সাজ্জাদ আলী : চাইলেই যে পাওয়া যাবে ব্যাপারটাতো মোটেই তা নয়। বরং জীবনপটে উল্টোটাই ঘটে বারংবার। বিগত বছরগুলোর প্রাপ্তি তালিকায় চোখ বুলোলেই সে সত্যটি মূর্ত হয়ে উঠে। অনাকাংখিত বিষয়গুলিই যেন জীবনের মুখ্য নিয়ন্ত্রক। “যা চাই” তার পেছনে আমাদের নিরন্তর ছুটতে হয়। আর যত্তসব অপাঙ্ক্তেয়’-অনবরত দরজায় কড়া নাড়তে থাকে, ঘুলি-ঘুপচি দিয়ে জীবনের পর্দায় ঢুকেও পড়ে। নতুন বছরের সূচনায় পেছন নিয়ে ভাবাটা কোন কাজের কথা না। আজকের চিন্তাগুলো আগত ২০২০ এর প্রত্যাশা ও প্রত্যাখ্যান-সংকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক।
আকাংখা, ইচ্ছা, অপ্রাপ্তি- এ সবইতো মানবের চালিকা শক্তি। আগামী সময়ে যদি কিছু পাওয়ার না থাকে অথবা না হারাই, তবে জীবনের অর্থ কি? ইচ্ছাশক্তিই জীবনকে প্রস্ফুটিত রাখে। জগত সংসারের প্রাপ্তিগুলো আমরা স্মরণে রাখি না, তেমন দরকারও পড়ে না। তবে “অপ্রাপ্তি” আমাদের পিছু ছাড়ে না। সারাক্ষণ “পাওনি পাওনি” বলে খোঁচাতে থাকে। আমি বলবো এই “না পাওয়াটাই” জীবনকে চাঙ্গা রাখে। নতুন কিছু পাওয়ার জন্যই মানুষ উদ্যোগী হয়, উদ্যোমী থাকে। যে জীবন স্বপ্ন দেখে না, তার স্থায়িত্ব নিষ্প্রয়োজন। প্রতিটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন জীবনের জন্য অনিবার্য নয়, তবে স্বপ্ন দেখাটা অপরিহার্য।
মানবের সমাজবদ্ধ জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে বন্ধু প্রয়োজন রয়েছে। হতে পারে বন্ধুটি অনাত্মীয় বা আত্মীয়, পরিবারভুক্ত অথবা বাইরের কেউ। “বন্ধু-ভাগ্য” আমার বরাবরই প্রশস্ত। বন্ধুটি নারী নাকি পুরুষ, তা নিয়ে মনে কোন বিভাজন নেই। যাঁর সাথে চিন্তার মিল হবে, ভাবনাজগত আন্দোলিত হবে, যাঁর নৈকট্যে মনোজগত পুষ্ট হবে, আর যাঁর হীরণস্পর্শে চিত্ত তৃপ্ত হবে, – সেই বন্ধু। রেখে ঢেকে যার সাথে কথা বলতে হয়, বা মনের ভাবনা সম্পাদনা করে আওড়াতে হয়, তো সে বন্ধু নয়, বড়জোর তাঁকে “বন্ধুস্থানীয়” বলা যেতে পারে। নতুন এই বছরটিতে যেন পরীক্ষিত বন্ধুদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে পারি। আর একই সাথে অপ্রয়োজনীয়দের জন্য যেন সময় বরাদ্দ না রাখি। ২০১৯ সালটাকে আসলে কাজেই লাগাতে পারিনি। কেমন যেন একটা ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্যে কাটলো। টাকা-পয়সা খরচ আর রোজগার করেই যেন বছরটা কাটিয়ে দিলাম। মগজের পুষ্টিবৃদ্ধি যেন হলোনা মোটেই। কাংখিত বইপুস্তকগুলো পড়ে শেষ করতে পারলাম না, জ্ঞানী-আড্ডাবাজ বন্ধুদের সাথে যথেষ্ট সময় কাটলো না, ভ্রমণ তালিকাও অংশতঃ অদেখা রয়ে গেল। আগত বছরে এ পরিস্থিতি থেকে বেরুতে চাই। প্রতিটি দিনই যেন নতুন কিছু শিখে ঘরে ফিরি।
বছরটিতে পরিচিতজনদের আরো রুচিশীল দেখতে চাই। “আত্মপ্রচার” এক ধরণের রোগ এবং একই সাথে ব্যক্তির জন্য নিকৃষ্টতম কাজও বটে। এই শ্রেণীভুক্তরা সব সময়ই অন্যের আত্মপ্রচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকে। তবে কাজটি যখন নিজে করে তখন তার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দাঁড় করিয়ে নেয়। আর যারা বইটই পড়া আত্মপ্রচারকারী (সুশিক্ষিত অর্থে নয়), তারা তো আরো এককাঠি এগিয়ে। ওরা পঠিত বইগুলো থেকে কোটেশন দিয়ে দিয়ে আপনাকে বলবে, গৌতম বুদ্ধ এটা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের অমুক চিঠিতে এভাবে উল্লেখ রয়েছে, নেলসন ম্যান্ডেলা এমনটি বলেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি (আমিও সেজন্যেই এটা করে থাকি)! আরে জ্ঞানপাপী এত মোটা মোটা বই থেকে এত যে কোটেশন ঠোঠস্থ করলে, এর কোন একখানা বইও তোমাকে “আত্মপ্রচার” বারণ করলো না?
২০২০ সালে যেন কোন প্রিয়জনকে ত্যাগ করার মতো অপ্রিয় পরিস্থিতি তৈরী না হয়। জীবনে এমন কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হয়, যা আমরা কিছুতেই নিতে চাই না। স্বজন যখন অন্যায়, রুচীহীন কাজে সমর্থন আশা করে, তখন তো “শ্যাম রাখি না কুল রাখি” অবস্থা! সে পরিস্থিতি বড়ই মর্মযন্ত্রনার, অনাকাংখিত ও অনভিপ্রেত। এর এক দিকে থাকে বন্ধু হারানোর ভয়, আর অন্যদিকে থাকে নিজ রুচিবোধ, চিন্তা ও সততার সাথে আপোষ। অদূরদর্শী স্বজনদের অপরিনামদর্শীতার কারণেই এহেন পরিস্থিতি তৈরি হয়। “কাকে দিয়ে কতটা করিয়ে নেওয়া যাবে” -সবার সেই বোধদয় হোক। ২০২০ সাল সবাইকে জীবনের মর্ম শেখাক, মনুষ্যত্বের ধর্ম জানাক, সব পাকে পদ্ম পুষ্পিত হোক। সর্ব কল্যাণে পূর্ণ হোক ২০২০ সাল! রবি ঠাকুর থেকে ধার করে সবাইকে শুভকামনা জানাই,
“নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জল নির্মল জীবনে”
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)