অনলাইন ডেস্ক : সূর্য তখন ডুব দিয়েছে। অন্ধকারের কারণে সুবিশাল আকাশ আর দেখা যায় না। শুধু চোখে পড়ে যে, অনেক নিচে তারার মতো মিটমিট করে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। চোখে পড়ে আলো-আঁধারিতে ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি বা দালানকোঠার আভাস।

বিমান বাহিনীর এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টারের জানালা থেকে সবাই তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। ঠিক এ সময়েই তাদের চোখের সামনে আনা হলো নাইট ভিশন গগলস (এনভিজি)। এরপরই বদলে গেল দৃষ্টিসীমার দৃশ্যপট। সব কিছু স্বচ্ছ। বলতে গেলে দিনের আলোর মতোই উজ্জ্বল। রাতের আঁধারে চোখের সামনেই স্পষ্ট দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু! সেতুর নিচে নদীর জলরাশি। রাতেও এমন সুন্দর ও স্পষ্টভাবে পরিবেশে পদ্মা সেতু দেখা এক আশ্চর্য অনুভূতি!

যেসব পাইলট হেলিকপ্টার চালান, তাদের কাছে দিনরাত অভিন্ন করে দেয় এই নাইটভিশন গগলস প্রযুক্তি। গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার পুরাতন এয়ারপোর্টের বাশার ঘাঁটি থেকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে নতুন সংযোজিত এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেন কয়েকজন সংবাদকর্মী। এমআই-১৭১ হেলিকপ্টারে করে রাতের অন্ধকারে একবার পদ্মা সেতু এলাকায় গিয়ে আবার রাতেই ফিরে আসেন তারা ঢাকায়। নাইটভিশন গগলস প্রযুক্তির কার্যকারিতা বোঝাতে একই রুটে গতকাল দিনেও সংবাদকর্মীদের নিয়ে হেলিকপ্টার আসা-যাওয়া করে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিমান বাহিনী তাদের মোট ৯টি হেলিকপ্টারে এনভিজি প্রযুক্তি যুক্ত করল। রচনা করল নতুন ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত। এখন দিনরাতে যে কোনো সময় দেশের সেবায় অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে এনভিজি প্রযুক্তির এই হেলিকপ্টার। সদ্য কেনা সি-১৩০ জে পরিবহন বিমানেও এ প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।

এনভিজি প্রযুক্তির হেলিকপ্টার দ্রুত করোনা আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীকে যে কোনো সময় যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে অল্প সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তরে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এরই মধ্যে ৭ জন মুমূর্ষু রোগীকে এই প্রযুক্তির হেলিকপ্টারে করে সিলেট, যশোর, খুলনা, ভোলা, ময়মনসিংহ ও বান্দরবান থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। দেশের সেবায় ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রস্তুত রয়েছে এনভিজি হেলিকপ্টার। এ ছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও এনভিজি প্রযুক্তির হেলিকপ্টার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে এক অনন্য গৌরবের আসন করে দিয়েছে।

বাশার ঘাঁটিতে এই প্রযুক্তির হেলিকপ্টারের কার্যকারিতা সম্পর্কে বলছিলেন বিমানবাহিনীর কমান্ড্যান্ট ১০১ স্পেশাল ফ্লাইং ইউনিটের এয়ার কমডোর মাহমুদুর হাসান। তিনি বলেন, এনভিজি চালু হওয়ায় দিনরাতে যে কোনো সময় যে কোনো দুর্গম জায়গায় উড্ডয়ন করতে আর কোনো সমস্যা নেই। দিনরাতে অপারেশন নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য আমরা এই প্রযুক্তি সংযোজন করেছি। রাতে দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ভূমির কাছাকাছি উড্ডয়নের সময় ভূমিস্থ প্রতিবন্ধকতা হেলিকপ্টার উড্ডয়ন পরিচালনায় বাধার সৃষ্টি করে; যা পৃথিবীজুড়ে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ। এই পরিস্থিতিতে এনভিজি প্রযুক্তির আবিস্কার ও অন্তর্ভুক্তি বিমান চালনায় নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।

এয়ার কমডোর মাহমুদুর বলেন, নতুন কোনো প্রযুক্তি যুক্ত করার সঙ্গে সামগ্রিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পৃক্ত। তবে আমরা গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিকভাবে এমন এক স্থানে পৌঁছেছি যে, তাতে নতুন যে কোনো স্বপ্ন দেখতে পারি। স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে পারি। তিনি বলেন, সব পাইলট এনভিজি প্রযুক্তির হেলিকপ্টার চালানোর সঙ্গে যুক্ত থাকেন না। কমপক্ষে ‘সি’ ক্যাটাগরির না হলে কাউকে এই প্রযুক্তির হেলিকপ্টার চালানোর জন্য পাইলট হিসেবে মনোনীত করা হয় না। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের পর এনভিজি প্রযুক্তিতে একজন পাইলট দক্ষ হয়ে ওঠেন।

এমআই-১৭১ হেলিকপ্টারের সামনেই কথা হয় স্কোয়াড্রন লিডার মির্জা মোস্তফা জামালের সঙ্গে। তিনি জানান, তিনিই বিমান বাহিনীর প্রথম সদস্য, যিনি বিদেশে গিয়ে এনভিজি প্রযুক্তির ওপর ট্রেনিং নেন। গত বছর ইউক্রেন থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তিনি নিজেকে প্রশিক্ষক করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরে রাশানদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। সফল প্রশিক্ষক হিসেবে দেশে ফেরার পর বাহিনীর অন্য সদস্যদের তিনিই এনভিজির ওপর প্রশিক্ষণ দেন।

সংবাদকর্মী বহনকারী হেলিকপ্টারটিতে আরও ছিলেন বিমান বাহিনীর সদস্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান, উইং কমান্ডার সালাউদ্দিন আহমেদ, উইং কমান্ডার চৌধুরী ওমর হায়দার ও স্কোয়াড্রন লিডার মির্জা মোস্তফা জামাল।

উইং কমান্ডার ওমর হায়দার জানান, এডব্লিউ-১৩৯, এমআই সিরিজ এবং বেল-২১২ হেলিকপ্টারে এরই মধ্যে এনভিজি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এই সক্ষমতা থাকায় দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে গভীর সমুদ্র ও দেশের যে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার রাত্রীকালীন উড্ডয়ন পরিচালনার পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রমেও অংশ নিতে পারছে। বাশার ঘাঁটি থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে এনভিজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে হেলিকপ্টারে আসা-যাওয়া সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেন উইং কমান্ডার ওমর হায়দার।

দিনে রাতে যে কোনো সময় গুরুতর আহত রক্ষীদের দ্রুততম সময়ে উদ্ধার ও সহায়তার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২০১৩-১৪ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে এনভিজি সংবলিত হেলিকপ্টার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে বিমান বাহিনী এনভিজি প্রযুক্তি সংবলিত এমআই সিরিজ হেলিকপ্টার সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও কঙ্গোতে পাঠায়। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ইউএন পিসকিপিং ক্যাপাবিলিটিজ রেডিনেস সিস্টেম (পিসিআরএস) কর্তৃক পরিচালিত র‌্যাপিড ডেভেলপমেন্ট লেভেলের (আরডিএল) আওতায় সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মোতায়েন প্রথম কন্টিনজেন্টে এনভিজি প্রযুক্তি সংবলিত এমআই সিরিজের হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে। এগুলো সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অবস্থিত বাংলাদেশ মিডিয়াম আর্মড মিলিটারি হেলিকপ্টার ইউনিটে যুক্ত হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রথম সদস্য দেশ হিসেবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আরডিএলের আওতায় শান্তিরক্ষী মিশনে কন্টিনজেন্টসহ এনভিজি প্রযুক্তি সংবলিত এমআই সিরিজ হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে।

উইং কমান্ডার সালাউদ্দিন জানান, এনভিজির কল্যাণে রাত্রিকালীন সময়ে অবতরণকারী বৈমানিককে উদ্ধার করা যাবে। দুর্গম ও প্রত্যন্ত স্থান থেকে সংকটাপন্ন রোগী, প্র্রত্যন্ত এলাকায় রাত্রিবেলায় সেনা ও রসদ পরিবহন এবং রাত্রিকালীন দুর্ঘটনায় ‘অনুসন্ধান ও উদ্ধার’ কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে। করোনায় সংকটপন্ন একজন বিচারককে প্রতিকূল পরিবেশে রাতের আঁধারে এনভিজি প্রযুক্তির হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনার বিবরণ সংবাদকর্মীদের শোনান কমান্ডার সালাউদ্দিন।

মঙ্গলবার রাতে বাঁশার ঘাটিতে হেলিকপ্টারের নানা টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি বিষয় খুব সহজসাধ্য করে তুলে ধরেন উইং কমান্ডার নাসির উল্লাহ।
২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লাগে। এ সময় বেল-২১২ হেলিকপ্টার এনভিজি প্রযুক্তির সাহায্যে অগ্নি নির্বাপণ অপারেশনে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসীদের হাতে আহত প্রিসাইডিং অফিসারসহ ১৮ জন মুমূর্ষু ব্যক্তিকেই রাতের অন্ধকারেই বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার এডব্লিউ-১৩৯-এ করে চট্টগ্রাম ও ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়।

বিড়াল গোত্রীয় প্রাণী রাতের অন্ধকারেও সীমিত পরিসরে দেখতে পায়। এ সম্ভাবনাকে মানবজাতির প্রয়োজনে ব্যবহারের লক্ষ্যে এনভিজি গবেষণার সূত্রপাত হয়। ১৯৬৫ সালে স্টার লাইট স্কোপ যুক্ত প্রথম নাইটভিশন গগলস তৈরি হয়। স্বল্পমাত্রার বৈদ্যুতিক শক্তিতে চালিত ছোট্ট এ যন্ত্র পাইলটের হেলমেটে সংযুক্ত করা হয়। স্বল্প আলোকে ৩০ হাজার গুণ বর্ধিত করতে সক্ষম যন্ত্রটি সবুজ আলোক ছায়ার সৃষ্টি করে- যার সাহায্যে পাইলট অন্ধকারেও দেখতে পান। এ সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে হেলিকপ্টার পাইলটরা নিকষ অন্ধকারে রানওয়ে ছাড়াও অবতরণ উপযুক্ত যে কোনো হেলিপ্যাডে অবতরণ ও উড্ডয়নে সক্ষম হন।