অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বজুড়ে চলছে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মীরাও টিকে থাকার লড়াই-সংগ্রাম করছেন। বন্ধ হয়ে আছে স্ট্রিপ ক্লাব, নিষিদ্ধপল্লী। ফলে রাতারাতি এসবের সঙ্গে যুক্তদের আয় গেছে বন্ধ হয়ে। ফলে তারা বেঁচে থাকা, স্বাস্থ্য নিয়ে ভয়াবহ এক আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অনলাইন বিবিসিতে বাংলাদেশের দৌলতদিয়া পতিতাপল্লী, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন এবং বৃটেনে যৌনকর্মীদের দিনকাল নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দৌলতদিয়া পতিতাপল্লী বিশ্বের সবচেয়ে বড় পতিতাপল্লীর অন্যতম। টিনের ঘরে সংকীর্ণ গলিপথযুক্ত এই পল্লীতে থাকেন ১৩০০ নারী ও তাদের ৪০০ সন্তান।
এর প্রবেশপথেই পুলিশ প্রহরা। সেখানে খদ্দের প্রবেশে বাধা দিচ্ছে তারা। মার্চ থেকে এই পতিতাপল্লী বন্ধ। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে এসব নারী রীতিমতো লড়াই করছেন। তারা বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার দানের ওপর নির্ভর করছেন। এর মধ্যে একজন যৌনকর্মী নাজমা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেছেন, আমাদের কোনো কাজ নেই। ফলে কোনো আয়ও নেই। নাজমার তিনটি সন্তান গ্রামের বাড়ি তার বোনের কাছে থাকে। তাদের খরচ দিতে হয় নাজমাকে। মাত্র ৭ বছর বয়সে তিনি ৩০ বছর আগে এসেছেন ওই পতিতাপল্লীতে। এ সময়ে তার টাকার প্রয়োজন। তবে এই মহামারির সময় পেশা চালিয়ে নেয়ার বিপদের কথাও তিনি জানেন। নাজমা বলেন, যদি আমরা কাজ করতেও পারি, সবার জীবন তো এই ভাইরাসে ঝুঁকির মুখে। খদ্দেরের সঙ্গে মেলামেশা করতে আমরা ভয় পাই। কারণ, জানি না কে করোনা আক্রান্ত।
বিবিসি লিখেছে, পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত দৌলতদিয়া। এটি এই দৌলতদিয়া ফেরি টার্মিনালের পাশেই। এই পয়েন্টটি হলো দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সংযুক্তির প্রাণকেন্দ্র। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগে কয়েক হাজার ট্রাকচালক প্রতিদিন এই পয়েন্ট অতিক্রম করতেন। তারা বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য ও অন্যান্য জিনিস ঢাকায় সরবরাহ করেন। এই পতিতাপল্লীতে যেসব নারী ও শিশু বসবাস করে তাদের বেশির ভাগই পাচারের শিকার। ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী শ্রাবন্তি হুদা বলেছেন, এদের ভিতর বিপুলসংখ্যক শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে সেখানে। নারীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু সাহায্য বিষয়ক তহবিল দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় সহায়তা বিষয়ক সংগঠন। কিন্তু শ্রাবন্তি হুদা বলেন, এটা পর্যাপ্ত নয়। কিছু নারী একেবারেই কিছু পাচ্ছেন না। সরকারের কাছ থেকে তারা যে পরিমাণ দান পাচ্ছেন তা দিয়ে সন্তানের জন্য এক প্যাকেড পাউডার দুধও কিনতে পারছেন না। মে মাসের শুরুর দিকে শ্রাবন্তি একটি বেসরকারি ত্রাণ বিতরণের আয়োজন করেন। তারা ওই পতিতাপল্লীর ১৩০০ নারীর প্রতিজনকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্যাকেট বিতরণ করেন। শ্রাবন্তি বলেছেন, একজন নারী এলেন। তিনি বললেন, তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। এক মাস ধরে তিনি ইনসুলিন বা ডায়াবেটিসের ওষুধ খেতে পারছেন না। আরেকজন বলেছেন, দু’মাস ধরে তিনি তার রক্তচাপের ওষুধ কিনতে পারছেন না।
ওই রিপোর্টে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এস্তেলে লুকাস নামে একজন পতিতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি গত ১০ বছর এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। এ সময়ে সতর্কতার সঙ্গে তিনি খদ্দেরদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তাই যৌনকর্মে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এ অবস্থায় তিনি পেশা চালিয়ে নেয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। এস্তেলে বলেন, যদি ৬ মাস আমার কাজ বন্ধ থাকে তাহলে তো অনেক খদ্দের আমাকে ভুলে যাবে। আমি সরাসরি তাদের সঙ্গে মিশতে পারি না। শুধু কথা হয় তাদের সঙ্গে। আমার পেশাগত দিক দিয়ে এটা কোনো কাজে আসে না। আমার প্রয়োজন অন্তরঙ্গতা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব নয়। এস্তেলে বলেছেন, করোনা সংক্রমণের আগে তিনি গড়পড়তায় ভালো আয় করতেন। তা নিয়ে বাসার মর্টগেজ দিতেন। কিন্তু এখন সব আয় বন্ধ। তাই তিনি পেশাকে অনলাইনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এস্তেলে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলো, এটা আর শারীরিক সম্পর্ক এক নয়। তাছাড়া প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে। সব খদ্দের প্রযুক্তি বোঝেন না ঠিকমতো। এমন কি অনেকের স্মার্টফোনই নেই। তাই আমার সবকিছু আবার শূন্যে নেমে যাবে। আমাকে আবার হয়তো নতুন করে শুরু করতে হবে। তাছাড়া খদ্দেরের স্বাস্থ্য নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া সরকার যেসব নারী বেকার তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তবে এসব সহায়তা পাবেন তারা, যারা ট্যাক্স পরিশোধ করেন। ফলে অনিবন্ধিত যৌনকর্মী, অভিবাসী, হিজড়া সম্প্রদায়- তারা এ সুবিধা পাবেন না। এই রকম সমস্যা বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে বলে মন্তব্য করেছেন ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের ক্রিমিনোলজির প্রফেসর তিলা স্যান্ডার্স। তিনি বলেন, সরকারগুলো বেশির ভাগ মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু এর আওতায় আসছে না যৌনকর্মীরা। এ জন্য যৌনকর্মীদের সংগঠন বা পরামর্শক গ্রুপগুলো জনগণের কাছে জরুরি তহবিলের আহ্বান জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত অনলাইনে এমন আপিল করেছে লাস ভেগাস সেক্স ওয়ার্কার কালেকটিভ। তাতে জমা হয়েছে ১৯ হাজার ৩০০ ডলার। ইতালিতে কতগুলো গ্রুপের একটি জোট সংগ্রহ করেছে ১৯ হাজার ৫০০ পাউন্ড। প্রফেসর স্যান্ডার্স বলেছেন, এসব অর্থ জরুরি বিল, খাদ্য কেনার জন্য যৌনকর্মীদের লাইফলাইনকে টিকিয়ে রাখবে। তবে চলমান অবস্থার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক যৌনকর্মী তার পেশা
অব্যাহত রেখেছেন। প্রফেসর স্যান্ডার্স বলেন, উন্নয়নশীল দেশে যৌনকর্মীরা হলেন তার পুরো পরিবারের রুজির উৎস। তার ভাইবোন, সন্তান, অভিভাবকদের সবার দায় তার কাঁধে। ফলে তাদের পেশায় খরা যাওয়া মানে পুরো পরিবারে এর প্রভাব পড়ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত পোষণ করেন ইংলিশ কালেকটিভ অব প্রোস্টিটিউটস-এর নিকি এডামস। তিনি বলেছেন, বৃটেনে বেশির ভাগ যৌনকর্মী হলেন সন্তানের মা। তাদের কেউ কেজ পেশা অব্যাহত রাখতে পেরেছেন। অনেকে পারছেন না। প্রফেসর স্যান্ডার্স বলেন, এ সময়ে বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাও কমে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রকট। বিশেষ করে, যারা এইচআইভিতে আক্রান্ত তারা ভাইরাস বিরোধী নিয়মিত ওষুধ পাচ্ছেন না। প্রফেসর স্যান্ডার্স নাইরোবিতে ‘উবার স্টাইলের’ একটি অ্যাপ তৈরির কাজ করছেন টিমকে নিয়ে। এই অ্যাপ যৌনকর্মীদের ওষুধ সরবরাহের অর্ডার দিতে সহায়তা করবে।