সাজ্জাদ আলী : কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্য ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। জগৎ সংসারের যন্ত্রণাগুলোর মধ্যে এই ‘অপেক্ষা’ একেবারে প্রথম সারির। তেল বেচা টাকা ঢেলে কাতারওয়ালারা এয়ারপোর্ট একখানা বানিয়েছে বটে। মাইলখানেক লম্বা, চওড়াও সাইজেবল। টার্মিনালে শতাধিক সুসজ্জিত দোকান, সবই ডিউটি ফ্রি। তুমুল কেনাবেচা চলছে। শত সহস্র লোকের বসবার আসন পাতা। সে এক এলাহী কান্ড! একটু ফাঁকা জায়গা খুঁজছি। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে দূর প্রান্তে নিরিবিলি একটা লাউঞ্জে পৌঁছলাম। সোফায় গা এলিয়ে বসে একখানা বইয়ের পাতা ওল্টানো শুরু করলাম। রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা মাও সে-তুং এর জীবনী। ক’পাতা পড়তেই বিপ্লবী মাও আমার মানসপটে ফুটে উঠতে শুরু করলো। এমন সময় হঠাৎ সোফার পেছন থেকে কেউ একজন বাংলায় বলে উঠলো, ভাই কি ঢাকা যাবেন?
পেছন ফিরে দেখি ২২/২৩ বছরের এক যুবক। ক্যারি-অন স্যুটকেসের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে। চেহারা সাদামাটা, বোকাসোকা ধরণের। পোষাকআশাক চেহারার সাথে মানানসই। পরনে জিন্সের প্যান্ট। গায়ের গেঞ্জিতে কোনো এক খেলোয়াড়ের মস্ত ছবি আঁকা। বিখ্যাত ফুটবলার বা ক্রিকেটার কারো একজনের ছবি হবে। পায়ে কেডস্ জুতা, হাঁটলে জুতায় বাতি জ্বলে। দেখে মনে হলো সে “গুড বয়” টাইপের ছেলে। ইঙ্গিতে সামনের সোফাখানা দেখিয়ে বললাম, ওখানটায় বসুন। তা আমি যে ঢাকা যাচ্ছি, এমনটা কেন মনে হলো আপনার?
ভাই আপনে বাংলা বই পড়তেছেন তো তাই বুইঝা ফালাইছি। আলহামদুলিল্লাহ, আমার বোঝার ক্ষমতা ভালো। কী কন, ঠিক কইছি না?

সে প্রশ্ন করলো বটে, কিন্তু জবাব পাওয়া নিয়ে তাকে আগ্রহী মনে হলো না। বসতে গিয়ে হঠাৎ তার যেন কী মনে পড়লো। বললো, ভাই সিগারেট খাওয়ার জায়গা কই কন তো। একবারে খাইয়া আইসা বসি।
বললাম আমি তো নন-স্মোকার, ঠিক বলতে পারবো না। তবে যতদূর মনে পড়ে ওই দিকটায় “স্মোকিং রুম” সাইন দেখেছি।
আইচ্চা তয় আমি আইসতেছি। আপনে আমার ব্যাগটার দিক খেয়াল রাইখেন।

আমার জিম্মায় স্যুটকেস রেখে সে বিড়ি ফুকতে চলে গেল। খয়েরি রঙের ব্যাগে সবুজ কালির মার্কার দিয়ে লেখা “কামাল উদ্দিন, কুয়েত সিটি”। হাত ব্যাগটি তালা দেওয়া না, যে কেউ চাইলেই খুলতে পারবে। এই এয়ারপোর্টের সহস্র মানুষের কাউকেই সে বিশ্বাস করে না। শুধমাত্র বাংলা ভাষার পরিচয়ে আমাকে সে আপন মানলো। ভাষার কী অপরিশীম শক্তি! রনে বনে জনে জঙ্গলে যেখানেই হোক এক ভাষায় কথা বললেই হলো। আর কোনো চেনা জানার দরকার পড়ে না। আমরা পরস্পরকে চোখ বুজে আপন ভাবি।

আমি আবার পড়ায় মন দিলাম। মাও সে-তুং এর বাবা চাইতেন ছেলে চালের আড়তে চাকরি করে হিসাব লেখার কাজটা ভালো করে শিখে নিক। কিন্তু মাওয়ের ইচ্ছা সে স্কুলে ভর্তি হবে। বইয়ের এই চ্যাপ্টারটা খুব মনোসংযোগে পড়ছিলাম। এমন সময় এয়ারপোর্টের বাগি-কার (টার্মিনালের ভেতরে চলাচলকারী ছোট্ট বৈদ্যুতিক গাড়ি) কামালউদ্দিনকে নামিয়ে দিয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যপার কামাল বাগিতে চড়ে এলেন যে? আপনি কি অসুস্থ?

সে বলল, না ভাই, আমি ঠিক আছি। তয় স্মোকিং রুম এয়ারপোর্টের এক্কেবারে ওই মাথায়। তাই গাড়িয়ালারে নামায় দিতি কইলাম। এক কাড়ি টাকা দিয়া টিকিট কাটছি, ওগো এট্টু খাটাবো না? আর আপনি আমারে “আপনি আপনি” কইচ্ছেন ক্যা? তুই কবেন। আইচ্চা ভাই ঢাকা আপনার বাসা কোথায় কন তো? এয়ারপোর্টে আপনারে কি কেউ নিতি আইসবি? আমার আম্মা আর ছোড বইন আসবি আমারে নিতি। আমি ফরিদারেও আইসতে কইছি। ভাই আপনার কাছে মুখে মাখনের ক্রিম আছে? থাইকলে দ্যানতো, চোখেমুখে পানি দিছি, অহন চটচট কইরতাছে।
কামাল কথা বলেই চলেছে….., সামনের শুক্কুরবার আমার বিয়া। এই ব্যাগ ভইরা বাজার সদায় করছি। দুবাই’র থ্যাইকা কিনছি, সবই বিদেশি।

আমি ব্যাগ খুলে ক্রিমের টিউবটা কামালকে বাড়িয়ে দিলাম। সে একগাদা ক্রিম হাতে ঢেলে মুখে ঘষছে আর কথা বলছে। আমি যে তার কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছি না সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে অনর্গল বলেই যাচ্ছে। ক্রিমের টিউবটা উল্টেপাল্টে দেখে কামাল বললো, ভাই যদি কিছু মনে না করেন তো এই ক্রিমটুক আমারে দিয়া দেন। এর মদ্দি আর বেশি নাই। ৫/৭ বার মাখা যাইবো, তার বেশি না। ভারি ভালো ক্রিম, মুখখান এক্কেবারে ঠান্ডা হইয়া গ্যাছে। আর হইবো না, খাঁটি জার্মানীর তো। ভাই আপনে ……
আরো বকবক করতে করতে কামাল আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই ক্রিমের টিউব তার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। এই নেওয়ার মধ্যে কোনো জবরদস্তি নেই। আপনজনেরা যেমন একে অন্যের জিনিস অধিকার খাটিয়ে নেয়, কামালও ঠিক তেমন করেই নিলো। ওর কথার দাপটে কান ঝালাপালা। আবার তাকে থামাতেও মন চাইছে না। প্রসঙ্গটা একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ফরিদা কি তোমাকে খুব ভালোবাসে কামাল?

ফরিদার কথা আপনে জানলেন কী কইরা?
তুমি যে বললে সে তোমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসবে।
হ ভাই, ফরিদা আমারে ছাড়া বাঁচবো না, আমিও তারে ছাড়া না। মাছের যেমন বাঁচনের লাইগা পানি লাগে, আমারও তেমনি ফরিদারে দরকার।
এই তো আর ক’টা দিন মাত্র, ফরিদা তোমার হবে, তুমি তার, বললাম আমি।
ভাই তা হয় কিনা আল্লাহপাক জানেন, ভ্যাজাল লাইগা গ্যাছে। মামাতো বোনের সাথে আম্মা আমার বিয়া ঠিক করছে। তারে বিয়া না করলি আম্মা কইছে সে বিষ খাবি। ছোট বেলায় আমার বাপ মারা গ্যাছে। আম্মা আমারে কোলে পিঠে কইরা বড় কইরছে। অহন তার কথা ফালাই ক্যামনে? এদিকে ফরিদা আমার খেলার সাথী। এক সাথে সাঁতরাইয়া নদী পার হইছি। আমি জাম গাছের থ্যাইকা জাম পাড়ছি, সে পাড়ছে আম। গাছ তলায় বইসা এক সাথে ভাগাভাগি কইরা খাইছি। ক্লাশ টু’র থেইক্যা আইএ ক্লাশ পর্যন্ত একসাথে স্কুল-কলেজে গিছি। কত কিছু যে তার সাথে! আপনারে কোনডা থুইয়া কোনডা কই? চাইর বছর আগে যখন আমার কুয়েত যাওয়া ঠিক হইলো, তার সে কী কান্দন ভাই! সেও কান্দে, আমিও কান্দি। শেষে বুকে জড়াইয়া নিয়া কথা দিছিলাম, ফিরা আইসাই আমরা বিয়া করবো। সেই দিনটির অপেক্ষায় সেও আছে, আমিও আছি।

ফরিদার ব্যপারে তুমি মাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছো কামাল, জানতে চাইলাম আমি।
চেষ্টা আবার করি নাই? তয় আসল ভ্যজালডা লাগাইছে মামুরা। আব্বা না থাকায় মামুরাই আমাগো মুরুব্বি। আম্মা মামুগো কথার বাইরে যাইতি পারে না। তয় ভাই, দরকার পড়লি সারা জীবন বিয়া না কইরা থাকবো, তবু ফরিদারে ছাড়া বিয়া করবো না।
কিন্তু কামাল তুমি তো মায়ের ঠিক করা মেয়েকে বিয়ে করবে বলেই দেশে যাচ্ছো। অন্তত মাতো তাই জানেন। সে বিয়ের বাজারঘাটও করেছো, তাই না?
হ ভাই, বাজার করছি সে কথা ঠিক। তয় ফরিদার হাতের মাপে চুরি কিনছি। তার পছন্দের রঙের শাড়ী কিনছি। হারের লকেটেও তার নামই লেখা। দোকানে গিয়া সেন্টের গন্ধ শুইকা শুইকা দেখছি। যেটা ফরিদার গায়ের গন্ধের সাথে বেশি মিল পাইছি, সেইটাই কিনছি ভাই।
আহারে! সহজ সরল এই ছেলেটার জন্য খুব মায়া হলো। ইতিমধ্যে সে ফরিদার গায়ের গন্ধ, শরীরের মাপঝোপ সব জেনে ফেলেছে। তার চোখেমুখে প্রেমের তুফান খেলছিলো। সে পিরিতে কোনো খাদ নেই, একেবারে ২৪ ক্যারেট সোনার মতো খাঁটি। ফরিদার মনের অবস্থাও নিশ্চয়ই এমনই হবে। জগত সংসারে বড় কিছু পেতে বোধ হয় এমনই ঝঞ্ঝা পেরুতে হয়। মমতা মাখানো কন্ঠে কামালকে বললাম, তুমি তো মহা সংকটে পড়েছো, এক দিকে মায়ের ওয়াদা, আরেক দিকে ফরিদা।
বিপদ কন ক্যা? এতো মহাবিপদ! যদি আম্মারে রাজী করাতে না পারি তো যেমন আইছি তেমনই ফিরে যাবো কুয়েত।

কিন্তু তাতে তো সমাধান কিছু হলো না। ফরিদাকে রেখে তুমি তো তাহলে একাই যাচ্ছ কামাল। মেয়েটা তোমাকে ছাড়া কী ভাবে থাকবে বলো তো?
সে সব কথা ভাবলি আমার মাথার রগ ছিড়া যাইতি চায় ভাই। বুকের যন্ত্রণা সইতে পারি না। তয় আমার মনডা কয় শ্যাষম্যাষ ফরিদারে বিয়া কইরা আমি সাথে লইয়া যাইতে পারবো। ক্যামনে তা জানি না। আপনার ফোন নন্বরডা দ্যান। বিয়া ঠিক হইলেই আপনেরে আমি দাওয়াত দিবো। আপনার কিন্তু আসাই লাগবো। কথা দ্যান আমাগো দোয়া করতি আপনি আইসবেন। ঢাকার থেইকা গাজীপুর তো বেশি দূর না ভাই। কথা দ্যান আপনি আসবেন!
নাছোড়বান্দা কামাল কথা আর ফোন নম্বর দুটোই নিয়ে ছাড়লো। বললাম, কামাল আমি অনেক দোয়া করছি, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক।

কামাল বললো, ভাই আমার আম্মা অনেক শক্তপোক্ত মনের মানুষ। তার জবান রাখার চেষ্টা সে করবোই। তয় আম্মার কাছে আমি এক দিকে, আর সারা পৃথিবী আরেক দিকে। সেইডাই আমার ভরসা। আম্মা যখন বুঝতি পারবি যে ফরিদারে ছাড়া আমি বিয়াই করবো না, মনডা কয় তখন সে রাজি হবি। ভাই আমি মামাতো বোনডার ভাল দেইখা একটা বিয়ার ব্যবস্থা করবো। আল্লাহ’র কছম সব খরচাপাতি দিবো। আপনি কিন্তু আমারে কথা দেছেন। আমি ফোন করলেই আপনি আইসা পড়বেন। বিয়েতে আপনের কিছু দেওয়া লাগবি না। খালি আমাগো মাথায় হাত রাইখা দোয়া কইরবেন ভাই।

দোহা এয়ার পোর্টে সেদিন মাও সে-তুং এর জীবনীর আর একটি পাতাও পড়িনি। মাওয়ের জীবনী থেকে কামালের জীবনকথা কম কিসে? এখন কামালের ফোনের অপেক্ষায় আছি। আমি সত্যিই যাবো ওর বিয়েতে। তাতে আমার কাজকর্মের যত ক্ষতিই হোক!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)