কারণ আমার ভাইবোনদের আমন্ত্রণে সেও যাচ্ছে আমাদের সাথে। সব জিনিসপত্র কেবিনে গুছিয়ে রাখালাম আমরা। দু’টো বেডের একটা কেবিন নিয়েছিল মেজদা। লঞ্চের নাম ছিল এম ভি সামাদ। মেজদা, ভাবি যখন গোছানোতে ব্যাস্ত আমি তখন রেলিঙয়ের ধারে গিয়ে ঘাটের মানুষজন দেখছিলাম, হঠাৎ চোখ আঁটকে গেল, জিন্স পরা, সাদা শার্ট গায়ে একটা খাম্বায় হেলান দিয়ে মনির ভাই দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কয়েকটা হার্টবিট মিস করলাম। আমি চোখ সরিয়ে নিলেও চোখের কোণ থেকে ফিরে ফিরে নজর রাখছিলাম। উনি কাছে এসে কোন কথা বলার চেস্টা করেননি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেক পরে অনেক ভেবেছি এই নিয়ে, কি ভাবছিলেন তখন মনির ভাই? তাঁরও কি কষ্ট হচ্ছিল ঠিক আমার মত?

লঞ্চ ভেঁপু বাজিয়ে নড়ে উঠল, মানে সে যাবার জন্য প্রস্তুত। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। লঞ্চ সরে যাচ্ছে ঘাট থেকে আর আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মনির ভাই হাত তুলে বিদায় জানালেন আর আমিও হাত তুলে বিদায় জানালাম তাঁকে। আমার কান্নার শব্দ শুনে মেজদা এসে আমাকে রেলিঙের কাছে চেয়ারে বসিয়ে দিল। আমি জানিনা ওঁরা মনির ভাইকে দেখেছিল কিনা এবং ইচ্ছা করে সরে ছিল একটুখানি যাতে আমি বিদায় জানাতে পারি কিন্তু আমাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এসেছিল। চোখের জলে আমার দৃষ্টি ঝাপসা আর সে সাথে লঞ্চের গতি বাড়াতে বরিশাল শহরও ঝাপসা হয়ে এল আমার দৃষ্টিতে এক সময় বাঁকে হারিয়ে গেল বরিশাল শহর। কীর্তিনখোলা নদী চিরতরে আমাকে পর করে দিল বরিশাল থেকে। তখনও রোদ ছিল আকাশে, সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছিল নদীর পানি সেই সাথে ঝিকমিক করছিল আমার চোখের পানি। বিদায় কেন এত কষ্টের? আমি নিরবে আমার সব অভিমান ভরা নালিশ করে গেলাম কীর্তনখোলার কাছে, জানি না কি ছিল সেই নালিশ, জানিনা আমার প্রিয় নদী আমার সেই নালিশ তাঁর বুকে ধারণ করেছিল নাকি ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছিল। এই লেখা যখন আমি লিখছি তখনও আমার দু’চোখে বাধ ভাঙ্গা বন্যা। (চলবে)

Exit mobile version