ফরিদ আহমেদ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং (র)’ এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতের অবদান সম্পর্কে আমরা সরাসরি জানলেও ‘র’ এর কর্মকাণ্ড বিষয়ে পুরোপুরি আমাদের জানা নেই। না থাকারই কথা। এটা একটা গোয়েন্দা সংস্থা। এদের কার্যক্রম গোপনীয় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তারপরেও এরা কোন পদ্ধতিকে এবং কোন ধরনের কার্যক্রম নিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় বি, রমণ এর লেখা ‘দ্য কাওবয়েজ অব দ্য র’ বই থেকে। বইয়ের লেখক বি, রমণ ‘র’ এর জন্ম লগ্ন থেকে জড়িত ছিলেন। অবসর নেবার আগ পর্যন্ত পরবর্তী ছাব্বিশ বছর তিনি এই সংস্থাতেই কাজ করেছেন। ফলে, ১৯৭১ সালে ‘র’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কী ভূমিকা নিয়েছিলো, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি তাঁর আলোচনা বিস্তৃত করেছেন।
১৯৭১ সালে ‘র’ এর প্রধান ছিলেন রাজেশ্বর নাথ কাও। তিনি অবশ্য এর সূচনালগ্ন থেকেই প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৭১ সালে ‘র’ এর সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা রাজেশ্বর কাও এবং বি, রমণসহ তাঁর অন্যান্য কর্মকর্তারা ‘কাওবয়’ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এই নামকরণ কে দিয়েছিলো, সেটা নিয়ে কেউ-ই নিশ্চিত না। কিন্তু, এঁরা যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার জন্য অসামান্য সাফল্য বয়ে এনেছিলো, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
‘র’ এর জন্ম ১৯৬৮ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর। এর আগে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো দিয়েই সীমিত আকারে বিদেশের গুপ্তচরবৃত্তির কাজ চালাতো ভারত। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ইন্টেলেজিন্স ব্যুরোর একটা অনশ আলাদা হয়ে ‘র’ তৈরি হয়। এর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন রাজেশ্বর নাথ কাও। প্রথম কয়েক মাসে তিনি দুটো অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেন। প্রথমত, পাকিস্তান ও চীনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা সুসংহত করা। দ্বিতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্তানে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি এবং সুসংহত করা।
তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানে ভারতের গোয়েন্দা তৎপরতা ‘র’ সৃষ্টির আগে থেকেই চলছিলো। এটা চালাতো ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ষাটের দশকে নাগা এবং মিজোদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছিলো। লালদেঙ্গার নেতৃতাধীন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট আইএসআইয়ের সহায়তা পেতো, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপদ আশ্রয় পেতো। নাগাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ছিলো। এদের সাথে শুধু আইএসআই-ই জড়িত ছিলো না, চীনের গোয়ন্দা সংস্থাও ছিলো।
পূর্ব পাকিস্তানের আইএসআই-এর কর্মকাণ্ড ভারতের জন্য বেশ বড় ধরনের একটা মাথাব্যথা ছিলো। কারণ, তার নাজুক সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো এই কর্মকাণ্ডের কারণে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আন্দোলন ভারতের জন্য সুযোগ হয়ে আসে। এটাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারলে আইএসআই-এর কর্মকাণ্ডকে বন্ধ করে ফেলা সম্ভব। ফলে, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দ্বিধাহীন চিত্তে ভারত এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যখন শুরু হয়, ‘র’ এর বয়স মাত্র আড়াই বছর। ফলে, সীমান্তের ওপারে গোপন এবং সক্রিয় তৎপরতা পরিচালনা করার সক্ষমতা প্রদর্শন করাটা ‘র’ এর কর্মকর্তা কাওবয়দের জন্য ছিলো একটা বিশাল পরীক্ষা। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মধ্য দিয়ে তাঁরা অবশ্য সেই পরীক্ষায় সাফল্যের সাথেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
যে কোনো গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডে তথ্য সংগ্রহ করাটাই সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পূর্ব পাকিস্তানে ‘র’-কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তেমন বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি। বিরামহীনভাবে তথ্য এসে জমা হয়েছে তাদের কাছে কোনো ধরনের কষ্ট করা ছাড়াই। পাকিস্তান বাহিনীর তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুবই দুর্বল ধরনের ছিলো। ফলে, ‘র’ খুব সহজেই তাদের যোগাযোগগুলোকে ইন্টারসেপ্ট করে ফেলতে পারতো। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত বহু বাঙালি কর্মকর্তাই মনে প্রাণে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা অবিরামভাবে তথ্য সরবরাহ করে গিয়েছে ‘র’ এর কাছে পাকিস্তানিদের বিষয়ে। শুধু কর্মকর্তারাই নন, সাধারণ মানুষও স্বতস্ফুর্তভাবে তথ্য সরবরাহ করেছে। বি, রমণ লিখেছেন, “১৯৭১ সাল ছিল ভারতের পেশাদার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জন্য এক ধরনের স্বপ্নের পরিস্থিতি। গোয়েন্দা তথ্যের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে হতো না বরং এসব তথ্য তাদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হতো। পূর্ব পাকিস্তানের পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তখন এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয় যাতে তারা স্বেচ্ছায় গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য তাদের নেতৃবৃন্দ ও ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে সরবরাহ করত। সর্বতোভাবে সহযোগিতা দানকে তাদের দেশপ্রেম ও দায়িত্বের অংশ মনে করত।”
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ‘র’ মূলত পাঁচটা ভূমিকা পালন করেছিলো। নীতিনির্ধারক ও সশস্ত্র বাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া, পশ্চিম পাকিস্তান ও বিদেশে পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কর্মরত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে নেটোয়ার্ক তৈরি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান নাগা ও মিজো বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ শিবির ও নিরাপদ আস্তানাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা এবং শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্তি¡ক যুদ্ধ সংগঠিত করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিন দেশ জড়িয়ে পড়ার কারণে আমাদের যুদ্ধের মোটা দাগে তিনটা ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানিরা মনে করে কিছু গাদ্দার বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে পাকিস্তান থেকে। একটা বড় সংখ্যক ভারতীয়ের ধারণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাদের দান। তারা সাহায্য সহযোগিতা এবং সামরিক যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে না পড়লে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীন হওয়া সম্ভব ছিলো না। বি, রমন তাঁর বইতে এই আচরণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় ভারতের একক সাফল্য ছিলো না। এটা ছিলো ভারত এবং পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের যৌথ বিজয়। ভারত স্বাধীন বাংলাদেশের একক স্থপতি, এটা বলাটা ভুল। সৃষ্টির চাইতেও ভারতের ভূমিকা বেশি ছিলো সৃষ্টিতে সহায়তাকারীর।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীন হওয়ার আগ্রহ ও সংকল্প ছাড়া বাংলাদেশের জন্ম হতো না। লক্ষ্য অর্জনের তাদের আত্মত্যাগ ছিলো অনেক বড়। কত মানুষ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলো! কত বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি সেনা ও আইএসআই সৃষ্ট সংগঠন আল শামস, আল বদরের হাতে মৃত্যুবরণ করেছিলো! তাদের এই আত্মত্যাগই স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি তৈরি করেছিলো। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত শুধু তাদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ যাতে ব্যর্থ না হয় তা নিশ্চিত করেছে।”
জেনারেল জ্যাকবও তাঁর এক সাক্ষাৎকারে একই ধরনের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এটা ছিল বাংলাদেশের ফাইট, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে ভালোবেসে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, আমরা পাশে ছিলাম।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানকে বেশি হাইলাইট করলে পরবর্তীতে বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা জেগে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে এটা ইন্দিরা গান্ধী নিজেও জানতেন। সে কারণে তিনিও সবসময়ই বাংলাদেশের অবদানকে সামনে ঠেলে দিয়েছেন, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অবদানকে লাইমলাইটে আনেননি।
রাজেশ্বর নাথ কাও, বি, রমণ, জেনারেল জ্যাকব কিংবা ইন্দিরা গান্ধীদের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং মানবিকতা অবশ্য সবার কাছে থেকে আশা করা যায় না। এঁরা অন্য পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের জাতির একটা ক্রান্তিলগ্নে আমরা এঁদেরকে অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলাম।