অনলাইন ডেস্ক : ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি নেতৃত্ব বার বার দাবি করেছেন, ‘অব কি বার ৪০০ পার’। শুধু তা-ই নয়, মোদি তথা বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করেছিলেন, বিজেপি একাই ৩৭০ পেরিয়ে যাবে। এক ধাপ এগিয়ে মোদি সেই দাবি করেছিলেন একেবারে লোকসভার ভিতরে!

কিন্তু সেই লোকসভাতেই এবার মোদিকে যেতে হবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে। ৩৭০ তো নয়ই, বিজেপি একা ২৫০ আসনের গন্ডিও পার করতে পারেনি। ফলে সরকার গড়তে মোদি-শাহকে তাকিয়ে থাকতে হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ’র অন্য শরিকদের দিকে।

যদিও ভোটে জিতে সরকার গড়ার ব্যাপারে মোদিকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখা গিয়েছিল। কবে নতুন সরকারে মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন, তার দিনক্ষণ এখনও স্পষ্ট নয়। শোনা যাচ্ছে, চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে শপথ নিতে পারেন তিনি।

তবে এনডিএ যে কেন্দ্রে সরকার গড়ছে তা নিশ্চিত করেছেন মোদি। ভোটের ফলপ্রকাশের পর মোদি তার ভাষণে বলেন, ‘তৃতীয় বার এনডিএ’র সরকার গঠন নিশ্চিত। মানুষ পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছে বিজেপি এবং এনডিএ’র উপর।’

আশ্চর্যের বিষয়, মঙ্গলবার (৪ জুন) রাতে মোদির আগাগোড়া ভাষণে বিজেপির থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এনডিএ। মোদি বার বার এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, শরিকদের নিয়েই সরকার গড়বেন তিনি। মোদি তথা বিজেপি নেতৃত্বকে যতটা আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে, সরকার গড়ার অঙ্কটা কি এতটাই সহজ? মুখে সরকার গড়ার ব্যাপারে কথা বললেও মোদি-শাহেরা কি একটুও চিন্তিত নন? মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকেই সেই সব প্রশ্নই ঘুরছে ভারতের রাজনৈতিক মহলে।

বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ঠিক এক বছর আগে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়। তৈরি করে ‘ইন্ডিয়া’। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে সেই জোটই লড়াই করেছিল দেশ জুড়ে। কোনও রাজ্যে আসন সমঝোতা করে লড়েছে, আবার কোনও রাজ্যে একা একাই লড়াই করেছে জোটের শরিকেরা।

সেই জোটই এ বারের নির্বাচনে ধাক্কা দিয়েছে বিজেপি তথা এনডিএকে। মোদির ‘৪০০ পারের’ স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তারা। ভোটের ফলাফল অনুযায়ী, ‘ইন্ডিয়া’র ঝুলিতে রয়েছে ২৩০-২৩৫টি আসন। অর্থাৎ সরকার গড়ার জাদুসংখ্যা ২৭২-এর থেকে বেশি দূরে নেই তারাও। রাজনৈতিক মহলের মতে, ভোটপর্ব মিটতেই শুরু হতে পারে জোট ভাঙানোর খেলা। এনডিএ থেকে যদি ৪০-৪৫ জন সংসদ সদস্যকে ‘ইন্ডিয়া’তে আনতে পারে, তবে বিরোধীরাই সরকার গড়ার ব্যাপারে এগিয়ে যাবে।

কী অঙ্কে ‘ইন্ডিয়া’র সরকার গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক এনডিএ কী। কোন কোন দল রয়েছে এই জোটে?

১৯৯৮ সালে তৈরি হয় এনডিএ। কংগ্রেস এবং তার সহযোগী দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৎকালীন বিজেপি নেতৃত্ব ঠিক করেন জোটবদ্ধ হয়ে লড়বেন। কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে গদিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয় এনডিএ। অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্ব জোটের সূচনা। এই জোটে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও অন্য ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিশেষত, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি এনডিএতে বড় ভূমিকা নেয়।

এনডিএ’র প্রথম সভাপতি বাজপেয়ীই। তার নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে সরকারে আসে এনডিএ। ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনিই এনডিএ’র চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেই দায়িত্ব সামলেছেন লালকৃষ্ণ আদভানি।

২০১৪ থেকে এনডিএ’র সভাপতি অমিত শাহ। তবে জোটের নেতা মোদি। তাকে সামনে রেখেই ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে জিতে আবারও ক্ষমতায় আসে এনডিএ। এই জোট সে বার ৩৮.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯ সালে এনডিএ’র ভোট শতাংশের হার বৃদ্ধি পায়। ৩৮.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫.৪৩ শতাংশে। সে বার ৩৫৩ আসন পেয়েছিল এনডিএ। বিজেপি একাই ৩০০ আসনের গন্ডি পার করে ফেলেছিল।

তবে ২০২৪ সালে আসনসংখ্যা অনেকটাই কমেছে বিজেপি এবং এনডিএ’র। যে কারণে সরকার গড়ার ব্যাপারে জোটের ভেতরেই শুরু হয়েছে পাটিগণিতের হিসাব। এনডিএ’র মধ্যে ভাঙা-গড়ার খেলা লেগেই আছে সেই ১৯৯৮ থেকে। কখনও শরিক দলের সংখ্যা বেড়েছে, আবার কখনও জোটের হাত ছেড়েছে অনেকে। এমনও দল আছে, যারা জোটে এসেছে, আবার জোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, ফের ফিরে এসেছে।

তাই নতুন সরকার গড়ার জন্য বিজেপির এখন একটাই কাজ। তা হলো, এনডিএ’র শরিকদের জোটবদ্ধ রাখা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকার গড়ার ‘ম্যাজিক ফিগার’ থেকে ২০-২২টি আসন বেশি পেয়েছে এনডিএ।

এনডিএ শরিক দল হিসাবে বিজেপি এ বারের নির্বাচনে ২৪০টি আসন পেয়েছে। তারপরই রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নায়ডুর দল তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। তাদের ঝুলিতে রয়েছে ১৩টি আসন। বিহারের নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ জিতেছে ১২টি আসন। এ ছাড়াও লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস) পেয়েছে পাঁচটি আসন। একনাথ শিন্ডের শিবসেনা পেয়েছে ৭টি আসন। জোটের বাকি ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলি একটা-দুটো করে আসন পেয়েছে। সব মিলিয়ে ২৯২ আসন পেয়েছে এনডিএ।

এনডিএ’র বাকি ১০টি দল ১৬টা আসন পেয়েছে। তাদের মধ্যে জেডিএস, আরএলডি, জেএনপি পেয়েছে ২টি করে আসন। বাকিরা একটি করে আসনে জয় পেয়েছে। এনডিএ’র অন্যতম প্রধান দুই দল টিডিপি এবং জেডিইউ এখন আলোচনার কেন্দ্রে। এবার বিহারে নীতীশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবুকে পাশে না পেলে টানা তৃতীয় বার মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখার বিজেপির স্বপ্ন কঠিন হয়ে যাবে।

কেন স্বপ্নের পথে কাঁটা টিডিপি এবং জেডিইউ? কারণ অতীতে এই দুই দলের প্রধানদেরই ‘পাল্টি’ খাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। মোদি ২০১৪ সালে যখন প্রথম দফায় সরকার গড়েছিলেন, এনডিএ’র শরিক ছিলেন চন্দ্রবাবু। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ প্যাকেজ না পাওয়ায় ২০১৮ সালে জোট ছেড়ে বেরিয়ে যান। এবার ভোটের আগে চন্দ্রবাবুর সঙ্গে হাত মেলায় বিজেপি।

আবার জেডিইউ’র জোটে থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ নীতীশের জোটবদলের ইতিহাস রয়েছে। কখনও বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, আবার কখনও হাত ছেড়েছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় এনডিএতে থাকলেও ২০১৯-এর লোকসভায় এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নীতীশ।

বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ তৈরির ব্যাপারে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিলেন নীতীশ। কিন্তু এবারের লোকসভা ভোট শুরুর আগেই জোটবদল করেন তিনি। ‘ইন্ডিয়া’ ছেড়ে ‘এনডিএ’তে চলে যান। বলা চলে, টিডিপি এবং জেডিইউ-এর সমর্থন না পেলে এনডিএ ‘জাদুসংখ্যা’ ছোঁয়ার আগেই থেমে যাবে। তাই এখন ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন চন্দ্রবাবু এবং নীতীশ।

অন্ধ্রের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে মোদি-শাহের। কেন্দ্রে সরকার গড়ার প্রশ্নেও আলোচনা হয়েছে বলেও ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর এসেছে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, চন্দ্রবাবু কিছু শর্ত দিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্বকে। তবে এও জানিয়েছেন যে তিনি এনডিএতেই থাকছেন। সেই শর্তের মধ্যে যেমন আছে অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ প্যাকেজ, তেমনই রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারে তার দলের গুরুত্ব বৃদ্ধির প্রশ্ন। কিছু মন্ত্রণালয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে খবর।

অন্য দিকে, সরকার গড়ার ব্যাপারে নীতীশের সঙ্গেও একপ্রকার আলোচনা সেরে রেখেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। দলের একটি অংশের দাবি, প্রয়োজনে নীতীশকে উপপ্রধানমন্ত্রী করার আশ্বাসও দেয়া হয়েছে।

এ দিকে, ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরও নীতীশ-নায়ডুকে পাশে পেতে পাল্টা তৎপর। যদি তারা এনডিএ ছেড়ে চলে আসেন, তবে মোদির সরকার গড়া প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে। বুধবার (৫ জুন) ‘ইন্ডিয়া’ শিবির দিল্লিতে বৈঠকে বসছে। জোটের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা এই বৈঠকেই স্থির হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বুধবার সকালেই বিহার থেকে দিল্লি পাড়ি দিয়েছেন আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব। সেই একই বিমানে ছিলেন নীতীশও। বিমানে তাদের আসন ছিল একেবারে পর পর। তারপর থেকেই ভারতের রাজনীতিতে নীতীশকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। দু’জনই আলাদা আলাদা বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লিতে গিয়েছেন। তবে, তারপরেও নীতীশের জোটবদলের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই।

সূত্র : আনন্দবাজার