অনলাইন ডেস্ক : সবকিছুরই অর্থনৈতিক মূল্য আছে। এর মধ্যে আবার অনিয়ম-অনাচারের মূল্য অনেক বেশি। এই যেমন বলা হয়, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষতি ২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বহু বছর ধরেই বলে আসছে যে বাংলাদেশ যদি দুর্নীতির মাত্রা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সমান পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে জিডিপি বাড়বে ২.১ থেকে ২.৯ শতাংশ পর্যন্ত।
দেশের আরেকটি বড় সমস্যা সড়ক দুর্ঘটনা। বলা হয় সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতি বছর জিডিপির ৩ থেকে ৫ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।
যানজট নিয়েও এ ধরনের একটি হিসাব পাওয়া যায়। এই তথ্যও বিশ্বব্যাংকের। সংস্থাটি বলছে, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, আর এতে বার্ষিক ক্ষতি ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪২ হাজার কোটি টাকা।
অনিয়মের এসব আর্থিক ক্ষতির হিসাব প্রায়শই আলোচনা হয়। বছর জুড়ে নানা সেমিনারে উল্লেখ করা হয়। গবেষণা চলে। নতুন নতুন হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে আরও অনেক বড় বড় ঘটনা দেখা যায়, সে সব ঘটনারও তো আর্থিক ক্ষতি আছে। সেই হিসেব সহজে পাওয়া যায় না। আলোচনাও তেমন হয় না।
এ রকমই একটি বিষয় নারীর প্রতি সহিংসতা। যৌন নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও ধর্ষণের মতো ঘটনার সামাজিক মূল্য অনেক বেশি। সারাটা জীবন একজন নারীকে বড় ধরনের সামাজিক মূল্য দিয়ে যেতে হয়। ধর্ষণের শিকার একজন নারীর পুরোটা জীবন বদলে দেয় একটি ঘটনাই। কিন্তু সবার তথ্য কি আমরা জানি। কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করলে বা মামলা করলে ঘটনা জানাজানি হয়। কত ঘটনাই তো আড়ালে থেকে যায়, পত্রিকায় পাতায় স্থান পায় না। কিন্তু নিজের পরিবারের সদস্যরা জানেন, এলাকাবাসী জানেন, তাতেও সামাজিক মূল্য মোটেই কম দিতে হয় না।
বাংলাদেশে ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক ঘটনাও বটে। রাজনীতির মাঠে হঠাৎ ক্ষমতাশালী ও অর্থশালীদের ধর্ষক হয়ে ওঠার পেছনেও তো ব্যাখ্যা আছে। ক্ষমতাশালীদের শক্তি প্রয়োগের একটি মাধ্যম ধর্ষণ। আর এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের কথা না হয় বাদ দিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকাই। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের হিসেবে, সেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার প্রতি ১ হাজার জনের মধ্যে পুলিশের কাছে যায় মাত্র ৩১০ জন। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে মাত্র একজনের তথ্য জানা যায়। এখন কল্পনা করুন বাংলাদেশের কি অবস্থা।
এখন তো বাংলাদেশে ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক ঘটনাও বটে। রাজনীতির মাঠে হঠাৎ ক্ষমতাশালী ও অর্থশালীদের ধর্ষক হয়ে ওঠার পেছনেও তো ব্যাখ্যা আছে। ক্ষমতাশালীদের শক্তি প্রয়োগের একটি মাধ্যম ধর্ষণ। আর এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ফলে ধর্ষণের শিকার হয়েও মুখ না খুলতে পারার, বিচার না পাওয়ারও এক ধরনের রাজনৈতিক মূল্য আছে। সঠিক ভোটাধিকার প্রয়োগের অভাবে হয়তো সেই রাজনৈতিক মূল্য আপাতত হারিয়ে গেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের রাজনৈতিক বা সামাজিক মূল্য নিয়ে এখন অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় প্রতিবাদে উত্তাল দেশ। নতুন আরেকটি বিষয় সামনে না আসা পর্যন্ত হয়তো এই আলোচনা থাকবে। পরে হারিয়ে যাবে অন্য ঘটনার আড়ালে। তবে এ সমস্ত ঘটনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনার আরেকটি দিক নিয়ে আলোচনা হয়, গবেষণাও হয়। যা নিয়ে আমাদের দেশে খুব একটা কথা হয় না। আর তা হচ্ছে এর অর্থনৈতিক মূল্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, একজন শিক্ষার্থী যদি তার শিক্ষাজীবনে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে তার লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়, অনেকে সঠিক ভাবে শিক্ষা জীবন শেষও করতে পারেন না, বা শেষ করতে দেরি হয়, অনেকে পরবর্তী জীবনে ভালো ভাবে কাজ করতে পারেন না, উৎপাদনশীলতা কম হয়, চাকরি হারান। সুতরাং এর অবশ্যই বড় ধরনের অর্থনৈতিক মূল্য আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে অন্য যে কোনো অপরাধের চেয়ে ধর্ষণের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি বেশি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলেছে, ২০১৭ সালের হিসেবে ধর্ষণের শিকার প্রতিজনের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি ১ লাখ ২২ হাজার ৪৬১ ডলার। আর ওই বছর ২ কোটি ৫০ লাখ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে লিপিবদ্ধ আছে। সেই হিসেবে এক বছরে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতি ৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটিতে এক ট্রিলিয়ন) ডলার।
২০০০ সালে করা আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, বয়ঃসন্ধিকালে যারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, বড় হওয়ার পরে বা প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে অন্যের তুলনায় তাদের আজীবন আয় হ্রাস পেয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৬শ ডলার।
তাহলে বাংলাদেশের যৌন নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের অর্থনীতি কত বড়? এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা বা গবেষণা দেখা যায় না। ২০০৯ সালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নিজের পরিবারে বা সঙ্গীর দ্বারা অর্থাৎ ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অর্থনৈতিক মূল্য নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সেটি ছিল মূলত চিকিৎসার খরচ ও বিচার চাইলে তার খরচ ধরে।
তবে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণাটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার-এর। ২০১৮সালে করা এক গবেষণায় সংস্থাটি বলছে, নারীর প্রতি সহিংসার কারণে বাংলাদেশে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৩০ কোটি ডলার বা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ মোট দেশজ উৎপাদনের ২ দশমিক ১ শতাংশ।
কেয়ার নারীর প্রতি সহিংসার কারণে ১৩টি দেশের আর্থিক ক্ষতিরও একটি হিসেব দিয়েছে। ফিজির ক্ষেত্রে তা জিডিপির ৬.৬ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় জিডিপির ১.৫৭ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১.৪১ শতাংশ, তানজানিয়ায় ১.২২ শতাংশ, জাম্বিয়ায় ২.২৭ শতাংশ, উগান্ডায় দশমিক ৩৫ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১.৯ শতাংশ, মরক্কোয় ৬.৫ শতাংশ, বলিভিয়ায় ৬.৪৬ শতাংশ, পেরুতে ৩.৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১.৫১ শতাংশ এবং কানাডার ক্ষতি জিডিপির দশমিক ৪৭ শতাংশ।