স্বপন কুমার সিকদার : ব্যবসায় দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান বজায় করণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তারাই হলো কাষ্টমার। কাষ্টমারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে দ্রব্য ও সেবা আখাংখিত গুনাবলী যুক্ত। অনেক বিষয় দ্রব্য ও সেবার গুনগত বজায় করনের সাথে জড়িত। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ইহার ব্যবহারভিত্তিক সজ্ঞায় বলা হয়, ইহা ক্রেতার নিকট দ্রব্য বা সেবার আকাংখিত ব্যবহারের উপযোগীতা এবং ইহা নির্ধারন করা হয় একজন ক্রেতা বা ব্যবহারকারী কি চায় তার উপর। দ্রব্য ও সেবার গুনগত মানের মূল্যভিত্তিক সজ্ঞায় বলা হয়, ইহা হলো দ্রব্য ও সেবার মূল্যের সাথে ঐ দ্রব্য ও সেবা থেকে তুলনামূলকভাবে প্রাপ্ত উপকারিতা বা সন্তুষ্টি।

ইহার উৎপাদনভিত্তিক সজ্ঞা হলো, ইহা প্রকৌশল ও উৎপাদনগত এমন গুনবলী যাহা অর্থাৎ দ্রব্য বা সেবা কতটুকু প্রদত্ত বা নির্ধারিত বর্ননা বা শর্তানুযায়ী বা আকাংখা অনুযায়ী তৈরী বা প্রদান করা হলো তাহা। আমেরিকান সোসাইটি ফর কোয়ালিটি অনুযায়ী ইহা পুরোপুরি দ্রব্য বা সেবার গুনাবলী বা চরিত্রগত দিক যাহা দ্রব্য বা সেবার উল্লেখিত বা বিশেষ প্রয়োজন পূরনের সামর্থ্যতাকে বুঝায়। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানের ভোক্তার দিককে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সহজ এবং শক্তিশালী সজ্ঞা হলো – ইহা ভোক্তার আশা বা আকাংখা পূরণ বা অতিক্রমনের উপযুক্ততা। কোয়ালিটি কন্ট্রোল হ্যান্ডবুকের লেখক ‘জুরান’ দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানের একটি সহজ ও সুন্দর সজ্ঞা দেন। তার মতে দ্রব্য ও সেবা ব্যবহারের উপযুক্ততাই হলো দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান। তিনি বলেন জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান ব্যবস্থাপনায় বা নিয়ন্ত্রনে কর্মঠ, উদ্দীপক, প্রাণবন্ত বা প্রভাবিত করতে পারে এমন পরিচালক, ব্যবস্থাপক বা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করতে হবে ।

ড. ইসিকাওয়া বিশ্বাস করেন দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান ভোক্তা হতে শুরু, ভোক্তার প্রয়োজন অনুধাবন উন্নয়নের ভিত্তি এবং গুরুত্ব সহকারে দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানের ব্যাপারে কি কি অভিযোগ আছে তা জানা দরকার। তার মতে দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানের ব্যাপারে প্রথম ধাপ হলো ভোক্তার কি প্রয়োজন তা জানা। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান শিক্ষা দিয়ে শুরু এবং শিক্ষা দিয়ে শেষ হয়। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান নিয়ন্ত্রনের আদর্শিক অবস্থা ঘটে যখন কোন তদন্তের প্রয়োজন হয় না। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান উন্নয়নে, লক্ষন নয় ত্রুটির মূল কারণ অপসারন প্রয়োজন। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সকল বিভাগের সকল শ্রমিকের। যখন কোন শ্রমিক বা অধঃস্থন কর্মচারী কোন সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হয়, উর্ধতন ব্যপস্থাপকের অসন্তুষ্ট হওয়া বা রাগ দেখানো উচিত নয়।সমস্যার শতকরা পঁচানব্বই ভাগই বিশ্লেষন ও সমস্যা সমাধানের সাধারন টুলস্ দিয়ে সমাধা করা সম্ভব। যখন দ্রব্য ও সেবা ভোক্তার আশা বা আকাংখা পূরণ বা অতিক্রমন করে তখন ভোক্তার তৃপ্তি হয় বা ঘটে।

এ. ভি. ফাইজেনবাম লক্ষ্য করেন যে, দ্রব্য ও সেবার গুনগত মান ইংরেজী ভাষার নয়টি ‘এম’ যুক্ত শব্দ দিয়ে প্রভাবান্বিত বা শুরু। যেমন- মার্কেট, মানি, ম্যানেজমেন্ট, মেন এন্ড উমেন, মটিভেশান, মেটেরিয়েল, মেসিন এন্ড মেকাইনেজেশান, মডার্ণ ইনফরমেশান মেথড, এবং মাউ্টংি প্রোডাক্ট রিকোয়ারমেন্ট। ভোক্তা হলেন এক্ষেত্রে বিচারক। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান এবং নব আবিষ্কার পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবসা নিয়ন্ত্রন অনেকটা একই। দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া।

ভোক্তা সাধারন হলো দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানের মূল বিচারক। দ্রব্য ও সেবার মানের উপলব্ধি ও সন্তুষ্টি অনেক কিছু দিয়ে প্রভাবান্বিত। ভোক্তার আকাংখা পূরণ বা অতিক্রমনের জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, দ্রব্য ও সেবার গুনাগুন ভোক্তার কাছে মূল্যবান এবং তাহা ভোক্তার সন্তুষ্টি ও বিশ্বস্থতা লাভের কারণ।

একটি প্রতিষ্ঠানের দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান উন্নয়নের জন্য প্রথমে দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান উন্নয়ন পলিসি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ইহা হলো মোটামুটিভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপক কর্তৃক প্রকাশিত বা প্রচারিত দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য ও নির্দেশনা। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সামজ্ঞস্য, সঙ্গতি বা মিল নিশ্চিতকরণের জন্য এবং উপলব্ধি করা, বুঝিতে পারা বা বিদিত থাকার জন্য দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান সম্পর্কিত পলিসি সজ্ঞায়িত, লিপিবদ্ধকৃত ও প্রচারিত হওয়া উচিত। পলিসি হলো উচ্চ পর্য্যায়ের সাধারন লক্ষ্য এবং গ্রহনযোগ্য কর্মাদি জড়ায়ে সার্বিক বা সামগ্রিক পরিকল্পনা। পলিসি কিভাবে লক্ষ্য অর্জিত হবে এবং সিদ্ধান্তসমূহ পরিচালিত করার অভিপ্রায় করা হয়েছে তা বর্ননা করে। একটি ফলদায়ক পলিসি সূত্রাকারে বা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার জন্য আগ্রহী দল বা আগ্রহী পক্ষ এবং ক্রিয়াকলাপ ও সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হয় এমন সমস্ত ব্যক্তি বা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। উচ্চ ব্যবস্থাপকবৃন্দ নিশ্চিত করবেন যে, প্রতিষ্ঠানে দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান অর্জনের লক্ষ্য সমূহ নির্দিষ্ট স্তরে প্রতিষ্টা করা হয়েছে এবং ক্রমাগত উন্নয়ন এবং দ্রব্য ও সেবার গুনগতমান বজায় করনের পলিসির সাথে মিল আছে বা সামজ্ঞস্যপূর্ণ।

যে কোন সিষ্টেমকে সফল হতে হলে ঐ সিষ্টেমের সকল অঙ্গসমূহকে একযোগে কাজ করতে হবে। ডেমিং পরামর্শ দেন দেন যে, আগে ব্যবস্থাপনা বা কর্তৃপক্ষকে অনুধাবন করতে হবে এবং পরবর্তীতে টেকনোলজী, প্রোসেস ডিজাইন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পার্থক্য কমায়ে আনতে হবে। ডেমিং জোর দিয়ে বলেন, উচ্চ ব্যবস্থাপকের বা ব্যবস্থাপনার দ্রব্য বা সেবার গুনাগুন উন্নত করনে অনেক কিছুকে উপেক্ষা করে অনেক কিছু করার অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, যে কোন পদ্ধতির উপাদান বা অঙ্গসমূহকে অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে যেন পদ্ধতিটি ফলদায়ক হয়। ডেমিং-এর মতে, “ভয়কে বিতাড়িত করুন, বিশ্বাস সৃষ্টি করুন এবং নূতন কিছু সৃষ্টির পরিবেশ বা আবহাওয়া তৈরী করুন”। তিনি বলেন, “ইহা হলো দুর্বল ব্যবস্থাপন। যেমন, উৎপাদন খরচ কমানোর জন্যে সবচেয়ে কম মূল্যে দ্রব্য বা সেবা ক্রয় করা যদি তাহা সিস্টেমের ব্যয়ের বা খরচের হিসাবের কারণে হয়”। কম মূল্যে ক্রয়কৃত দ্রব্য এত নিন্ম মানের হতে পারে যে, ঊৎপাদন ও আনুক্রমিক সংযোজনের সময় তাহা মেরামত বা ছোট পরিবর্তনে অধিক ব্যয় হয়।

সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য গুনগতমান (Quality) ভোক্তা ধরে রাখা, লাভযোগ্যতা বজায় রাখা এবং মার্কেট শেয়ার লাভের জন্য একান্ত অত্যাবশ্যক। সন্তুষ্ট ভোক্তাগন কোম্পানীকে আনুগত্য, পুনরায় ব্যবসা করন, ইতিবাচক উল্লেখের মাধ্যমে পুরষ্কৃত করেন। ভোক্তাকে পরিতৃপ্ত করনের জন্য তাদের প্রয়োজন এবং ইচ্ছার প্রতি দ্রুত এবং কার্যকর সাড়া এবং সমাধান যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ভাল সম্পর্ক সৃষ্টিকরা ও বজায় রাখা। হারসি ফুড কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন হারসি বলতেন, ‘তাদের গুনগতমান (Quality) দিন, তাহাই এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বা ভাল বিজ্ঞাপন’। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, নূতন একজন ভোক্তাকে পেতে পুরাতন ভোক্তাকে খুশী রাখার জন্য ব্যয়ের পাঁচ গুন বেশি ব্যয় হয়।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মান সংস্থায় নিবন্ধিত করন খুবই ঘুরুত্তপূর্ণ কেননা ইহা ভোক্তাগনকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে প্রতিষ্টানটির ভাল মানের মান নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা রয়েছে যাহা প্রতিষ্টানটির বাহিরের অডিট দল নিরীক্ষিত ও উর্ত্তীর্ণ।

“Quality is never an accident; it is always the result of intelligent effortÓ – John Ruskin. এখন ব্যবসায়িক দৃষ্টিভংগি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। যেমন -“let the buyer bewareÓ to Òlet the producer beware”. অতএব, সফলতার সাথে ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোম্পানীসমূহকে অবশ্যই দ্রব্য ও সেবার গুনগতমানের (Quality) দিকে দৃষ্টি দিতে হবে যাহা তারা ভোক্তাগনকে প্রদান করতে চান। ভোক্তাগনের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুধাবন করে ক্রমাগতভাবে দ্রব্য ও উৎপাদন পদ্ধতির উন্নয়ন বিশ্ব বাজার দখলের একমাত্র চাবিকাটি।
* প্রকৌশলী, ইনস্টিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, ঢাকা, বাংলাদেশ-এর সদস্য, কোয়ালিটি এসুরেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্টে অনার্স সহ স্নাতক (অন্টারিও) এবং একজন সমাজ হৈতষী কর্মী।