ভজন সরকার : জীবনের লক্ষ্য থাকতে হয়। হয় কি? খুব ছোটবেলায় ‘ এইম ইন লাইফ’ বলতে হতো; লিখতে হতো পরীক্ষার খাতায়। শেখানো কথা বলতাম। বইয়ের কথা লিখতাম। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আর্টিস্ট, কেউ শিক্ষক, কেউ অন্য কিছু হতে চাইতাম। এই বলার ভিতর ইচ্ছের প্রতিফলন থাকতো না। আর এতো কম বয়সে ইচ্ছের ডানাগুলো আকাশে মেলার আগেই ছেঁটে ফেলা হতো। শেখানো তোতা পাখির মতো নীড়ের পাখি করে ফেলতো আমাদের সমাজ ও পরিবার। তাই নিজের ইচ্ছেয় লক্ষ্য ঠিক করা কি সম্ভব ছিল তখন?
এ বিষয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা ‘অমলকান্তি’। ক্লাশের সবার চেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে ব্যতিক্রম অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বখে যাওয়া অনিয়মিত-অমনোযোগী ছেলেটির কথা কাব্যিক ভাষায় বলেছিলেন এ রকম,
“আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।”
অমলকান্তির পরিণতির কথা কবি বলেছেন তাঁর কবিতার শেষে,
“অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।”
শুধু অমলকান্তি কেন, এ পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ আছেন কি যার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে বলে দাবী করতে পারবেন? আমাদের পরিবার, সমাজ এবং জীবন-জীবিকার কঠিন বাস্তবতা মানুষের ইচ্ছেকে পূর্ণ করতে দেয় না। তাছাড়া, ক’জন মানুষই নিজের ইচ্ছেটাকেই ছকে বাঁধতে পারেন? ক’জনেই বা জানেন জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই বা কী?
আমার নিজেরই কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল কি জীবনে? ছোটবেলা থেকেই এমন এক আবহে বেড়ে উঠেছি যেখানে মানুষের আনাগোনা ছিল সকাল -সন্ধে। তখন থেকেই মনে করেছি দু’দশ কিলোমিটার চৌহদ্দিই আমার জীবনের পরিধি। চারপাশের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথেই যেন নিজের জীবনের মেলবন্ধন। তখন কি ভেবেছি, দেশ তো বটেই, সুদূর প্রবাসই হবে জীবনে থিতু হবার লক্ষ বস্তু? তখন কি ভেবেছি স্থান ও কাল পরিক্রমার সাথে সাথে জীবনের আদর্শ বদলে যায়?
প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ‘জীবনবাদ’ মেলে না। আমি ভালোর বা মন্দের তুলনা করছি না মোটেই। তবে এটা তো ঠিক যে, পাশ্চাত্যের ভোগ বা আত্মপরায়ণতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না আমাদের শৈশব-কৈশোরের শিক্ষায়। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ সাহিত্য, যা পড়েপড়ে গড়ে উঠেছে আমাদের মন ও মনন সেখানে ‘জীবনবাদ’র সংজ্ঞা ছিল আক্ষরিক অর্থেই ভিন্ন।
তাছাড়া আমার মতো অনেকেই যারা হিন্দুধর্মের আবহে বেড়ে উঠেছি, যেখানে গোঁড়ামি না থাকলেও প্রচ্ছন্ন প্রভাব তো ছিলই ধর্মের। বিশেষকরে দুই ‘শ্রী’র ছিল তাৎপর্যময় প্রভাব। এক, শ্রীচৈতন্যদেবের সহজিয়া আর অন্য, শ্রীকৃষ্ণের গীতা থেকে শিক্ষা। কোনটা ভুল কিংবা কোনটা শুদ্ধ সে তর্কে যাচ্ছি না। তবে ভারত এবং বাংলাদেশের সনাতন ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুদের মধ্যে এই দুইজনের প্রভাব পরোক্ষভাবে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনো করে।
শ্রীচৈতন্যদেবের সহিষ্ণুতার শিক্ষা অর্থাৎ ‘মেরেছিস কলসীর কাণা তাই বলে কি প্রেম দেবো না’ সম্বন্ধে অন্য প্রবন্ধে বলা যাবে । তবে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীমদ্ভগবদ্?গীতা থেকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তা যে জীবনের লক্ষ্য এবং জীবন গঠনের জন্য অসত্য এবং ভ্রান্ত, সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এমনকি যে বিশ্লেষণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়ে শ্রীকৃষ্ণের বাণী-যা অর্জুনকে দেওয়া হয়েছিল তা শেখানো হয়, সেটি শুধু ভুলব্যাখ্যাই নয়, বরং একটি ধর্মীয় স¤প্রদায়কে নির্জীব এবং নিস্ক্রিয় করে রাখার অন্যতম উপাদান।
‘নিস্কাম কর্ম’ বলে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা উল্লেখিত শ্রীকৃষ্ণের যে বাণী, আসলে সেটি যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যই প্রযোজ্য। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন স্ব-গোত্রীয় ভাইদের সাথে যুদ্ধ করতে অর্জুন অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ক্ষত্রিয়ের কর্ম যুদ্ধ করা, সেখানে পক্ষ-বিপক্ষ বা ফলাফল মুখ্য নয়, মুখ্য হলো সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।
অথচ যুগযুগ থেকে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের এই ‘নিস্কাম কর্ম’র উদাহরণটা জীবনের লক্ষ্য স্থির করার সময়ে উপদেশ-বাণী হিসেবে ব্যবহ্নত হয়। একজন মানুষ লক্ষ্য-উদ্দেশবিহীনভাবে আধুনিক সমাজে কি জীবনযাপন করতে পারবেন? ফলের আশা না থাকলে কোন পাগলে কর্ম করবে? অথচ আমাদের ছোটবেলা থেকেই ‘জীবনবাদ’ হিসেবে শ্রীমদ্ভগবদ্?গীতা উল্লেখিত শ্রীকৃষ্ণের বাণী ‘ফলের আশা না করে কর্ম করে যাও’ শেখানো হয়েছে।মানুষের জীবনবাদ সম্বন্ধে এর চেয়ে ভুল কথা আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই বলে পাশ্চাত্যের আত্মপরায়ণতা এবং অসংযত সুখ বা ভোগবাদও যে খুব উন্নত জীবনবাদ সেটিও কি বলা যাবে?
নন্দিত-নিন্দিত লেখক নিরোদ সি চৌধুরী তাঁর ‘দেবোত্তর সম্পত্তি’ বইয়ে জীবনবাদ নিয়ে অনবদ্য একটি উদাহরণ দিয়েছেন। নিরোদ সি চৌধুরীর দাদা চারুচন্দ্র চৌধুরী প্রখ্যাত আইনবিদ এবং বড় সরকারী আমলা ছিলেন। নিরোদবাবুর মতে তাঁর দাদা জ্ঞান, বুদ্ধি, চারিত্রিক দৃঢ?তা এবং মনের স্থৈর্যে নিরোদবাবুর চেয়েও শ্রেষ্ঠ ছিলেন কিন্তু তিনি কিছুই না লিখে সারাজীবন অন্তর্মুখীনই থেকে গেলেন।
একবার নিরোদবাবু এই কথা চারুবাবুর দৌহিত্রী, যে হারভার্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন। নিরোদবাবুর এই আক্ষেপ শুনে তাঁদের দৌহিত্রী বলেছিলেন, তাঁর দাদু যদি নিজের ইচ্ছে মতো জীবনযাপনেই সুখী থাকেন, তা’তে দোষ কীসের? প্রত্যেক ব্যক্তিরই তো নিজের ইচ্ছে মতো নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবার অধিকার আছে।
আমেরিকায় বেড়ে ওঠা দৌহিত্রীর কথা শুনে নিরোদ সি চৌধুরী যা বলেছিলেন আমি এখানে হুবহু তা তুলে দিচ্ছি,
“আমি তাহার এই উত্তরে কিছু মাত্র আশ্চর্য হই নাই। উহা তাহার আমেরিকান শিক্ষা হইতে আসিয়াছিল। মানুষের জীবন সম্বন্ধে আমেরিকান ধারণাই- ধারণাই বলি কেন, ইহা আমেরিকানদের ‘জীবনবাদ’- এই ছিল যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই আত্মপরায়ণ হইতে পারে। পূর্বে এই আত্মপরায়ণতা দেখা গিয়াছিল অর্থপরায়ণতায়, যাহার ফলে রকেফেলার এবং ফোর্ডের মতো অর্থস্রষ্টা দেখা গিয়াছিল। বর্তমানে আমেরিকান আত্মপরায়ণতা সকল বিষয়ে উপভোগের অসংযমে প্রকাশ পাইতেছে। ইংরেজি ভাষায় যাহাকে ‘সেলফ ইনডালজেন্স’ বলে, তাহার চরম রূপ আমেরিকানদের মধ্যে দেখা যায়।”
জীবনবাদ বা জীবনের লক্ষ্য তবে কি শুধুই অর্থপরায়ণতা, আত্মপরায়ণতা কিংবা উপভোগের অসংযমতা?
প্রাচ্য তথা ভারতবর্ষে জীবনের লক্ষ্য পাশ্চাত্য থেকে ভিন্ন। হয়ত রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে সে কথাই লিখেছিলেন এভাবে,
“এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে,
কোন পার হতে কোন পারে।
ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে-
“হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)