অনলাইন ডেস্ক : অনেক অনুরোধের পর দুটি বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন। ফিরিয়ে দিয়েছেন আরো চার-পাঁচটি প্রস্তাব। নারী জাতীয় দলের ফুটবলার সানজিদা আক্তার অন্য দিকে যে মন দিতেই রাজি নন!
কেবল কি বিজ্ঞাপন? নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের এ যুবতী। কিন্তু নাটক করলে ফুটবল খেলায় বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে সরাসরি ‘না’ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবলের এ পোস্টারগার্ল।
ধারাভাষ্যকার থেকে শুরু করে অনেক দর্শকও সানজিাকে বলেন ‘ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’। পর্তুগালের এ সুপারস্টারের মতো সানজিদাও পড়েন ৭ নম্বর জার্সি। ‘সিআর সেভেন’ বললে যেমন মানুষ বোঝেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে, তেমন বাংলাদেশের নারী ফুটবলে ‘এসএ সেভেন’ হলে সানজিদা আক্তার। তার প্রিয় খেলোয়াড়রও রোনালদো।
ময়মনসিংহের ধোবাউরার কলসিন্দুর গ্রামের লিয়াকত আলী ও জোসনা খানম দম্পতির ৬ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সানজিদা। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে দশম শ্রেণিতে, ছোট বোন ও ছোট ভাই পড়ে হাফিজিয়া মাদ্রাসায়। ছোট বোনও ফুটবল খেলতো। কিন্ত বাবা-মা তাকে থামিয়ে দিয়েছেন। কারণ তাদের যুক্তি ছিল ‘সানজিদা ফুটবল খেলছে। ভালো খেলছে। একজনই খেলুক।’
লিয়াকত আলী ও জোসনা খানম দম্পতির ৬ সন্তানের মধ্যে সানজিদা একটু ব্যতিক্রম। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা আর গানে আসক্তি ছিল তার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে তিন-চারটি পুরস্কার নিয়েই বাসায় ফিরতেন। খেলায় প্রথম হতেন, প্রথম হতেন গানেও।
মানে ফুটবলের মতো গানেও প্রতিভাবান ছিলেন সানজিদা। ‘আমার কন্ঠ ভালো। গানে পুরস্কার পেতাম। এখনও আমি গান গাই একা একা। তবে গান শিখব, গান শেখার জন্য কোথাও ভর্তি হব- সেটা মাথায় আসেনি কখনও। আমার মনে হয় গানে থাকলেও আমি ভালো করতাম’-বলছিলেন দেশের নারী ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ সানজিদা।
দুটি বিজ্ঞাপন করেছেন। সেখান থেকে সম্মানীও পেয়েছেন। নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাবও পেয়েছেন। তাহলে ফিরিয়ে দিলেন কেন? নাটক করলে তো আরও পরিচিতি বাড়তো, অন্য জগতেও আপনার সুনাম হতো।
‘আসলে আমি ফুটবলের বাইরে এখন অন্য কিছু ভাবতে রাজি নই। যে দুটি বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি, সেটা এক কথায় আমার মনের বিরুদ্ধেই। এখনো মাঝে-মধ্যে অফার আসে। বিভিন্ন মাধ্যমে নাটক করার প্রস্তাবও এসেছিল। আমি বিস্তারিত জানতেই চাইনি, না করে দিয়েছি। কারণ, অন্য কিছুতে জড়ালে খেলার ক্ষতি হবে। ফুটবল আর পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই আমার প্রধান লক্ষ্য’-বলছিলেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকা জাতীয় নারী ফুটবল দলের এ খেলোয়াড়।
কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে যান সানজিদা। বঙ্গমাতা ফুটবলে অংশ নিয়ে সবার নজরে পড়েন। ২০১৩ সালে রাজশাহীতে বাফুফের ট্যালেন্ট হান্টিং ক্যাম্প হয়েছিল। সেখান থেকে নারী ফুটবলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তাকে পছন্দ করেন এবং ২০১৪ সালে ডাকেন বাফুফের আবাসিক ক্যাম্পে।
ওই বছরই ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে খেলেন সানজিদা। একই বছর এএফসির অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের সেরা ১০ ফুটবলারের তালিকায় সপ্তম হয়েছিলেন এই নাম্বার সেভেন। পরের বছর নেপালে অংশ নেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের আঞ্চলিক পর্বে। ক্যারিয়ারের প্রথম দুটি আসরেই পান শিরোপার স্বাদ। সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়ন দলেও খেলেছেন তিনি।
ভারতের শিলিগুড়িতে নারী সাফে খেলে জাতীয় দলে অভিষেক সানজিদার। তারপর থেকে নিয়মিত দলে আছেন। তার এখন লক্ষ্য, জাতীয় দলের হয়ে ভালো খেলা। এর পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া।
মাঠে পারফরম্যান্স দিয়ে সুদর্শনা সানজিদা সবার প্রিয় মুখ। অনেক ফ্যান তার। এখন বাংলাদেশে নারী ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট সানজিদাকে খ্যাতির বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। তবে তা নিয়ে কিছু মনে করেন না সানজিদা, ‘আসলে আমাকে অনেকে পছন্দ করেন। তাই কথা বলার চেষ্টা করে। এটাকে আমি স্বাভাবিকভাবেই নেই।’
সানজিদার বাবা-মায়ের কাছে অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু তারাও চান, মেয়ে আরও খেলুক আরো পড়াশোনা করুক। সময় আছে। ‘আসলে এসব নিয়ে আমি এখনো কিছু ভাবি না। ফুটবল আর পড়াশোনার বাইরে ভাবার সময়ও হয়নি। তারপরও বিয়ে-শাদির ওপর কারো হাত নেই। আল্লাহ যখন চাইবেন তখন হবে। ওগুলো এখন আমার ভাবনার বাইরে’-বলছিলেন সানজিদা আক্তার।
ফুটবলে এ পর্যন্ত আসার পেছনে স্কুলের মফিজ স্যার, পরিবারের মধ্যে তার বাবা এবং নারী ফুটবলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের অবদানের কথাই বললেন কলসিন্দুরের এ ফুটবলার।
ফুটবল খেলেছেন বলেই পৃথিবীটা বড় হয়েছে সানজিদার কাছে। ‘এই যে, বিভিন্ন দেশে খেলতে যাই। বিভিন্ন সময় সংবর্ধনা পাই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাই। তিনি আমাদের উপহার দেন। মন্ত্রীরা সংবর্ধনা দেন। আমরা ফুটবল খেলেছি বলে গ্রামে বিদ্যুৎ লাইন গেছে। এসব ভাবতেই ভালো লাগে আমার’-বলেন দেশের নারী ফুটবলের পোস্টারগার্ল সানজিদা আক্তার।