সাজ্জাদ আলী : দোলাকে বরণ করতে টরন্টো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছি। এই তার প্রথম আসা। ইমিগ্রেন্ট হয়ে কানাডা আসছে সে। মাত্রই ওর প্লেনখানা ল্যান্ড করেছে। এয়ারপোর্টের ফরমালিটিজ সেরে লাউঞ্জে বের হতে ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই। ত্রিশ বছরের পূরোনো বন্ধুত্ব আমাদের। যোগাযোগটা নিয়মিত থাকলেও ওকে শেষ দেখেছিলাম এগারো বছর আগে। ছবিটবি দেখে তো মনে হয়, রূপ আর যৌবন দুটোই সে আগলে রাখতে পেরেছে।
টরন্টোর বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় দোলার জন্য একটা স্টুডিও এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছি। ভাড়াটা একটু বেশি হলেও বাসার লোকেশনটা ওর জন্য পারফেক্ট। এপার্টমেন্ট থেকে বের হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি দেখবে। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে “ছেড়ে আসা দেশের কথা” খানিকটা ভুলে থাকবে। তাছাড়াও বাস, ট্রেন, দেশি গ্রোসারীর দোকান ইত্যাদি সবই হাঁটার দুরত্বে। কাঁচা মরিচ, ইলিশ মাছ, ধুনে পাতা, শুটকি এগুলো সব ঘরের কোণেই পেয়ে যাবে।
ট্রলিতে ঢাউস সাইজের দুটো স্যুটকেস নিয়ে দোলা লাউঞ্জে বেরিয়ে এলো। দূর থেকে দেখেই চিনে ফেললাম। ওর চেহারায় ত্রিশ ঘণ্টা বিমান যাত্রার ধকল স্পষ্ট। এলো চুল বারে বারে উড়ে এসে ওর মুখখানা ঢেকে দিচ্ছে। দুখানা হাতই ট্রলি সামলাতে ব্যস্ত। সেই সুযোগে চুলেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। পরনের প্যান্ট আর গায়ের টি-সার্ট কুঁচকানো। মনে হয় প্লেনের পাশের সিট খালি পেয়ে গড়াগড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাকে খুঁজছে। আমি ওর পেছন দিকটায়। একেবারে ঘাড়ের কাছে গিয়ে বললাম, ওয়েল কাম টু কানাডা দোলা! খানিকটা চমকে উঠে ফিরে তাকালো। তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। আমি জানি এ জড়িয়ে ধরায় কোনো পাপ নেই, সবটুকুই তার তাৎক্ষণিক আবেগ। তবে পাপের(!) জড়িয়ে ধরাটাও ঠিক এমনই হয়। দীর্ঘ বছর বাদে এ জড়াজড়ি আমার বেশ লাগলো। ওর মুখের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললাম, পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো দোলা?
আরে নাহ্, প্লেন খালি, শুয়ে বসে আয়েশ করে এসেছি।
আচ্ছা চল তবে সামনে এগুই, গাড়ি পার্কিং লটে। খানিকটা হাঁটতে হবে। বলে, ওর হাত থেকে ট্রলিটা নিলাম।
হাইওয়েতে গাড়ির গতি তখন ১২৫ কিলোমিটার। বললাম, সিট বেল্টটা বেঁধে নাও। এটা নিয়মের দেশ, পুলিশ দেখলে মামলা ঠুকে দেবে।
বেল্ট বাঁধতে বাধঁতে দোলা প্রশ্ন করলো, আমার জন্য যে বাসা ঠিক করেছো, সেখানে যাচ্ছি তো?
হাঁ, ৩৫/৪০ মিনিট লাগবে, রাস্তায় চোখ রেখে বললাম আমি।
তোমার বাসায় উঠতে চাইনি বলে তুমি কিছু মনে করোনি তো? আমার হাজবেন্ড ভাউড়াটা যদি আসতো, তবে তোমার বাসায়ই প্রথম ক’দিন থাকতাম। কিন্তু তা আর হলো কই, বলো? ওটাকে বিদায় করে দেবো ভাবছি। আর পারি না। শোনো, আমার কিন্তু একদিনও বসে খাওয়ার মতো টাকাপয়সা নেই। একটা চাকরি খুঁজে দাও। আর বয়ফ্রেন্ডও লাগবে একজন!
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বয়ফ্রেন্ড পদের জন্য আমি এক্ষুণি দরখাস্ত করে রাখছি। পরীক্ষা প্রার্থণীয়!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করেছে দোলা। তেরো বছর বিশ্বব্যাংকের চাকরিও করেছে। কিন্তু ওর সার্টিফিকেট আর চাকরীর অভিজ্ঞতা কানাডার চাকুরিদাতারা মানছে না। তাদের কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স চাই। অগত্যা, এই আধা-বুড়ি বয়সে দোলা ছুড়ি সেজে ইয়র্ক ইউনির্ভাসিটিতে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন পড়ছে। সরকার ওর পড়ার জন্য টাকা ধার দিয়েছে। সে টাকা টিউশন ফি, বাসাভাড়া, আর ট্রানপোর্টেশনের জন্যই ব্যায় হয়ে যায়। এখানকার পড়াশুনা দোলার জন্য কঠিন কিছু না। কিন্তু অনেক পড়া, প্রতি সপ্তাহে দুতিনটা এসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়। ইদানিং সে বই খাতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।
ওদিকে আমার বয়ফ্রেন্ডের দরখাস্তখানা এখনও মঞ্জুর হয়নি। আবার বাতিল হয়েছে বলেও জানায়নি। ধৈর্যের বাঁধ মানে না ! তো খবর নিতে এক রবিবার বিকেলে দোলার বাসায় গেলাম। দরজা খুলে আমাকে দেখেই বললো, ও তুমি, এসো এসো ভেতরে এসো। ঢুকে দেখি এলাহীকান্ড! ঘরের মেঝে ভর্তী গাদি গাদি ডালপুরি আর সিঙ্গাড়া বানিয়ে পাজা করেছে। সবই কাঁচা, ভেজে খেতে হবে।
শোনো না, আমাকে একটু হেল্প করবে প্লিজ, বললো দোলা। এই খাবারগুলো সেই বাঙ্গালী গ্রোসারী দোকানটায় সাপ্লাই দেবো। ওই যে সেই দোকানটা, তুমি একবার নিয়ে গিয়েছিলে, মনে পড়ে। তোমার গাড়ি করে এগুলো একটু নিয়ে চলো।
পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে দোলা সিঙ্গাড়া, পরোটা, ডালপুরি বানিয়ে বাংলা গ্রোসারীতে প্রতি সপ্তাহে সাপ্লাই দেয়। এই ব্যবসায় মাসে তার এক দেড়শো ডলার আয় হয়। তাতে করে হাত খরচটা সে আরেকটু হাতখুলে করতে পারে।
এ ভাবে চলছিলো দোলার ব্যবসা। গ্রোসারীর দোকানদার আল্লাহওয়ালা মানুষ। মাথায় টুপি, পরনে আলখাল্লা টাইপ পাঞ্জাবি। হাতের কজ্জিতে তজবি প্যাচানো। মন চাইলেই প্যাচ খুলে তজবির দানা গুনতে থাকে। ইনশাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ ছাড়া কোনো বাক্য বলেন না। এখানকার বাঙ্গালী ধার্মিক কমিউনিটিতে তার জনপ্রিয়তা আছে। মসজিদ কমিটির প্রভাবশালী সদস্য তিনি। দোলার সাথে সুমিষ্ট আচরণ করেন। তবে সমস্যা হলো, মাল সাপ্লাই দিলে দোলা সাথে সাথে টাকাটা পায় না। সিঙ্গাড়া ডালপুরি বিক্রিবাট্টা করে সপ্তাহ শেষে দোকানদার ওকে টাকা দেয়। অর্থাৎ সব সময়েই এক সপ্তাহের মালের টাকা দোলার পাওনা থাকে। তবুও সেটা মন্দের ভালো!
আমাদের দোলা মেধাবী, দু বছরের কোর্স সে দেড় বছরে শেষ করেছে। ওর প্রফেসারের সুপারিশে ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টের আগেই ফ্যাকাল্টিতে ভাল বেতনে একটা চাকরি পেয়েছে। এখন আর দোলা সিঙ্গাড়া বানানোর সময় পায় না। ইনফ্যাক্ট প্রয়োজনও নেই।
ওদিকে দোলা সেই গ্রোসারির দোকানে শেষ কিস্তির টাকাটা পায়। সব মিলিয়ে ৩৪১ ডলার। তো একদিন টাকাটা আনতে গেলে দোকানদার বললো, আপনে তো গত সপ্তায় মাল দেন নাই আফা?
ভাই আমি একটা ফুলটাইম চাকরি পেয়েছি। এখন আর ওগুলো তৈরি করার সময় পাই না।
ও আইচ্চা, তয় সামনের মাসে আইসেন, আপনের ট্যাকাটা লইয়া যাইয়েন।
দোলা বললো, ভাই আমি তো সময় পাই না। টাকাটা আজ পেলে খুব উপকার হতো।
কিনাব্যাচা নাই, কইত্যে ট্যাকা দিবো, সামনের মাসে আসেন দেহি কী করা যায়, বলে দোকানদার অন্য কাজে মন দিলো।
কী আর করা? নগদ ৩৪১ ডলার! বহু কষ্টের টাকা! দোলা পরের মাসের এক তারিখেই গিয়ে হাজির। দোকানদার বলে, আফা এক্কেরে পয়লা দিনই চইলা আইছেন? শ্যাষ সপ্তায় আইসেন, শ্যাষ সপ্তা। মাসের একেবারে শেষ দিনে দোলা আবার গেল। ওকে দেখেই দোকানি হাক ছেড়ে ক্যাশ কাউন্টারের মেয়েটিকে বললো, ওই বেলী এই আফারে পঞ্চাশটা ট্যাকা দে তো (এখানকার বাঙ্গালীরা ডলারকে টাকা বলে)।
বিরক্ত হয়ে দোলা বললো, পঞ্চাশ কেন ভাই? ৩৪১ ডলার পাওনা তো!
হেইডা আমার মনে আছে আফা। তয় ব্যবসা বানিজ্য নাই, একসাথে আফনার ট্যাকা দিতি পারবো না। খাতে খাতে নিতি হইবো।
সে কী কথা? এই ডলার নিতে আমি তাহলে কতবার আসবো? আপনি তো একেবারে দেশি স্টাইলে কথা বলছেন! কানাডায় কেউ বাকি কেনাবেচা করে নাকি?
করে আফা করে, এই যেমন আপনে আর আমি করছি, বললো মুদি দোকানদার।
ভাই আমি পঞ্চাশ ডলার নেবো না। আগামী বুধবার আবার আসবো, ডলারগুলো একসাথে দিবেন প্লিজ।
দোকানি বিরক্ত হয়ে বললো, এক কথা আপনেরে কয়বার কবো? কইলাম না কেনাবেচা ভালো না, এক সাথে ট্যাকা দিতি পারবো না।
এ সব কী বলছেন আপনি? আপনার ব্যবসা ভালো না, সে কথা আমাকে শোনাচ্ছেন কেন? আমি তো আপনার ব্যবসার পার্টনার না। বিনা টাকায় আপনাকে অগ্রীম খাবার সাপ্লাই দিয়েছি। আপনি তা বিক্রিও করেছেন। এখন সেই ডলারটাই আমাকে দিবেন। ব্যবসা ভালো মন্দের প্রশ্ন এখানে আনছেন কেন?
আপনে অনেক প্যাচাইলা কথা কন আফা! এত কথা শোনার সময় আমার নাই, এখন যান তো, বলে দোকানদার মিনি ট্রাক থেকে বেগুনের কার্টুন নামানো শুরু করলো।
দোলা তো হতভম্ব, অনেক কষ্টের টাকা তার! কী করে মানুষ এতটা বাজে হয়? দোলা তার পিঁছু পিঁছু গিয়ে বললো, এই ক’টা টাকার জন্য আমার কী তবে পুলিশ ডাকতে হবে?
মুদি দোকানদার বেগুনের কার্টুনটি ধপ করে মাটিতে ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। অগ্নিমূর্তী তার। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, আফনে যে ট্যাকা পান তার কিছু লেখাজোখা কাগজ আছে আফনের কাছে? যান, পুলিশির কাছে যান। আফনের আগেও অনেকে পুলিশ ডাকছে!
আরো প্রায় ছয় মাস গত হয়েছে। দোলার এখন আর টাকাপয়সার টানাপোড়েন নেই। ৩৪১ ডলারের শোকও কাটিয়ে উঠেছে। এক সন্ধ্যায় গ্রীক ভিলেজের একটা রেষ্টুরেন্টে আমরা দুজন ডিনারে গিয়েছি। খাবরের অর্ডার দিয়ে মাত্রই পানির গেলাসে চুমুক বসিয়েছি। খুব উচ্ছসিত হয়ে দোলা বললো, আরে কাল কী ঘটেছে জানো? তোমাকে তো বলাই হয়নি।
আমি ঢোক গিলে বললাম, বলো শুনি।
তুমি তো জানোই, আমি নামাজী না। কিন্তু গতকাল আমার পশের বাসার ভাবির পীড়াপিড়িতে মসজিদে গিয়েছিলাম। আমার এপার্টমেন্টের কাছের মসজিদটায় মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা আছে। বাঙালি মহিলারা সেখানে খুব ভিড় করে। জামাত শুরু হবে হবে এমন সময় আমার পাশের দুই মহিলা বলাবলি করছেন যে ঈমাম সাবের কী অসুখ? আজ দুদিন তাকে দেখছি না যে?
দোলা খুব উৎসাহ নিয়ে ঘটনা বলছে। বলতে বলতে চেয়ারে পা তুলে বসলো। তারপর হলো কী জানো ? ঈমাম সাহেবের সুরা পড়ার শব্দ শুনে গলাটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। ওমা, ভালো করে চেয়ে দেখি, সেই মুদি দোকানদার নামাজ পড়াচ্ছে! আচ্ছা তুমিই বলো, ওর পেছনে আমি কেমনে নামাজ পড়ি?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)